রবি আড্ডায় অনির্বাণ ঘোষ

বেড মিশালি আঁকাবাঁকা ভাঙ্গা পথ পেরিয়ে ধুলো উড়িয়ে যেখানে দুরন্ত গতির বাইকটা ব্রেক কষলো সেখানেই মূল রাস্তা থেকে একটা সরু পথ ডাইনে মুড়ে গেছে। আর সেই বাঁকেই খানিকটা হেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরমা ঘেরা একটি ন্যুব্জ চালাঘর। তার খড়ের চালা আরো কুঁজো করেছে ঘরের আদল। সেই দরমার বেড়ার ঘেঁষে দ হয়ে বসে আছে শীতের সকালে রোদ মাখা এক বুড়ো। পেছনে মাইলফলক। তাতে লেখা কাহালা। ফেসবুক পোস্টে দিকশূন্যপুর বলে ক্যাপশন দিয়ে সুন্দর পোস্টানো যায় সে ছবি।

বুড়োর কাছে আর্জি কাহালার খোঁজ করতেই মুখ তুলে ঘোলাটে তাকালো সে। আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল নির্বাক ছবির চরিত্রের মত। স্ট্যাচুর মতো বসে থাকা সেই বুড়ো নিস্পন্দ। নড়ন-চড়ন নেই। শুধু চোখের পাতা দুবার পড়লো আর নড়লো শুধু তার ডান হাত হাতের তর্জনী – তার পয়েন্টার। এমন চরিত্র সামনে পেলে উপোসি সাংবাদিকের প্রশ্ন করার প্রলোভন ত্যাগ করা বড় কঠিন। তাই টুকটাক কথাবার্তারও সুযোগ হলো। এই জায়গার নাম, বাড়ি কোথায়, দাদুর? উত্তরে বুড়ো বলল কিছু বলল না। এবার বাঁহাতের তর্জনী পেছনদিকে। ব্যাক ড্রপ এ থাকা কুঁজো বাড়ির দিকে।

খবর খুঁজিয়েদের চেহারার একটা আলাদা ছাপ থাকে। আগে ছিল হাতে ছোট নোটপ্যাড, বল পয়েন্ট পেন, ক্যামেরা। এখন ঝাঁ-চকচকে স্মার্টফোন। ছোট নোটপ্যাডের ব্যবহারও অনেকটাই কমে গিয়েছে। তবে কৌতুহলী চোখ আর ছটফটে ব্যস্ততা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে রাখে তাদের। কাগজের পাতা চার নম্বর কলামে ছোট্ট করে নিজের নাম বা নিজের বলা কথা ছাপা অক্ষরে দেখতে কার না ভালো লাগে। প্রত্যন্ত ধুলো ওঠা পাড়াগাঁয়ের এই বুড়োও ব্যতিক্রম ছিল না। এক একটা মানুষ এক একটা ইনফরমেশন হাব। এত তথ্য ঠাসা যে যেকোন সময় পোখরান বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর ধামাকা হয়ে যেতে পারে। শুধু তথ্যের ধরণটা স্থানভেদে পাল্টায়।

কতদিন ধরে এখানে থাকেন প্রশ্নটা সাবধানে করতে হয়। এলাকায় মানুষজনের একটা বড় অংশ ওপার বাংলার কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে আসা। 

জানা গেল বসবাস করছেন কয়েক পুরুষ ধরে। জন্ম থেকেই। বাবা এসেছিল ১৯৫৬ তে।

বয়স কতো আপনার 

– ৭৮

আপনার চেহারা দেখে তো বোঝা যায় না

উত্তরে চোখ হাসলো। মুখোশকালে মানুষের হাসি লুকিয়ে  পড়েছে মুখোশের আড়ালে

  • এটাই কি কাহালা?

আবার নির্বাক বুড়ো সিম্প্লি মাইলফলক দেখায়। কাহালা ০ কিমি।

  • আর্জি কাহালা কতদূর?

এবার মুখোশের আড়ালে ঠোঁট নড়ে বুড়োর। সে মুখে কটা দাঁত আছে তাতে দোক্তা বা খৈনি আছে কিনা এ্যানাটমী ক্লাস করা ফটোগ্রাফারদেরও মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে ।

ঐতো এই রাস্তা ধরে যান। প্রথমে সাঁওতাল পাড়া, তারপর খানবস্তি পাবেন। তারপরে বাঁশঝাড় পাশে নদী। নদী পেরোলেই আর্জি কাহালা, অবশেষে মুখ খোলে বুড়ো।

মুখোশে ঢাকা গ্রাম গঞ্জের মুখ। হাসি ঢাকা পড়ে গেছে। অভিব্যক্তি চাপা। হাসিটা – সে প্রাণোচ্ছল হোক বা বেদনাক্লিষ্ট, লাজুক হোক বা বিষাদতাড়িত, স্নিগ্ধ বা ফোকলা – সবই  মুখোশের আড়ালে আবডালে। চোখ পড়ে নিতে হয়। এই ব্যস্ত সময়ে যখন মানুষ আত্মগত অন্তরীণ তখন চোখ পড়ারইবা সময় কই ! তাই চোখের উদ্ভাসে মনের কথা, চোখের তারায় ভেসে ওঠা অকথিত ভালোবাসা, চোখের কোণে জমা গভীর গোপন বিষাদ অধরাই রয়ে যায়। ভেঙে পড়া বাঁশের সাঁকোর পাশে হেলে পড়া বটের ছায়ায় প্রেমিকের আঙুলে আঙুল চালাতে চালাতে এক আকাশ বিষণ্ণতা মেখে নিল যে কিশোরী প্রেমিকা তার চোখের ছায়া পড়ে না প্রেমিকের উপোসী চোখে। বর্ষার ধারাস্নানে পুষ্ট উদ্ধত পাটেদের ক্ষেতে জড়াজড়ি করে থাকা নগ্ন নরনারী ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতে পারে না। এমনকি রমণরত দীর্ঘ দাম্পত্যও চুম্বনরহিত।

এমনই এক মুখোশকালে, গ্রাম গঞ্জের ধুলো উজিয়ে হাজির কাহালায়। প্রথমে ১২ কিলোমিটার রাজ্য সড়ক। বিডিও অফিসের কোল ঘেঁষে বাঁদিকে আঁকাবাঁকা 

 গ্রামীণ পথ। কোথাও চলটা উঠে গিয়েছে অথবা আগলছাড়া বানের জলে ধুয়ে গিয়েছে রাস্তা। কোথাও পুল ভেঙে পড়েছে।আর তার পাশে দিয়ে মানুষ  নিজের খেয়ালে গড়ে নিয়েছে তার নিজস্ব পথ। এভাবেই ধুলোওড়া চড়াই উতরাই পেরিয়ে কাহালা পৌঁছেছিল সাংবাদিক। প্রথম স্ট্রাইক করে তাকে ডি এম- এর ফেসবুক পোস্ট। জেলার একটা সেন্সাস অনুযায়ী গোটা জেলায় আনইনহ্যাবিটেড ভিলেজ ১৯। বিশ্বাস হয়নি তার। জনঘনত্ব যেভাবে বেড়েছে, যেভাবে কাঁটাতার পেরিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ এসেছে এবং আসছে তাতে বিশ্বাস না হওয়ারই কথা ।জেলাশাসকের অফিস চত্বরে একটা ছোট্ট ঘরে ফাইল ঢাকা টেবিলের পেছন থেকে ছোট্ট মানুষটি তাকে এই আনইনহ্যাবিটেড ভিলেজের যে তালিকাটা দিয়েছিল তাতে সবচেয়ে কাছের গ্রাম ছিল আর্জি কাহালা। কেন গ্রামগুলি নামানুষী তা বলতে পারেনি জেলাশাসকের দপ্তরে ওই কনিষ্ঠ করণিক। তবে গ্রামগুলো যে যে ব্লকে  তার সুলুক-সন্ধান যে ব্লক অফিসে পাওয়া যাবে তা জানিয়েছিল সে। চেয়ার ছেড়ে উঠবার সময় সাংবাদিককে সে বলেছিল কারণটা জানলে একটু জানাবেন। বলবার সময় ব্যাপারটা নিয়ে তার কৌতূহলের আন্তরিকতা আছে তা বোঝানোর জন্য হয়তো তার মুখোশ খানিকটা নামিয়ে নাকের ডগার টুকরো দেখিয়েছিল। হয়তোবা দেখায়নি। ঠিক মনে পড়েনা তার। ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সে মুঠোফোনে কন্টাক্ট লিস্ট ঘাটতে। 

হেমতাবাদের ভিডিও একজন সদা চঞ্চল চনমনে অফিসার হিসেবেই পরিচিত। টিপটপ ফিটফাট ।ক্লিন শেভ মুখে তার কর্পোরেট হাউজের স্বস্তিবাচন জুতোর পালিশে ঝলকায় আত্মবিশ্বাসী আলো। সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে একটু থমকে যান তিনি। তারপর স্বকীয় সপ্রতিভতায় খুব ক্যাজুয়ালি বলে ওঠেন-

আমার ব্লকে আনইনহ্যাবিটেড ভিলেজ? জানতাম না তো!

আর্জি কাহালা?

বড়বাবু স্থানীয় লোক। ওনার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আমি রিংব্যাক করছি। আধাঘন্টা ওয়েট করুন।

খোঁজ পেতেই বাইক নিয়ে রওনা হয়েছিল সে।

তারপর কাহালা এসে বুড়োর খোঁজ মিলল আর তার কাছ থেকে খোঁজ পাওয়া গেল আর্জি কাহালার।

বুড়োর দেখানো আঁকাবাঁকা পথ ধরে নিকোনো সাঁওতাল পাড়া ছাড়িয়ে মুরগি চরা খানবস্তি পেরিয়ে যে স্বচ্ছতোয়া খালের মত গলাডুব কুলিক নদী পাওয়া গেল তার পাড়ে গাছের ডালে ঝুলছে মুখোশ। টুপিওয়ালার টুপির স্ট্যান্ডে রাখা টুপিদের মত। মানুষহীন মুখোশ দেখে তার বড় সাধ হল মুখোশহীন মানুষদের দেখতে। নদীর ওপারে সবুজ ধানের শ্যামল হাওয়া। মাঝে মাঝে চিরহরিৎ গাছের সবুজ ছায়া যে ছায়া স্নিগ্ধতা দেয়। চোখ জুড়ায়। সাঁওতাল পাড়া থেকে যুবতী মেয়ের কলকল শুনে পেছনে ফেরে সাংবাদিক। কোমরে কাপড় জড়িয়ে মুখোশের আড়াল থেকে উন্মোচিত হয় মুখ। মুখোশ গাছের ডালে ঝুলিয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়ার উপক্রম করতেই সাংবাদিক শুধোয়, ওইপারে বাড়ি?

  • ওই পারে মানুষ থাকে না। ওটাতো নামানুষী গাঁ। আমরা যাই। মরদের খাবার দিয়ে ফিরে আসি
  • ওরা কি করতে গেছে ওখানে?
  • চাষাবাদ। দিনমান চাষ শেষে ফিরে আসবে এপারে।

মসৃণ কোমল কালো মুখের সাদা দাঁতের পাটিতে আলো ঝলকায়।

সরু নদীর গলাডুব জল এক বুক শীতলতা নিয়ে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতে চায়। নদীর বুকে চরম সুখ পরম শান্তি।। নদী পেরোলেই সূর্যের উঁকি দেওয়া থেকেই টুকি দেওয়া পর্যন্ত মুখোশহীন মানুষের ঢল।

সাংবাদিকের শরীর শুলায়। মন বেড়া ভাঙতে চায়।

মুখোশের আড়ালে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ঠোঁটজোড়া পরিত্যক্ত বাড়ির দরজার পাল্লার মতো এঁটে ধরে। সাংবাদিক  মুখ ফেরায় ও বাইক ঘোরায়। আরো ১৮ টি  নামানুষী গাঁয়ের গল্প  কুড়িয়ে বেড়াতে হবে। নিউজ ডেস্কের রজতদা যে শাসাচ্ছে –  এক্সক্লুসিভ চাই, শংকর। এক্সক্লুসিভ।

(নবান্ন পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত)

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *