
রবি আড্ডায় সঞ্চিতা সান্যাল
স্বর্গের সঙ্গে তার ছিলো আড়ির সম্পর্ক। আর পৃথিবীর সঙ্গে ভালোবাসার। লিখেছিলেন, “পৃথিবীর মুখে একটা বিষাদ লেগে থাকে।” সে জন্ম দেয়, কিন্তু কিছুতেই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। এই তার অসমর্থতা, এই তার অসম্পূর্ণতা, এইইই
তার সব চাইতে অসহায়তা। এতেই তাকে ভালোলাগা!
রবি ঠাকুর কি এক অসম্ভব বিশ্বাস থেকে যে বলেছেন, বারবার
“আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি!”
গতকাল ফিরছি। মেট্রোর সামনের সিটে এক যুবতী বসে। দুটো কোমল ডাগর চোখ মেলে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির সঙ্গে আলাপরতা।
দুই জনের সে আলাপ নানা কোলাহলে শুনতে না পেলেও, তাদের দেহের ভাষায়, চোখের ভাষায় খুব যে একটা ভালোলাগার ভাব রয়েছে, তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।
গন্তব্য আসতেই, ছেলেটি নামার আয়োজন করতে থাকে। মেয়েটির চোখ ছলছল করে উঠলো।
তৎক্ষণাৎ ছেলেটি তার মুখটি নামিয়ে মেয়েটির কপালে একটি চুম্বন দিয়েই নেমে গেলো।
আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখি, সে আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণটুকু টিপে জল টুকু চোখের বেড়েই মিলিয়ে নিলো।
তাকে গাল বেয়ে গড়াতে দিলো না।
বাড়ি ফিরেও দৃশ্যটুকু আর ভুলতে পারিনি।
কেমন যে একটা ভালোলাগা আর কষ্টের বোধ- এর মাঝামাঝি আটকে রয়েছি গতকাল থেকে। সারাদিনের নানা কাজে, কেবলই অকারণে ঐ প্রেমিক যুগলের ভালোবাসার মুহূর্তটুকু আমাকে বিষাদগ্রস্ত করছে!
ভালোবাসা এমন করে অসম্পূর্ণ থেকে যায় বলেই কি সে শুধুই চোখের জল? সে কি কেবলই বেদনাময়?
এই যে মস্ত পৃথিবীটা এমন চুপ করে পড়ে রয়েছে, তার কোলাহল, হলাহল, প্রভাত, সন্ধ্যা, সরবতা, নীরবতা, সবলতা, দুর্বলতা, পরিনতি, অপরিনতি, নিয়েও সে দিব্য আছে।
তার কোনো অভিযোগ নেই। অভিমান নেই। অনুযোগ নেই।
আমরা হতভাগা।
পৃথিবীর এই বিচিত্র বৈভবকে বুঝতে পারি না।
বাইরের কোনো এক অদৃশ্য প্রবল শক্তি আমাদের অশ্রুসিক্ত ভালোবাসার ধনগুলিকে বুক থেকে উপড়ে নিয়ে যায়!
পৃথিবীর মুখে তাই সুদূরপ্রসারী বিষাদ লেগে থাকে..।
মনে হলো, এই বিষাদটুকু যদি না লেগে থাকতো!
যদি সবকিছু নিটোল হয়ে, সম্পূর্ণ হয়ে যেতো!…
যদি ছেড়ে যাওয়া না থাকতো!
যদি ফিরে ফিরে ডাক না থাকতো!
যদি আসবো, বলে আসা না থাকতো!
যদি মরণ না থাকতো!
যদি বেদনা না থাকতো!
অথবা,
মেয়েটির আগেই ছেলেটির ওমন নেমে যাওয়া যদি না থাকতো…
তবে,
মেয়েটির চোখের জলটুকু ওমন করে গোপন করার আপ্রাণ প্রয়াসটুকু দেখার সুযোগ কোথায় পেতাম!
কি করেই বা বুঝতাম
এই পৃথিবী আসলে “কোমলতা ও দুর্বলতা -ময়”!