
রবি আড্ডায় সাধন দাস
অন্ধ যেমন জানলা খুলে বসে থাকে, আমিও থাকি। রান্নাঘর থেকে মা চিৎকার করে ডাকছেন, মনে হচ্ছে, বহুদূরে কেউ চেঁচামেচি করছে। আমি শুনতে পাইনি কিংবা শুনতে চাইনি।
যেহেতু আমার নাম চায়না। কেউ ডাকলে আমার শুনতে ইচ্ছে করে না। না শুনতে শুনতে আমি কালা হয়ে গেছি। চাইনা চাইনা চাইনা। উঠতে বসতে, কাছে দূরে দুনিয়ার সবাই বলে চাইনা। কেউ ডাকলেই আমার ভয় করে। বুকের ভিতর কাঁপতে থাকে। ভয়ে পালিয়ে নিজের অজান্তেই অন্যমনস্ক থাকি, আনমনা থাকতে ভালোবাসি।
মা বলে, হতচ্ছাড়া মেয়ে, ইচ্ছে করে কালা হয়ে মরলো, সব্বনাশী, কে তোকে বিয়ে করবে?
মা বাবা দুজনেই চেয়েছিলো আমি ছেলে হই। হইনি। তার উপর কালো। দুজনা মিলে যুক্তি করে নাম রাখলো চায়না। ভাবলেই কষ্ট হয়। কেউ ঠোঁট নাড়লেই মনে হয়, নাম ধরে ডাকছে। রাগে মাথা গরম হয়ে যায়। নিজের উপর ঘেন্না হয়। উত্তর দিই না। চুপ করে থাকি। কান্নার আওয়াজ ছাড়া স্বর বেরুতে চাই না। কথা না বলতে বলতে বোবা হয়ে যাচ্ছি। বাবা বলে, বোবা কালা মেয়ে কেউ নেবে না। একদিন কোলকাতায় তোকে হারিয়ে আসবো।
বাবা ভুলে যায় যে আমি এখনও একটু একটু শুনতে পাই।
পড়ার নাম করে জানলা খুলে বসে থাকি কখন ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা ট্রেন ধরতে হুড়মুড়িয়ে ছোটে। কখনও চোখ এড়িয়ে যায় কখনও দেখি। মণিদা একটা ভাঙা ছাব্বিশ ইঞ্চি মাডগার্ড খোলা সাইকেলে দৌড়য়। পথে লোক থাকুক না থাকুক বেল বাজিয়েই চলে। এতো অস্থির জোরে বাজায়, মনে হয়, হ্যাণ্ডেল থেকে বেলটা এক্ষুণি খুলে পড়বে। আমার এতো হাসি পেয়েছিলো হো হো বেদম হেসে উঠেছিলাম। আমার দিকে তাকাতে গিয়ে মণিদা ধপাস। গম্ভীর মুখে উঠে আমার দিকে একবার তাকিয়ে ফিক করে হেসে চলে গিয়েছিলো। সেই থেকে এই সময় রোজ বসে থাকি, মণিদা যায় আমার দিকে তাকিয়ে হাসে আর আমিও হাসি। দুটুকরো হাসির সম্বল নিয়ে বোবা কালা কালো মেয়ের দিন কেটে যায়।
রবিবার মণিদার ছুটি। যায় না। তাই শনিবার জানলায় দাঁড়িয়ে একটু গল্প করে যায়। ফ্যাঁসফেঁসে গলার অস্পষ্ট স্বর। সব বুঝতে পারি, আমি বোবা হয়নি, কালা নই। বুকের ভিতর খুশির ঝড় ওঠে। মণিদার ট্রেন ধরার তাড়া। কথা অর্ধেক বলে, অর্ধেক না বলে সাইকেলে চেপে ছুটতে থাকে। আমার কিছু বলা হয় না। যা কিছু বলার ইচ্ছা জমে থাকে, দরজা বন্ধ করে রবিবার সারাদিন একা গল্প করি। তখন আমিই চায়না আমিই মণিদা।
একদিন স্কুল চুরি করে মণিদার সাথে কোলকাতা দেখতে গেলাম। দুজনেই অনর্গল কথা বলছি, শুনছি, হাঁটার বিরাম নেই। মণিদা একটা আঠেরোতলা বাড়ির ছাদে নিয়ে গেলো। কার্ণিশে দাঁড় করিয়ে বললো- এখান থেকে গোটা শহর দেখা যায়। দেখো। কাজ সেরে এসে, নিয়ে যাবো। সবাই ভাববে, তুমি স্কুল করে ফিরলে।
মণিদা চলে গেলো। নীচে তাকালাম। কতো বড়ো শহর, কতো মানুষ। এখান থেকে কিছু শোনা যায় না। দেখা যায়, সবাই বোবার মতো হাত পা নাড়ছে। কথা বলার চেষ্টা করছে বলতে পারছে না। চারপাশে কেউ নেই। কাউকে কিছু বলতে পারছি না। বোবা কালার শহর দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাচ্ছে।
বোধ হয় পাঁচটা বেজে গেছে। বাড়ি থেকে এক এক করে মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছে। শহরে মিশে যাচ্ছে। মণিদাকে চিনতে পারছি না। চিৎকার করে ডাকলাম- মণিদা… মণিদা…
সবাইকে মণিদা মনে হচ্ছে। কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সাড়া দিচ্ছে না। চোখ তুলে, বিস্তীর্ণ শহরের দিকে তাকালাম। বোবা কালা শহর। এমন করে কখনও নিজেকে চিনিনি। একা। নিঃসীম একা। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম।