বিপুল মৈত্র

‘ বিদ্রোহী’ কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ তাঁর। কিন্তু সব সফল কবির মননের গভীরে থাকে শিশুর মন, শিশুদের সাথে একাত্ম হয়ে যাবার বাসনা। আর এই বাসনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে শিশুদের জন্য ছড়া, কবিতা, গল্প। আনন্দের মাধ্যমে জানার আগ্রহ জাগায় এই শিশু সাহিত্য। আর শিশু সাহিত্য রচনায় প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট বিভাগটি  পুষ্টতা পেয়েছে অবনীন্দ্রনাথ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায় প্রমুখের রচনায়। ‘ বিদ্রোহী’ কবি হলেও শিশু সাহিত্যের এই জগতে নজরুল ইসলামের বিশেষ অবদান রয়েছে। শিশুসাহিত্য গুলি শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে মূলত সেখানে উপদেশ প্রদানের পরিবর্তে শিশুর ভাষায়, শিশুদের মতো করে সেগুলি লেখা হয়েছে বলে। 

      নজরুল যখন কারো বাড়িতে থেকেছেন তখন সেই বাড়ির শিশুদের সাথে একাত্ম হয়েছেন। নজরুলের’ খুকু ও কাঠবেরালী’ কবিতাটি তেমনি রচিত হয়েছিল কুমিল্লায় কান্দির পারে বিরোজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে তাঁর থাকার সময়ে। কবিতার ছোড়দি, রাঙাদি, রাঙাদা, সকলেই বাস্তব। সেই বাড়ির শিশুদের সাথে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে এই কবিতার রচনা। 

‘ কাঠ বেরালী! কাঠ বেরালী! পেয়ারা তুমি খাও! 

গুড়-মুড়ি খাও! দুধ ভাত খাও! 

বাতাবী লেবু? লাউ? 

বেরাল-বাছা? কুকুর-ছানা? তাও? 

…. …………………. 

কাঠ বেরালী! তুমি আমার ছোড়দি হবে? 

বৌদি হবে? হুঁ

রাঙাদিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! ‘

   রচনায় কোনো কষ্ট কল্পনা বা কৃত্রিমতা নেই। যেন কবি নয়, কোনো এক শিশু আপনমনে কথাগুলি বলছে। 

        আবার’ লিচু চোর ‘ কবিতায় যখন শুনি-

ছোট এক ডাল ধরেছি

ও বাবা মড়াৎ করে

পড়েছি সড়াৎ জোরে! 

পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, 

সে ছিল গাছের আড়েই। 

         কথাগুলি শোনার পর মনে হয় যেন কোনো এক গ্রাম্য ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে তার চুরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে। নজরুল অত্যন্ত সাবলীল ভাবে শিশুমনের উত্তেজনা, কৌতুক তুলে ধরেছেন, যা ছন্দের বৈশিষ্ট্যে অত্যন্ত মনোগ্রাহী হয়েছে। এখানেই নজরুল স্বতন্ত্র। 

একইভাবে নজরুল যখন বাংলাদেশের ব্রাক্ষ্মণ বাঁড়িয়া মহকুমার দৌলতপুর গ্রামে ছিলেন তখন শিশুদের আব্দারে’ ঝিঙেফুল’ কবিতাগুলি লিখেছেন। 

‘ ঝিঙেফুল’ কাব্যগ্রন্থে ‘ প্রভাতী’ কবিতাটি মিষ্টি মধুর ছন্দে ও শব্দে শিশু মনকে দোলা দেয়। 

ভোর হোলো / দোর খোলো

খুকুমনি ওঠরে! 

ঐ ডাকে/ জুঁই-শাখে

ফুলখুকী ছোটদের! 

খুকুমনি ওঠরে! 

রবি মামা/ দেয় হামা

গায়ে রাঙা জামা ঐ, 

দারোয়ান/ গায় গান

শোন ঐ, রামা হৈ! 

…….. ….. 

শিশুমনে গ্রামের পরিবেশে সবুজের সমারোহ, গৃহস্থের আঙিনায় ঝিঙে ফুল, খেতে সর্ষে ফুল প্রভৃতি সব সময় চিত্রিত হয়, কেননা গ্রাম্য শিশু এসব দেখেই বেড়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই শিশু সাহিত্যের দক্ষ কবি নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল ‘ কাব্যগ্রন্থে শিশুমনের কৌতূহল পরিস্ফুট হয়েছে। 

         শিশুমনের বিচিত্র কল্পনা ও আকাঙ্খাকে নজরুল ফুটিয়ে তুলেছেন ‘ সাতভাই চম্পা ‘ কবিতায়। 

সাতভাইয়ের প্রথম ভাই যেন সকাল বেলার ঘুম ভাঙানো পাখী। 

তার ইচ্ছা-

ফুলের বনে ফুল ফোটাব, অন্ধকারে আলো, 

সূর্য মামা বলবে ওঠে ‘ খোকন ছিলে ভালো? 

বলব, ‘ মামা, কথা কওয়ার নাইক সময় আর, 

তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙো ঘুমের দ্বার! ‘

        দ্বিতীয় ভাই গ্রামের রাখাল ছেলে। রাখালী করতে করতে তার চোখে স্বপ্নের বুনোট লক্ষ্য করা যায়। তার স্বপ্ন পৃথিবীর সব অত্যাচার, দুঃখ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর কাজগুলি শেষ করে সন্ধ্যে হলে

সে মায়ের কোলে ফিরে আসবে-

সন্ধ্যা হলে বাজিয়ে বেনু গোঠের ধেনু লয়ে

ফিরব ঘরে মাঠের রাখাল মায়ের দুলাল হয়ে! 

          মায়ের দুলালের মননে শৈশবে এই চিত্র সহজেই আঁকতে পেরেছিলেন বলেই পরবর্তী কালে ‘ সাম্যবাদ ‘ কবিতায় আনাগোনা করতে ঐ দুলালের কৈশোর যৌবন কালে অসুবিধা হয়নি/হয়না। 

তৃতীয় ভাই-

লিখব সবুজ কাব্য আমি , আমি মাঠের কবি

ওপর হতে করবে আশীষ দীপ্ত রাঙা রবি। 

ধরায় ডেকে বলব, ওগো শ্যামল বসুন্ধরা

শস্য দিয়ো আমাদের এবার আঁচল ভরা। 

            তৃতীয় ভাই স্বপ্ন দেখে সে হবে মাঠের কবু, মানুষের কবি। সে স্বপ্ন দেখে সকলের মুখে খাদ্য জোগানোর। 

   আর শৈশব থেকে কৈশোর উত্তীর্ণ যখন দেখে দেশের রাজপথে লাঙ্গলের ফলা নিয়ে কৃষকের জমায়েত সকলের মুখে খাদ্য তোলার দাবিতে- খুব সহজেই যৌবন সাতভাই চম্পার তৃতীয় ভাইতে পৌঁছে যায়। এখানেই নজরুলের শিশু সাহিত্যের অনন্যতা। 

নজরুলের শিশু সাহিত্যে ছড়া, কবিতার সাথে রয়েছে ‘পুতুলের বিয়ে ‘ বালিকাদের অভিনয়োপযোগী নাটিকা। 

        পরিচিতি সত্তার মাধ্যমে বিভাজনের নীতি যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ঘৃণ্য কাজ চলছে তখন ‘ পুতুলের বিয়ে ‘ নাটিকা শিশুদের কেবল নয় সমাজের সকলের তা এখন বাড়ে বাড়ে পাঠের যোগ্য। 

এই নাটিকায় নজরুল কৌতুক রসের সঙ্গে সংহতি ও সম্প্রীতিবোধ জাগিয়ে তুলেছেন। বাল্যকাল থেকে যেন জাতপাতের ঊর্ধ্বে মানুষের পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠে এই বার্তা নজরুল দিয়েছেন এই নাটিকায়। 

এই নাটিকার সংলাপ-

কমলি- না ভাই, ও কথা বলিসনে।বাবা বলেছেন, হিন্দু মুসলমান সমান, অন্য ধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন । ওদের আল্লাও যা, আমাদের ভগবান তা। 

টুলি- সত্যি ভাই, একদেশে জন্ম, এক মায়ের সন্তান। অন্য ধর্ম বলে কি তাকে ঘেন্না করতে হবে? 

উদার মানসিকতা ও সম্প্রীতির মধ্যে শিশুরা যাতে বেড়ে ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই নজরুল এই নাটিকা রচনা করেছেন। 

কেবলমাত্র বিনোদন না, স্বল্প পরিসরে মুসলিম সমাজে অবরোধ প্রথার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন নজরুল। 

যেমন, বেগমের আসতে দেরী হবার কারণ কমলি জানতে চাইলে বেগম বলে, ‘ আব্বা যা বকেন ভাই আমি বাইরে বেরুলে! আম্মাকে বলেন, আমাকে পর্দার ভিতরে বিবি করে রাখতে। ‘। কমলি কথাটা শুনে অবাক, ‘ মা গো মা, কী হবে! আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে? 

বেগম তখন ছড়া কেটে বলে-

মা গো মা, / আমি বিবি হব না! 

আম কুড়াবো জাম কুড়াবো, কুড়াবো শুকনো পাতা, 

সোয়ামী করবে লাঙ্গল-চাষ, আমি ধরব ছাতা। 

              একই রকম শব্দের অনুরণন ‘ সংকল্প’ কবিতায়-

রইব নাক বন্ধ খাচায় দেখব এসব ভুবন ঘুরে

আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-তারায়, সাগর জলে, পাহাড়-চূড়ে, 

               একই সুরে বাঁধা ‘ ছোট হিটলার’ কবিতা। এই কবিতায় নিনি বা অনিরুদ্ধকে ( নজরুলের ছোট ছেলে) উল্লেখ করেছেন-

আমি ছিলুম আর জন্মে

রঘু ডাকাত, নাদির শা, 

যুদ্ধে যাব শুনে মাগো

পাড়ার ছেলের যা ঈর্ষা! 

কোল নাওটা তোমার ‘ নিনি ‘

তোমার নামে আধখানা, 

তোমার ‘ সানি ‘ ( নজরুলের বড়ো ছেলে) যুদ্ধে যাবে

মুখটি করে চাঁদ-পানা! 

        ‘ সানি’ আর ‘ নানি ‘ হিটলার আর মুসোলিনি কে বন্দী করে নিয়ে আসবে। তারপর তাদের কি দশা হবে সে কথা বলেছেন-

আনবো বেঁধে ঐ হেঁসেলে, 

মশলা পিষতে মুসোলিন! 

হাটু ভেঙে আনবো আমার

বিটলে ভাই ঐ হিটলারে, 

উড়ে বামুন করবো তারে, 

দেখো আসছে সোমবারে। 

                 সহজ সরল ভাষায় মুসোলিন, হিটলারের সঙ্গে শিশুমনের পরিচয় এমনভাবে করিয়ে দিয়েছেন যে তারা সমাজের পক্ষে ভালো মানুষ নন এমন ধারণা শৈশব থেকেই তৈরি হয়ে যায়- এখানেই শিশুসাহিত্যে নজরুলের মুন্সিয়ানা। 

           নজরুলের শিশুসাহিত্য শিশুদের আনন্দ দানের সাথে সাথে অনুশীলিত মনন গঠনের এক অনবদ্য আকর।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *