সঞ্জীব চক্রবর্ত্তী

কৈশোরের কিছুটায় তখন জলপাইগুড়িতে ছিলাম। সে সময়টায় ছোটদের গল্পের বই পড়ার নেশা ছিল রীতিমত সামাজিক সমস্যা। গোগ্রাসে আনন্দমেলা গিলতে গিলতে হটাৎ নজরে এলো এক নতুন পাবলিক, রীতিমত গোয়েন্দা মনে হচ্ছে। শার্লক হোমস, ব্যোমকেশ, ফেলুদার মার্কেটে এ বাপু আবার রীতিমত পাড়ার লোক দেখছি। বনবাদারের উত্তরবঙ্গ যেখানে খবরের কাগজ পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র দুদিন অর্থাৎ বিয়ের খবর পাওয়া যায় অন্নপ্রাসনের দিন সেখানে গল্পের নায়ক নতুন গোয়েন্দা ‘অর্জুন’ থাকে এক্কেবারে জলপাইগুড়ি শহরে। হেব্বি খুশি হয়েছিলাম উত্তরবঙ্গবাসী হিসাবে। বেগুন্টারী দিয়ে অর্জুনের বিচরণ, ডিবিসি রোড ধরে সন্দেহভাজনের পিছু নেওয়া, কদমতলায় বসে চা খাওয়া …. এতো ঠিক আমারই মত। নিজেই কখন অর্জুন হয়ে গেলাম জানি না, শুধু এটুকু জানতাম যে সাহিত্যের জগতে অর্জুন আমার প্রতিনিধি, উত্তরবঙ্গের মত এক প্রান্তিক অঞ্চলের বিস্মৃত বাসিন্দা। সমরেশ জীবনে প্রবেশ করলেন।

এরপর এলো সদ্য যৌবনের জোরকা ঝটকা … গর্ভধারিনী। সমাজ নিয়ে প্রথম সিরিয়াসলি ভাবতে শিখলাম। শুধু নিজে নয়, জগৎ নিয়ে ভাবার এই প্রয়োজনও বোধ হল। শেষটা একটু ফিল্মি লেগেছে বটে তবে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ততক্ষনে মজ্জায় ঢুকে গেছে। চোয়াল শক্ত হতে শুরু করেছে সুদীপ, কল্যাণদের মত। প্রতিষ্ঠাকে ফু দিতে শিখে গিয়েছি জয়িতার মত। আমিও তখন প্ল্যান ভাজছি বিপ্লবের সোমরসের আহ্বানে।

মাথায় চলা তুমুল আলোড়নের মধ্যেই হটাৎ সন্ধান পেলাম বন্ধু অনির। কালবেলায় কখন কালপুরুষ এসে উত্তরাধিকার বানিয়ে গেল তা টেরও পেলাম না। পাড়ার মুদি ওজনে মারলে, স্কুলের স্যার নিজের টিউশনের ছাত্রকে বাড়তি খাতির করলে, সিনেমার হলে লাইন ডিঙিয়ে কেউ টিকিট কাটতে গেলে বেশ বুঝতে পারছি অনি এসে গেছে।

কলেজ জীবনের উত্তাল সময়, নব তরঙ্গ আর নব জোয়ারে যখন জীবন নিয়ন্ত্রণহীন, আবেগের সেই চরম কালে হটাৎ প্রেমে পড়লাম দীপার। ছোট্ট দীপার গঞ্জ থেকে একের পর এক বিঘ্ন এড়িয়ে বিজয়ী হওয়ার সাতকাহন বোঝাল নারী কেমন হতে পারে। কলেজের আনাচে কানাচে, বিয়ে বাড়ির ভিড়ে, দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের শালীর মাঝে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম অত্যন্ত আত্মসন্মানসম্পন্ন, আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, কঠোর, সফল, মমতাময়ী সেই দীপাকেই। সমরেশ ভালবাসা বেছে দিয়ে গেল।

বছর তিনেক আগে শিলিগুড়ি বই মেলায় কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের সাথে। সামনে দাঁড়িয়ে যতটা বলেছি তার চেয়েও বেশি বলেছি মনেমনে কারন সম্পর্কটা যে মনের, মুখে বলা যায় না। বয়স হয়েছে, সমরেশবাবু যাবেন জানতাম কিন্তু এটাও ঠিক অর্জুন, অনি, দীপা, সুদীপ, জয়িতারা আজ বইয়ের পাতা ছেড়ে আমাদের মাধ্যমে সারা সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজও সেই সুদীপ-দীপারাই মাঝ রাতে আমাকে দিয়ে সমাজ সংক্রান্ত পোস্ট লেখায় ফেসবুকে। কালপুরুষের উত্তরাধিকারের সম রেশ যে রয়ে যায়।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *