রবি আড্ডায় অনির্বাণ ঘোষ
নূরনাহার বেগম আর সমিজা বেওয়াতে কোন ফারাক নেই। ভাঙা টালির চাল মাটির দাওয়াওয়ালা তাদের বাড়ি দুটি একে অপরকে পিঠ দেখিয়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা খাড়া থাকলেও অসমবয়সী এই দুই মেয়েমানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেশ চোখে পড়ার মতো। সমিজার ভাতার মরেছিল সদর হাসপাতালে বছর সাতেক আগে। বুকের দোষ আর ঘুসঘুসে জ্বর নিয়ে যুঝেছিল বেশ ক’দিন। তারপর আর টানতে পারে নি। আর নূরনাহারের মরদ সাদেক আলি আজ ঘর ছাড়া বেশ কয় বছর। হ্যাঁ, তা বছর পাঁচেক তো লাপতা। যে বার পরপর দুই মরশুম সুখা গেল, সেই বারই সে পাড়ি দিয়েছিল ভিন মুলুকে। দক্ষিণের কোন রাজ্যে। নাম জানে না নূরনাহার। আর রাজ্য, দেশ, জেলা, উপজেলার গণ্ডিও বোঝে না। বোঝে শুধু তার জন্মস্থান, বাপের ভিটা সাতভিটা আর তার সুসুরঘর বড়ভিল্লা। আর সদর শহর বড়ভিল্লা থেকে ১৫ কিমি দূরে হলেও নূরনাহারের কাছে তা ভিনদেশ। একবার ঈদের পর সাদেকের সাথে গিয়েছিল সলমনের বই দেখতে। রাস্তা পেরোতে, পথ চলতে, সিনেমা হলে ঢুকতে-বেরোতে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতি। সাদেক হাত ধরে টেনে পার করিয়েছিল রাস্তা। তাতেও দু-একটা গাড়ি গায়ের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ার যোগাড়।
সেই সাদেক আর যোগাযোগ রাখে না। প্রথম প্রথম ফোন করতো। বাসস্ট্যান্ডে টঙ্ক ডাগদারের দাওয়ার দোকান। টঙ্কর দোকানের ছেলে রজ্জাক সাইকেল মেরে খবর দিয়ে যেত – কাকি তর ফুন্ আছে সাদেকের। দোফর তিনটায় যাবার কছে।
ফোন পিছু ২০ টাকা নিতো ডাগদার। এরপর একটা মুবাইলও কিনে দিয়েছিল সাদেক। রাতের দিকে ঘুম ভাঙাত ওরই সেট করা রিংটোনে –
ম্যায় সে না মীনা সে না সাকিসে, না প্যায়মানেসে
দিল ব্যাহেলতা হ্যায় মেরা, আপকে আজানেসে…
ফোনের মধ্যে ফিসফিসিয়ে রসের কথা বলত আর খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতো। নূরের মনে হতো মুবাইলের মধ্যে দিয়ে সাদেকের মুখের ১০০ জর্দার মেহেক ভেসে আসছে। এবার ঈদ এলে পাঁচ বছর হবে সাদেক লাপতা। ফোন করলে আগে বাজতও কদিন। ইনলিস্ আর ভিনভাষায় আন্দাগুন্দা কিসব বলতো সুরেলা গলায়। নূর বুঝতে পারতো না। বেশ ক’বছর হল ফোনই বাজে না। পাশের মোহনপুরের সাজ্জাত একই সাথে গেছিল কাজ করতে। একই ঠিকাদারের কাছে। একই দালাল ধরে। শেষ যখন ওর খরিয়ত পুঁছতে গেল, তখন সাজ্জাত বলে সাদেক কাজ ছেড়ে অন্য ‘সাইডে’ চলে গিয়েছে। নূরনাহারের আর সব প্রশ্নের ভাসা ভাসা উত্তর দিয়েছিল সাজ্জাত। সাদেকের ফেরার যেটুকু আশা নূরের বুকে বাসা বেঁধেছিল কুরে কুরে খাওয়া ঘুণপোকার মত, তাও সেবার সাকিনহারা হল।
তোলা উনুনে আলুভাজি করছিল নূর। তার তিন মেয়ে সোনাডাঙ্গির মাঠ পেরিয়ে এখন নবাবগঞ্জ হাইস্কুলে। কালকের বাসি ভাত লবণ হলুদ আর কাঁচা পিঁয়াজ ও মরিচ মেখে খেয়ে গেছে। বিকালে বাড়ি ফিরে চারটি ভাত ভাজি দিয়ে খাবে। মাসদুয়েক হল বন্ধ মিড-ডে মিল। রাঁধুনি নিয়ে কি যেন লাফরা। এক আঁটি কলমি নিয়ে ঢোকে সমিজা। বলে – সাগটি রেন্ধে ছেল্যেপিল্যারঘে দিস্। নূর তার পাশে আসন পেতে দেয়। বিড়ির মশলার গন্ধ ছাপিয়ে আলুভাজির জায়কা । নূর এক সানকি মুড়ি ঢেলে তাতে আলুভাজি দেয় কতক। তারপর দুই মেয়েমানুষ মুঠি মুঠি তুলে নেয় জীবনের রসদ। মুখের লালায় তা জারিত হয় আর জড়িয়ে যায় দুইজনের দুঃখসুখের যাপনমালা।
এ কাহিনী বড়ভিল্লার ঘর ঘর কি কাহানি। হর ঘর কি কাহানি। গোটা গাঁ ঢুঁরে ফেললেও মিলবে না সোমত্থ মানুষের দেখা। ঘাটে মাঠে বাটে যারা কাজ করে তারা মেয়েমানুষ। গাঁয়ের ৪৩টি পরিবারের কোনটিতেই পুরুষমানুষ থাকে না। কাজের খোঁজে তারা নরম মাটির মায়া ত্যাগ করেছে, নতুন ধানের মাদক গন্ধ ভুলেছে। পাড়ি জমিয়েছে ভিন রাজ্যে। অজানার টানে, অচেনার আমন্ত্রণে। ঘরের নৈর্ব্যক্তিক অনিশ্চয়তা তাকে ঠেলে দিয়েছে। নরম নারীর পরম নির্ভরতা তাদের আগলে রাখতে পারে নি। মূলতঃ কৃষিজীবী এই পরিবারগুলির মরদরা কিছুটা নিশ্চিন্তির জন্য মাটির অমোঘ টান উপেক্ষা করে আজ কেউবা কেরলের নির্মাণ শ্রমিক, কেউবা মুম্বইয়ের শহরতলির নির্মীয়মান বহুতলের রাজমিস্ত্রি, পুনের হাইরাইজের বিশ্বস্ত ওয়াচম্যান বা ওড়িশা বা অসমের ট্রাক ড্রাইভার বা বাসের খালাসি। আর একবার গাঁয়ের গন্ডি পেরোলে গাঁয়ের টান কমে যায়। যা থাকে তা দায়বদ্ধতা। পরিবারের প্রতি, ছেলেমেয়ের প্রতি। আর সেটুকু ঝেড়ে ফেলতে কতক্ষণ। বিশেষতঃ যদি নতুন জায়গায় নতুন পরিবার পেতে বসা যায়। আর হয়ও তাই। প্রথম প্রথম যোগাযোগ থাকে। মাসে, দুমাসে টাকা আসে। হাতে হাতে বা ব্যাঙ্কের খাতায়। বছরে এক-আধবার পরিযায়ী পাখির মত ঘরেও ফেরে। ভিনদেশের বোলচাল, রং ঢং মেখে। নিজের মাটি ও মানুষকে জরিপ করে নেয় ভিনদেশি মাপকাঠিতে। তারপর আবার উড়ে যায়। এভাবে যাওয়া-আসার খেলা চলে কয়েক বছর। তারপর মাস গড়ায়, বছর গড়ায়। ফোনকলের ব্যবধান বাড়ে। এবং শেষে মুঠোফোন সুইচড অফ ও মনের মানুষ উদ্বায়ী – মুঠোর বাইরে। লাপাতা নগরের বাসিন্দা। যেটুকু তত্ত্বতালাশ চলে তাতে নাগাল মেলে না এই স্বনির্বাচিত লিপাত্তাদের। আর বাড়ির ছেলেপুলেরা গোঁফের রোঁয়া উঠতে না উঠতে গ্রামের বাইরে। লাগোয়া গঞ্জে আস্তানা গাড়ে। দোকান-গ্যারেজ-হোটেলে কাজ খুঁজে নেয়। মাস গেলে কিছুটা পায়। সাথে খোরাকি। কিছু টাকা গাঁয়ের বাড়িতেও পাঠায়। পরে সেটা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। গাঁয়ের ৪৩ পরিবারের ৪২ টির একই দশা।
সমিজার বাড়ি থেকে রাস্তা পেরিয়ে পুরনো বটের কোলে অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার। সেখানে বটের ঝুরিতে দোল খেয়ে বেড়ে ওঠে গাঁয়ের তামাম ছুঁয়াছুঁয়ির দল। আর অঙ্গনওয়াড়ির গাঁ ঘেঁষে দোলতীর দরমার দোকান। বাড়ি আর দোকান একচালার নীচে। ঘরের কাজ আর দোকানদারি একসাথেই চালায় দোলতী। দুপুরে ঘাটে গেলে দোকানে মাছি তাড়ায় ওর বছর সাতেকে স্কুলছুট ছেলে টিহাকু। মরদ ওর কেরল গেছিল। বছর তিনেক নিখোঁজ। ছুঁয়াটার কথাও কি মনে পড়ে না – মাঝে মাঝে ভাবে দোলতী। জমানো পয়সায় দোকানটা খুলেছিল বলে। নাহলে তো মায়ে-ছুঁয়ায় না খেয়ে মরতে হত।
পীরপুকুরের বাঁশঝাড়ের কাছে অপেক্ষাকৃত নির্জন ঘাটে চান করছিল। তিন মেয়েমানুষ। ত্যজ্য, পরিত্যক্ত কিন্তু শিশ্ন-সটান। সুঠাম, দৃঢ়। অকর্ষিত, অমথিত নাবাল জমির মত। রুখোশুখো। লাবণ্যহীন শরীরে কিছুটা লালিত্য ফিরে এসেছে জলের কাছাকাছি এসে। ঘাটের বড় পাথরটার ওপর বসে সুডৌল পায়ের গোছ ডুবিয়ে বিষণ্ন ভাঙা সুরে গাইছে সমিজা –
“কালো বলের কালো পাখা
কালো বলের গাড়ি
গাড়ি বাহিতে যেচ্ছো রাজা
ছয়ো মাসের আঢ়ে আরে কে।
অত ভাবনা আমার রানি
ফিরে আসবো বাড়ি
তোমার ল্যাইগ্যে আনবো রানি
কেঞ্চন পাটের শাড়ি
আ আ রে কে।
চালোও দিলাম ড্যালোও দিলাম
আরও দিলাম হাড়ি
নদীর কিনরায় র্যান্ধে খায়ো
মনো রাখিও বাড়ি আরে কে।”
সমিজার গানের পাখ গজায়। তার সুর ঘাট ছাড়ায়, মাঠ ছাড়ায়, পথের পাশের ফাঁকা হাটচালার বাঁশের মাচায় শরীর এলিয়ে বসা চুড়িওয়ালার কানে যায়। চুড়িওয়ালা স্বপনের ঘোর ঘনায়। মনে তীব্র মাদকতা জাগে। মরা ইউক্যালিপটাসের গায়ে হেলান দেওয়া চুড়িবোঝাই লড়ঝড়ে সাইকেল নিয়ে বুড়ির গালের মতো তোবড়ানো রাস্তায় ঠোকর খেতে খেতে সুরের সন্ধানে নিপুণ এগোয়। তার চুড়ির ডালার কোথাও চুড়ি চুড়ি ঠোকা লেগে রিনরিন শব্দ সমিজার সুরের সাথে যোগ্য সঙ্গত করে। জলতরঙ্গ বাজে সাইকেলের স্প্রিং কাটা বেলে।
খানিক পর ঘাটের কাছে চুড়ির ডালা নিয়ে স্বপন দাঁড়ায়। ঘাটের পাড়ে তিন ডানাওয়ালা মেয়েমানুষ। তীব্র বর্ষণে সিক্ত মাটির মতই মাখোমাখো অথচ পিচ্ছিল লাগে তাদের। চুড়ি নেবে গো – বলে হাঁক পাড়ে সে। হাতে তার রংবেরং এর চুড়ি। পড়ন্ত বিকেলের রোদে তারা রঙের ছটা ছড়ায়। চোখ ধাঁধানো রঙিন ঝলকে হেসে ওঠে তিন মেয়েমানুষ। দোলতীর পড়ে যাওয়া দাঁতের ফাঁকে অতলান্তের আহ্বান। মুখ খোলে সমিজা – লিতে পারি যদি পানিতে নামো।
“হক কথা”, বলে নূর। দোলতীও সায় দেয়।
এই গানে,এই বিষণ্ন সুরে দোলতী ও নূর একাত্ম হয়ে যায়। পুকুরের জলে মাঝ বরাবর প্রায় পাশাপাশি চিৎ হয়ে ভেসে আছে নূর আর দোলতী। তাদের উপোষী মুখ ও উত্থিত বুক জল ফুঁড়ে আকাশছোঁয়ার প্রত্যাশী। শুধু অভাব দুজোড়া ডানার। কালো জলে তাদের পা ছপছপ থেমে থাকা সময়ের কাঁটা সচল করে। রচিত হয় এক মায়াময় দৃশ্যের। সুরের টানে ঘাটে ভেসে আসে নূর ও দোলতী। দোলতীর গায়ে সাবুন ঘষে দেয় নূর। পরম ভালোলাগায়। নূরের স্পর্শে কেঁপে কেঁপে ওঠে দোলতী। গায়ে কাঁটা দেয়। ভেতরে তার অঝোর শ্রাবণ। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। বিগত দাম্পত্যজনিত কলহের জেরে পড়ে যাওয়া দাঁতের জায়গায় শূন্যতা দেখা যায়। সুরের অভিঘাতে আরো ঘন হয়ে আসে তিন নারী। নূরের ছিপছেপে, দোলতীর ঢলঢলে আর সমিজার বছর বিয়ানো পৃথুল শরীর হাল্কা হয়ে আসে। ভূমিজ টান মুক্ত হতে থাকে। ধীরে ধীরে ডানাপ্রাপ্ত হয়।
রঙিন চুড়ি ধরা হাতে জলে নামে স্বপন। তাকে ঘিরে ধরে তিন হুরপরি। ভাসতে ভাসতে মাঝপুকুরে ডুব জলে চলে যায়। স্বপন ঘিরে চলতে থাকে তিন পরির জলকেলি। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী জল তাদের সমস্ত নগ্নতা ঢেকে নেয়।
(বহুস্বর পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত)