রবি আড্ডায় ভাস্কর দাস


দুর্গা পুজোর ছুটিতেও ছুটি নেই। মাত্র চার দিনের ছুটি। তাও ম্যানেজ করতে হলো। প্রিন্সিপাল স্যারকে কে বহুবার অনুরোধ করেও ছুটি বাড়ানো গেল না।
অজ্ঞতা লক্ষ্মী পূজার দিনেই বের হয়ে পড়লাম ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

দার্জিলিং মোড় থেকে বিকেল চার টেয় ব্লু হিলস ট্রাভেলসের বাস। শিলিগুড়ি থেকে গৌহাটি । তারপরে টেক্সিতে চেপে শিলং।

বাসে জানলার ধারেই সিট বুকিং করা ছিল। পাশের সিটটা ফাঁকাই ছিল। এখনো হাতে কিছুটা সময় রয়েছে। প্যাসেঞ্জাররা ধীরে ধীরেই উঠছে। হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি মেয়ে আমার সিটের পাশে এসে বাঙ্কারে লাগেজ তুলে রাখলো। বুঝতে একটু দেরি হলো না আমার সহযাত্রী। পরনে জিন্স ও শার্ট। চুলগুলো খোলা। চেহারার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ।

নিজেকে কিছুটা সংযত করে সরে বসলাম। ” এক্সকিউজ মি ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড মে আই সিট দিয়ার?” মেয়েটি বিনম্র সহকারে অনুরোধ করলো। আমি মৃদু হেসে জায়গা ছেড়ে উঠে পড়লাম। “ও থ্যাংক ইউ” বলে জানলার পাশে বসে পড়ল।
এখন গাড়ি ছাড়ার পালা। শহরের ব্যস্ত কোলাহল থেকে বাসটি ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো।

পূজোর দিনগুলো উপভোগ করতে না করতেই শেষ হয়ে যায়। বন্ধুবান্ধবদের সাথে চুটিয়ে মজা করলাম। দশমীর দিন তো মহানন্দা নদীতে গিয়ে সারাদিন স্নান করেছিলাম। দিনটা ছোট হয়ে গেছে। এখনই সন্ধ্যা নেমে আসবে। জানালা দিয়ে হিমেল হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছে। পূব আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ পরিবেশটাকে আলোয় ভরে দিবে। দূরের ধান ক্ষেত, আম বাগান, গ্রাম স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

সারা রাতের জার্নি। অজ্ঞতা সময় কাটানোর জন্য হাতে বই নিয়ে বসলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্প । বাসের ভেতরে বেশ সহযাত্রীদের বাক্যালাপ কানে ভেসে আসছিল। বেশির ভাগই বাঙালি। তবে বেশ কিছু নেপালি এবং অসমীয়া রয়েছেন।

হঠাৎ লক্ষ করলাম মেয়েটি বেশ কয়েকবার আমার এবং বইটার দিকে তাকালো। হয়তো কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইছে। আমি কিছুটা কৌতুক হয়ে বললাম, “Are you comfortable? “

“ও ইয়েস।
আই থিঙ্ক ইউ আর এ স্টুডেন্ট?” বেঙ্গলি? “

আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “ইয়েস। আই এম এ ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট। বেঙ্গলি।”

শুরু হলো বার্তালাপ । জানতে পারলাম সে কার্শিয়াং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ে। ফিজিক্সে অনার্স। সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। বাড়ি গৌহাটি। বাবা বাঙালি।ব্যাংকের ম্যানেজার। মা নেপালি ব্রাহ্মণ।হাউস ওয়াইফ। নাম পূর্ণিমা গোস্বামী। কার্শিয়াং এ মামাবাড়ি। সেখানে কয়েকদিন থেকে বাড়ি ফিরছে।

“সো ইউ কেন ফলো বেঙ্গলি? “

” ইয়েস আই কেন। আই ক্যান স্পিক বেঙ্গলী। কিন্তু আমি বাংলা লিখতে এবং পড়তে পারিনা। “

মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, যাক সারা রাস্তায় ইংরেজিতে কথা বলতে হবে না। মেয়েটি কথা শুনে হাসতে লাগলো।
জানতে পারলাম, মেয়েটির বাবা সিলেট থেকে আসামে এসেছে দাদুর হাত ধরে। দাদুর ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ সুনাম ছিল গৌহাটি শহরে।

কখন গাড়ি কুচবিহার এসে পৌছালো, বুঝতে পারেনি। রাত নটা বাজে। এখন যাত্রীদের খাওয়ার পালা। সবাই একে একে নামতে শুরু করলো। জেঠিমা আমার জন্য রুটি তরকারি ও মিষ্টি টিফিন কেয়ারে দিয়েছিল। নিচে নেমে হাত ধুয়ে এলাম এবং ব্যাগ খুলতে লাগলাম। পূর্ণিমা পাউরুটি কলা ও ডিম টোস্ট নিয়ে এলো।
পাশের ফাঁকা সিটে বসে পড়লো। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠলো। দেখতে পেলাম, খাবার প্যাকেটটি মাটিতে পড়ে আছে। একটি টিকটিকি দৌড়ে পালালো। বুঝতে পারলাম, খাবার প্যাকেটটি খুলে খেতে যাবে ঠিক তখনই একটি টিকটিকি খাবারের উপরে পড়ে গেছে।

আমি পাশে গিয়ে বললাম, ” আর খাবার কিনতে হবে না। আমার কাছে যথেষ্ট রুটি আছে। তুমি শেয়ার করতে পারো।” প্রথমে কিছুটা সংকোচ বোধ করছিল। কিন্তু না করেনি।

টিফিন কেয়ারটি আমি ওর হাতে দিয়ে বললাম, “ধরো, আমি নিচে থেকে একটা পেপার নিয়ে আসি “।

দুজনে শেয়ার করে খেতে লাগলাম।
” ইস কি সুন্দর রান্না ? আমার মা কিন্তু ভালো বাঙালি রান্না পারে না? আমার বাবার এই অভিযোগ ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। বাবা সব সময় বলে, আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে দেখতে তাহলে বুঝতে পারতে রান্না কাকে বলে… “
কথাগুলো হাসতে হাসতে বলতে লাগলো।

দেখতে পেলাম, প্যাসেঞ্জাররা সবাই ধীরে ধীরে বাসে উঠছে। আমরাও তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

” ইস, আপনি না থাকলে আমার আজকে খাওয়াটা হতো না…. “
আমি কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসলাম।

বাসের আলো নিভিয়ে দিয়েছে। পূর্ণিমা চাঁদের আলোতে বাসের ভেতরটা স্পষ্ট। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বাইরে ঝিঝিঁ পোকার আওয়াজগুলো কানে ভেসে আসছে। শীত আসছে। বুঝতে পারলাম, বাস বেশ জোরে ছুটছে। ছাগুলিয়া চেকপোস্ট পার করলো। আসামে প্রবেশ করল। দেখলাম, সে বাঁ দিকে জানালার ধারে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে… হয়তো বাইরের দৃশ্যটা উপভোগ করছে….

প্রথমবার যখন শিলং এসেছিলাম, তখন দাদার সাথে প্রথমে এনজিপি থেকে গোহাটি। তারপরে ট্যাক্সি চেপে শিলং। জার্নিটা ভীষণ বোরিং ছিল। বাসের জার্নি আমার বরাবরই পছন্দের।

অতীতের কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন লাগছিল। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, সে তার মাথা আমার বাম হাতে ভর দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । কিছুটা ভয়, কিছুটা আনন্দ। চুলগুলো মাঝেমধ্যেই মুখে এসে পড়ছে। নিজেকে সেই ব্রাউনিং এর “দ্য লাস্ট রাইট টুগেদার” এর লাভারের মতো মনে হতে লাগলো। এত নিষ্পাপ মুখ কোনদিন দেখিনি।
নাক ছাবিটা ভীষণ চকচকে। বিস্তৃত কপালে ছোট্ট টিপ। গায়ের মিষ্টি গন্ধটা শিউলি ফুলের গন্ধ কে অনায়াসে ছাপিয়ে যেতে পারে। পূর্ণিমার চাঁদ ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে.. ….

হঠাৎ যাত্রীদের কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ভোর হয়ে এসেছে। আকাশের পূর্ণিমার চাঁদ ভোরের আলোতে বিবর্ণ চেহারা নিয়েছে। পাশে দেখতে পেলাম, পূর্ণিমা ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছে। চোখাচোখি হতেই, কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপচাপ থাকার পরে, মৃদুস্বরে বললো ” জানিনা আর কোনদিন দেখা হবে কিনা? তবে স্মৃতিগুলো উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। “

গাড়ি থেমে গেল। পূর্ণিমা বাস থেকে নেমে পড়ল। দেখতে পেলাম, রিকশাতে লাগেজ উঠিয়ে বসে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে, হাতের ইশারায় বিদায় দিতে লাগলো। ইতিমধ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে পূর্ণিমার মুখখানি ফ্যাকাসে
হতে শুরু করলো ……….

“রাতের সব তারাই আছে

              দিনের আলোর গভীরে। “

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *