রবি আড্ডায় ভাস্কর দাস
ক্লাস টুয়েলভ এর রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে। এবার ভর্তি নেওয়ার পালা। এখনো কলেজগুলোতে ফরম দেওয়া শুরু হয়নি। তাই অবসর সময়ে লাইব্রেরী থেকে গল্প বই এনে পড়ার নেশাটা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র, বুদ্ধদেব গুহ, দিব্যেন্দু পালিতের মত সাহিত্যিকদের লেখা আমার বিছানার সঙ্গী ।
সে তখন ক্লাস টেনের ছাত্রী। অবিনাশ কাকুর মেয়ে। পাশের কোয়ার্টারেই থাকেন। ছুটির দিনগুলোতে মায়ের বিশেষ সঙ্গিনী। ‘লিপি’ ডাক পেলেই দৌড়ে ছুটে আছে। ছোটবেলা থেকে পুঁতি নিয়ে খেলার খুব শখ। এখন আবার পুঁতি দিয়ে ব্যাগ সেলাই করতে শিখেছে। মাকে কথা দিয়েছে পহেলা বৈশাখে একটি নতুন পুঁতির ব্যাগ উপহার দিবে।
” জেঠিমা তোমার ছেলে ঘরে বসে থাকে কেন? সারাদিন বইয়ের মাঝখানে মুখ বুজে থাকে। বোকা ঝোকা দিতে পারো না? ‘
” কি জানি বাবু তোদের জেনারেশনের ছেলে মেয়েদের সাইকোলজি বোঝা মুশকিল। আর কটা দিন তারপরে কলকাতা চলে যাবে….. তুইও ভালো করে পড়াশোনা কর তোর জন্য রাজপুত্রের মত বর এনে দেবো…”
কথাগুলো শুনে লিপির মাথায় বাজ পড়ল। সেই হাসি মুখ খানি হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকলো….
পাশের ঘর থেকে একবার সে দোয়ার পর্যন্ত এল। আবার সে ফিরে গেল। আবার একবার সে বাইরে এসে দাঁড়ালো। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। যে মেয়েটির পায়ের নুপুর কোয়াটার গুলিকে ছন্দময় করে তুলে, আজ সেই নুপুরগুলো বোবা। পাতলা ছিপ ছিপে শরীর নিয়ে যে মেয়েটি পেয়ারা গাছ, আম গাছ, ফুলের বাগান দাপিয়ে বেড়ায়, আজ বড়ই ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।
” কি হয়েছে তোর? কিছু বলবি? “
কথার কোন উত্তর দিল না। মুখ ভার করে, খাটের খুঁটিটাকে স্বর্ণলতা গাছের মতো জড়িয়ে রয়েছে। সাহস করে কিছুটা পাশে এসে দাঁড়ালো। কোনদিনই আমার চোখের দিকে তাকানোর ওর সাহস হয়নি। সেদিন প্রথম বার সাহস করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ” তুমি কালকে কলকাতা চলে যাচ্ছো, তাই না ? “
তাকিয়ে দেখলাম চোখগুলো জলের পুঁতি দিয়ে ভরা। সে পু্ঁতির মধ্যে লেখা অব্যক্ত ভাষা…. যেটা সে কোনদিনই সাহস করে বলতে পারবে না…
হ্যাঁ কাল বিকেল বেলা আমার ট্রেন। ভেবেছি কলকাতাতেই ভর্তি নিব… কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই, আমার হাতে কয়েকটি পুঁতি ধরিয়ে দিয়ে বলল ” যখন আমার কথা মনে পড়বে, এই পুঁতিগুলো তোমার সাথে কথা বলবে…. “
আজও তাঁর দেওয়া পুঁতিগুলো নিঃশব্দে অনেক ব্যথা ব্যক্ত করে….
” For in silence I find no rejection, I choose to love you in loneliness…”