
রবি আড্ডায় শর্মিষ্ঠা কুণ্ডু
ভোরের আকাশ তখনও আধো অন্ধকারে ঢেকে আছে। কাশফুলের সাদা ঢেউ হালকা বাতাসে দুলছে। কুলিকের ঘাটে ভিড় জমেছে—মহালয়ার দিনে পিতৃতর্পণ। হাতে কুশা, কলাপাতা, ফল আর গঙ্গাজল নিয়ে মানুষ বসে পড়েছে। মন্ত্রপাঠের সুর ভেসে আসছে চারপাশে।
হরিদাস কাঁপা হাতে অরুণকে বললেন—
— “চল বাবা, আজও যেমন সব বছর করেছি, তেমন করেই পিতৃদের তর্পণ দিতে হবে। মহালয়া মানেই তো তাদের স্মরণ।”
অরুণ মাথা নেড়ে রাজি হলো। পাশে দাঁড়ানো অর্কর একটু অস্থির, হাতে তার মোবাইল, তবু সে কুলিকের জলে নামল দাদু আর বাবার সঙ্গে। তিন প্রজন্ম একই সারিতে বসে গেল।
ঘাটের ওপারে ভেসে আসছে পরিচিত সুর। কোথা থেকে যেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ট্রানজিস্টর চালিয়ে বসেছেন। খচখচ শব্দ ভেদ করে গম্ভীর কণ্ঠ—
— “নমঃ চণ্ডিকায়…”
হরিদাসের চোখ ভিজে উঠল। তিনি বললেন—
— “শুনছিস অরুণ ভদ্রবাবুর কণ্ঠ ছাড়া মহালয়া হয় না।সেই আমেজটা পাই না রে বাবা। এই কণ্ঠেই তো আমাদের পিতৃদের ডাকি, দেবীকে আহ্বান করি।”
অরুণ চুপ করে রইল। তার মনে টান পড়ছে, কারণ সে জানে ঘরে টিভিতে এখনই শুরু হয়ে গেছে মহালয়ার বর্ণিল অনুষ্ঠান।
অর্ক একটু দ্বিধায় বলল—
— “দাদু, ওই কণ্ঠই তো ইউটিউবেও আছে। তবে জানো, আজকে টিভিতে দেবী মহিষাসুরকে বধ করছেন। আলো ঝলকানি, গান, যুদ্ধের দৃশ্য—সব চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।”
হরিদাস হেসে ফেললেন।
— “চোখের সামনে! কিন্তু আমার চোখের সামনে তো ভদ্রবাবুর কণ্ঠ শুনলেই মা নেমে আসেন। তোর পর্দার দেবী আর আমার মনের দেবীর মধ্যে ফারাক আছে, রে।”
অরুণ তখন বলল—
— “বাবা, আজকের ছেলেমেয়েরা ছবি না দেখলে ভক্তি টিকবে কী করে? শুধু শোনায় তাদের মন ভরে না।”
হরিদাস ধীরে ধীরে তর্পণের জল ঢাললেন গঙ্গায়।
— “শোনো অরুণ, ভক্তির জায়গা ভক্তিই। বিনোদনের আড়ালে যদি ভক্তি চাপা পড়ে যায়, তবে মহালয়ার আসল মানে হারাবে।”
পিতৃতর্পণ শেষ হলো। তিনজন একসাথে বাড়ি ফিরল।
কুলিকপাড় থেকে ঘরে ফিরে টিভি অন করা হলো। পর্দায় দেবী মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। আলো ঝলকানি, সঙ্গীত, নৃত্য—সব মিলিয়ে ঘর ভরে উঠল উৎসবের আবহে।
হরিদাসের চোখ কিন্তু চলে গেল পুরোনো ট্রানজিস্টরের দিকে। ধুলো জমে আছে, তবু কাজ করছে। তিনি সেটি অন করলেন। খচখচ শব্দ কাটিয়ে আবার ভেসে এল সেই অমোঘ কণ্ঠ—
— “আশ্চর্য রূপমাশ্রিতম্…”
অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে গেল দুটি জগৎ। টিভির পর্দায় দেবী যখন মহিষাসুরকে বধ করছেন, তখন ট্রানজিস্টর থেকে ভেসে উঠল ভদ্রবাবুর গম্ভীর শ্লোকপাঠ। মনে হলো, দেবী যেন সত্যিই নেমে এসেছেন ঘরে।
অর্ক থমকে গেল। হাতে ধরা মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল অজান্তেই। অরুণও বিস্ময়ে টিভি আর ট্রানজিস্টরের দিকে তাকিয়ে রইল।
হরিদাস ধূপ জ্বালিয়ে প্রণাম করলেন।
— “দেখলি তো? যুগ পাল্টায়, রূপ পাল্টায়, কিন্তু দেবীর আহ্বান চিরকাল এক থাকে। পিতৃদের তর্পণ যেমন পুরোনো প্রথা, তেমনি ভদ্রবাবুর কণ্ঠও অমোঘ প্রথা। আর তোমাদের টিভি সেই আহ্বানকে নতুন রূপ দেয়। সবকিছু মিলে তবে মহালয়া পূর্ণ হয়।”
তিন প্রজন্ম একসাথে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল। ধূপের ধোঁয়া ভেসে মিলল সকালের আলোয়, টিভির গান মিশে গেল ভদ্রবাবুর কণ্ঠে।
অর্ক ফিসফিস করে বলল—
— “দাদু, আজ বুঝলাম… মহালয়া কখনো পুরোনো হয় না, সে শুধু রূপ পাল্টে বাঁচে।”
হরিদাস নরম গলায় উত্তর দিলেন—
— “ঠিক তাই, বাবা। মহালয়া মানে অতীতের ভক্তি আর বর্তমানের রঙ—দুটো মিলেই মায়ের আহ্বান।”
ঘরে তখন একসাথে বাজছে ভদ্রবাবুর গাম্ভীর্য, টিভির বর্ণিল সঙ্গীত, আর ধূপের সুবাসে ভরা ভোরের শান্তি।