রবি আড্ডায় আফতাব হোসেন
আমাদের গ্রামে আজও বুধবার হাট বসে । গ্রামের হাট । বড় হাট । হাটের ঠিক পাশেই যেখানে বাঁশ ডালের ঝুড়ি গুলো নিয়ে কালো কালো পাথরের মত মেয়েগুলো বসে থাকে 20 টাকা জোড়া ঝুড়ি বিক্রি করার জন্য তার ঠিক পাশেই সালকু বসেছিল । দুটো মুরগি নিয়ে । দেশি মুরগি ।খুব টেস্ট । চোখ গুলো পাথরের মত করে একের পর এক খদ্দের কে ফিরিয়ে দিচ্ছিল । কয়েকজন খদ্দেরকে তো বলেও দিল ‘বিক্রি করবোক নাই ,মোর মর্জি ’।
এই নিয়ে তিনদিন । ⁂⁂⁂⁂
” ভাদু আমার গরবিনী,
ওগো আমার ভাদুমনি,
মাথায় দিবো সোনার মুকুট,
শাড়ি দিবো জামদানী……..। “
নিজের মনেই গাইছিল বিহু । বিহু সরেন । সালকুর মেয়ে । ওই যে পুরুলিয়া শহর থেকে ট্রেনে চেপে মেদিনীপুরের আগের যে ছোট্ট একখানি স্টেশন , সরকার নাম দিয়েছে জঙ্গলমহল । আসল নামটা অবশ্য ভাদুতলা । কেউ বলে ভাদুরানী এখানেই জন্মেছিল আবার কেউ বলে ভাদুঠাকুরের আশীর্বাদ আছে জায়গাটার । ওই খানেই একটু দুরেই মোস্তাক চাচাদের যে পাথর খাদান টা যেখান থেকে জঙ্গল শুরু ঠিক সেখানেই বিহুদের ঘর । ঘরে থাকলে রোদটা যখন মাথায় ওঠে তখন সালকু হাঁক পাড়ে
— ” বিহু বুড্ডি ঘরে আই লো ,কুছু খ্যাইয়ে লে ” ।
বাবার ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে পালাতে গিয়েও ‘লতা’আর ‘পাতার’ দিকে তাকিয়ে একবার চোখ নাচিয়ে ধমকে দেয় বিহু —
‘দেখ লতা পাতা মোর মাথা খাবিক নাই, ফিরে আইস্যে যদি দেখতে পাই পুরাটা খাস নাই তালে কিন্তু খারাপ হুবে ’। ⁂⁂⁂⁂
অনিতা বুড়ি চোখে খুব একটা দেখেনা আজকাল । শীতের শুরুটাতেই যখন কুয়াশার দাপট শুরু হয় তখনই বুড়ির হাঁপানির কাশি টা বড্ড জ্বালায় । ঘ্যানর ঘ্যানর আওয়াজে সালকুর বউ এর ঘুমটা মাঝরাতে যখন চটকে যায় ঠিক তখনই সালকুর সোহাগ জাগে । সিংহের হাতে পিষতে দিয়ে হরিণ হয়ে যখন সালকুর সিংহাসনের রানী হয় বিহুর মা তখন কানের সামনে এসে ফিসফিস করে বলে
” বুড়ির একটো বডিস কিইনা দিস , উদোম গায়ে বুড়ি এই সালের ঠান্ডাটা পেরোতে লারবেক ” । ⁂⁂⁂⁂
সুবল কে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে সালকু বলে ‘ইবার একখান কাম দে সুবল , কুনু কাজ পাইনাই তো , তুই পঞ্চদের একজন বটে , বউ মেয়া নিয়া কি না খ্যায়ে মরবক ‘
সুবল মাঝিও দামড়ে উত্তর দেয় —
“তোরা মারলি কেনে ম্যায়াটাকে ?
তোদের কে সরকার বাড়ি দিল । কাম দিল । ফ্রি রেশন দিল তাও মারলি কেনে ম্যায়াটাকে ।
সুবল তোতলিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে বলে ‘বুরাবাবার কসম ,তুই বিশ্বাস কর উহাকে আমরা মারি নাই , উকে ডাইনি খ্যায়েছে , পুরা পাড়া জানে উটাও ডাইনি ছিল বটে , লখখির ম্যায়াটাকে উটাই খ্যায়েছিল ,সুনীল এর সোমত্ত বউ টাকেও উই খ্যায়েছিল । আমরা কুছু বলার আগেই উ নিজেই পুড়েছে।
‘ওসব বলে কুছু হবে নারে,বিডিও বাবু নিজে কেস দেখছে । সব না মিটা মিটি হলে তোর গ্রামের কেউ কাজ পাবেক নাই ‘ সুবল বলে। ⁂⁂⁂⁂
মোস্তাক চাচার নজর খানি বাদ দিলে লোকটা সালকুদের কাছে ভগবান । সালকুদের পুরা পাড়ার মেয়েরা চাচার পাথর খাদানে কাজ করে । বুড়োর বিয়ে থা হয়নি । উপোষী চোখে মেয়েগুলোকে গিললেও টাকা পয়সার ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না । বলে ‘ আমাগো হল গিয়া মুসল্লিম ঈমান , বুঝলা , এখন চুরি করল্যা আল্লাগো কি মুখ দেখাবু ‘ । সালকুর বউ কে আবার মাঝে মাঝে দু চার পয়সা বেশি দেয় । বলে ‘ বুকা এগুলা আমাগো যাকাত বলে , নে নে আমার নেকি হবে বলে চোখ টা একবার বুকে বুলিয়ে নেয় । ⁂⁂⁂⁂
সকালের পান্তা আর লঙ্কা খাওয়ার পর কাজে যাবার আগে বিহুকে পই পই করে সংসারের সব খুঁটিনাটি বুঝিয়ে যায় সালকুর বউ ।
পুকুর পাড়ে স্নান করার সময় যেদিন নিজের শরীরে রক্ত দেখেছিল বিহু সেদিন থেকেই ও আর বাচ্চা নেই । সংসারে কত্ত কাজ । ঝাঁটা দেওয়া ,উঠোনে গোবর লেপা , তারপর বুড়িকে খাওয়ানো , বাসন ধোয়া , মায়ের জন্য খাবার পৌঁছান , বাপ রে বাপ । চাট্টিখানি কাজ । ভাগ্যিস লতা পাতা আছে । সব কাজেই পায়ে পায়ে ঘোরে ওরা । বিহু মাঝে মাঝে বকুনিও দেয় —
— ‘কই রে লতা পাতা এই ঝাঁট দিলাম আর লংরা করিস নি রে তালে তোদের কেটে খাবো ‘ ।
— ‘ লতা পাতা খ্যাইলি ‘ ।
— ‘লতা পাতা দেখতো বুড়ি কি করে ‘ ।
— ‘লতা পাতা ঝগড়া করবিক নাই নিজেদের মাঝে তোরা দু বোন না । এইটুকুনি থ্যেকে তুদের পালছি । লড়বিনা একবারে ‘ । ⁂⁂⁂⁂
আগের বুধবার থেকে মোস্তাক চাচার খাদান বন্ধ । চাচার নাকি করুণা হয়েছে । সবাই বলাবলি করছিল বুড়া আর বাঁচবেনি । আগের সপ্তাহ এর বেতন ও বাকি । কেউ আর ওমুখো হতে সাহস করছেনা । সব্বাই বলছে কাছে যে যাবে সেও মরবে ।
রাতে সালকুর বুকের ওম নিতে নিতে বিহুর মা ই বললো ‘ হ্যাগো পূজাই কুছু দিবেন না ম্যায়াটাকে , বড় হুছে , একখান বডিস ওর ল্যাগেও লাগবেক , কত্ত আশ কইরে আছে পূজায় লিবে ‘। সালকু বলে ‘ পয়সা কুথায় বউ , মোর তো কামই নাই , চাচাও তো দিল নাই কুছু , তবে তোর চিন্তা নাই ,কাল হাট বার , যেমন কইরে হোক সব লিয়ে আসবো ‘। ⁂⁂⁂⁂
তিনদিন চেষ্টা করেও সালকু বিক্রি করতে পারেনি লতা পাতাকে , শুধু বিহুর কথা মনে হয়েছে । আজ জোড়া 600 টাকার লোভ আর ছাড়েনি ।
সব কিনেছে হাট থেকে । সওওব ।
বিহুটা বড্ড খুশি হবে । ⁂⁂⁂⁂
বাইরে থেকে সুবল মাঝি জোরে জোরে ডাকাডাকি করছে —
‘ কি রে সালকু আছিস নাকি , বি ডি ও বাবু নিজে এসেছে , বিহু কে দেখতে , কই রে , অনেক রিপোর্ট গেছে তোর পাড়ার , বের কর বিহুকে , তোদের কুনু চিন্তা নাই , সাহেবরা নিজে আইসেছে ‘। ⁂⁂⁂⁂
বিহুর আজ রক্তস্নানের দিন । এক নাগাড়ে রক্ত গঙ্গা বইছে দু পায়ের ফাঁকে । সাথে অনেক দিন না ঘুমানো লাল চোখ খুলে একনাগাড়ে বলেই চলেছে —
“ কই রে লতা পাতা খ্যাইলি, লতা পাতা দেখ তো বুড়ি কি করে , লতা পাতা লংরা করবিনা , তালে তোদের কেটে খাবো ”
ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে সালকুর বউ —
“ মোদের ম্যায়াটা ডাইনি হয়ে গেল গো ”