রবি আড্ডায় অনির্বাণ ঘোষ
রাতে ঘুম আসে না আজ সাত দিন হল। দিনে চোখের পাতা এক করতে না করতেই সেই এক দৃশ্য। গোল আগুনের গোলা ধেয়ে আসছে ওর দিকে । অন্ধকারে ভয়। ভয় করে আগুনেও। একা শুতে আওয়াজ হলে চমকে ওঠে এমনকি ওর যে আদরের কুকুর স্পটি হঠাৎ ডেকে উঠলেও লাফিয়ে ওঠে ঘরের মধ্যে একটা পোড়া গন্ধ । যেন কিছু একটা পুড়ছে আর তার সাথে আর এক প্যারালাল দহন ওর মনের ভেতর। মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ শরীরের তাপ বাড়ছে। ডাক্তার বলেছে প্রয়োজনে বারবার স্নান করতে । তাতে শরীরের জ্বালা জুড়োয় কিন্তু মনের জ্বলন – সে তো গ্যালন গ্যালন জলেও ডুড়োবার নয়। দুই হাতের তালুতে দগদগে পোড়া ঘা । অনেকটাই শুকিয়েছে। আবার অনেকটাই শুকোতে বাকি। মাঝে মাঝে জ্বলে। চিড়বিড় করে। হাতের তালুর দিকে তাকাতেও ভয়। সেই ভয়ানক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিন রুদ্র বলল চল সুমন তোকে ঘুরিয়ে আনি। রুদ্রের বাইকের পেছনে বসে সোজা সিধুদার পানের দোকান। ওর পছন্দের খয়ের ছাড়া হালকা চমন ও ভেজা সুপারি দেওয়া মিঠা পাতা ১৬০ জর্দা পানের এক খিলি রুদ্র ওর মুখে গুঁজে দিল। তখনও ওর দুই হাতে ব্যান্ডেজ। ওর বাবার কম্পাউন্ডার অপুদা রোজ এসে ড্রেসিং করে দিয়ে যান। হাতে পান নিয়ে মুখের গোঁজার মত অবস্থা সুমন্তর ছিলনা। সময়টা ভালোই কাটছিল। এরপর পান চিবোতে চিবোতে সোজা শুকনা। সেখানেই পঞ্চনই নদীর জলে পা চুবিয়ে খোশগল্প। শরতের আকাশের লাল তখন ছুঁয়েছে উপোসী উন্মুখ কাশের দলকে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব ভুলে ভালই ছিল সুমন্ত। কথায় কথায় রুদ্র ওকে প্রবোধ দিল, মন খারাপ করিস না; চেষ্টা তো তুই করেছিলি। তোর হাতটাও তো পুড়েছে। ব্যস, অমনি তাল কেটে গেল। তারপর কিছুক্ষণ শুধুই একতরফা আলাপ। সুমন্ত গুম মেরে গেল। হঠাৎ বলল, চল বাড়ি যাই।
সান্ত্বনা ও প্রবোধ ওকে পরিচিতরা দিয়েছে। বয়স্যদের কেউ কেউ আবার বুকিশ দার্শনিকতার কথ্য ভার্সনও শুনিয়েছে। অর্থাৎ শরীর ও অবিনশ্বর আত্মার কথা । মাসিরা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে ছাড়েননি। সবার উদ্দেশ্য ছিল সুমন্তকে একটু স্বাভাবিক করে তোলা। ট্রমা তো কম যায়নি। শারীরিক যতটা মানসিক তার কয়েকগুণ। কিন্তু এসব স্তোকবাক্য অসহ্য লাগে সুমন্তর। জ্বলুনি যেন আরো বেড়ে যায়। পোড়া গন্ধ আরো একটু প্রকট হয়ে আসে। অস্থির লাগে। পরিবেশ আর পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে ওঠে। নিষ্ফল আক্রোশে ওর হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে। সন্ধ্যের দিকে বাড়িতে লোকজন আসে সবার সাথে একসাথে বসতে হয় সুমন্তকে। কানে ভেসে আসে টুকরো টুকরো কথা — ‘নিজের মায়ের মত ভালবাসত’, ‘ছোট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে’, ‘খুব শক পেয়েছে’, ‘নিজের চোখের সামনে তো’, ‘চেষ্টা তো কম করেনি’, ‘সবই কপাল’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমন্তর বুকটা হু হু করে। একটু মন খুলে কাঁদবে তাও পারে না। ঘরে ঢুকে একটু কান্নাকাটি করেছে কি স্পটির হাঁকডাকে পাড়া অস্থির।ওকে ঘরের বাইরে বের করে দরজা আটকালে দরজা আঁচড়াতে থাকে। বাথরুমে গিয়ে কল খুলে কাঁদবার চেষ্টা করেছে কিন্তু খানিকক্ষণ যাবার পরেই বাবার উদ্বিগ্ন কন্ঠ — রাজা এতক্ষণ কি করছিস? তাই কেঁদে হালকা হবে তার উপায় নেই। শুধু দুপুরে যে দু’এক পশলা তন্দ্রা মতো আসে তা ভেঙে গেলে বালিশ ভিজে যায়। চোখের কোল বেয়ে যে নোনতা ধারা অধোগামী, তাতে কোন ভণিতা নেই। ছলনা নেই। তা স্বচ্ছ ও অকপট। নুনের মতোই বিশ্বস্ত। নিমকহারামি ধাতে নেই।
. চিনি আম্মা নেই । একথা বিশ্বাস হয় না। বাড়ির প্রত্যেকটি কোণের তার স্মৃতি। হঠাৎ করে বাবলু বলে যেন ডেকে উঠবে। থপথপে পায়ে হেঁটে এসে একটু পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। পুজোর পর প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকিয়ে বলে উঠবে — ঠাকুর ভালো রেখো। শুধু তার গন্ধ টা হারিয়ে গেছে। একটা অগুরু ও ধূপ মেশানো পুজো পুজো গন্ধ। যে গন্ধ নাকে এলে মনটা এক অজানা ভালো লাগায় ভরে উঠত। সবাই বলে চিনি আম্মা ওর মায়ের মত। সুমন্ত জানে আম্মু ওর কাছে মায়ের থেকেও বেশি কিছু। মায়ের চেয়ে আম্মুর সাথে ওর অ্যাটাচমেন্ট বরাবর বেশি। ছোটবেলা থেকেই চিনি আম্মার কোলে পিঠে মানুষ। আত্মীয়-স্বজনের কানাফুসি থেকে অল্প অল্প করে যদি গল্পটাকে খাড়া করা যায়, তবে ব্যাপারটা এই যে সুমন্ত যখন টলমল পায়ে হাঁটা শিখেছে তখন ওর বাবা-মার দাম্পত্য কলহের শুরু। সে বিবাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিচ্ছেদ আসন্ন হয়ে ওঠে। তখন বিধবা মা ছেলে নাতি নাতনির ভরভরন্ত সংসার ছেড়ে চলে আসেন মেয়ের সংসার বাঁচাতে। সংসার বাঁচে। সুমন্ত কোলে পিঠে বড় হয়ে স্কুল ব্যাগ পিঠে তুলে নেয়। কিন্তু চিনি আম্মু থেকে যান পাকাপাকি। মাঝে মাঝে সুমন্তর স্কুলে ছুটি ছাটা থাকলে বাড়ি যান দুই ছেলে ও নাতি-নাতনিদের দেখতে। সেও কয়েক দিন মাত্র। তারপর যথারীতি মেয়ের বাড়ি। রাতে ঘুমাবার সময় সুমন্ত প্রমিস করিয়ে নিতো , তুমি আর যাবে না। চিনি আম্মা তার শরীরে লেপ্টে থাকা ছোট্ট সুমন্তকে বলতেন, আমার বাবলু কে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
চিনি আম্মাকে ঘিরে ছিল সুমন্তর কাহিনীর জগৎ। সত্যি রাজা সত্যি রাণীর গল্প, আম্মুর ছটফটে ছোটবেলার গল্প, রাজার তৈরি রাণীর নামে যে স্কুলে তিনি পড়েছেন তার গল্প সুমন্তকে জড়িয়ে রেখেছিল। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ, চিলারায় সুনীতি দেবী, জিতেন্দ্র নারায়ণ ও তাদের ঘিরে নানা গল্প নানা মিথ প্রাণ পেত আম্মুর কথনে। গল্প বলতে বলতে কথা জড়িয়ে আসত। চিলারায় রাজাকে মুক্ত করে ঘোড়ায় করে নিয়ে যাচ্ছে ওই জায়গায় যার নাম এখন রাজাভাতখাওয়া। ঘোড়া ছুটছে টগবগ। এরপর ঘোড়ার খুরের বদলে হালকা ফুরফুরে মেয়েলি নাক ডাকার সুর। সুমন্ত ঠেলতো, আম্মু আম্মু, তারপর? আম্মু তাম্বুল রসসিক্ত তন্দ্রাবিজরিত গলায় বলতেন, রাজাভাতখাওয়া অনেক দূর। ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছে। সময় লাগবে। আগে পৌঁছাক। অপেক্ষায় অপেক্ষায় খানিক পর সুমন্ত ঘুমিয়ে কাদা। কোলবালিশ আম্মু। ঘুম থেকে উঠে আম্মুকে জিজ্ঞেস করত –তারপর? আম্মু খেই হারিয়ে ফেলতেন। বলতেন কিসের পর? ঐযে ঘোড়ায় করে যাচ্ছিল মহারাজ আর চিলারায়।
গল্পের শেষটা বড়ই নীরস হত — রাজাভাতখাওয়ায় গিয়ে ভাত খাওয়ালো। মন ভরতো না সুমন্তর। অপেক্ষায় থাকত আবার কবে ছুটির দিন আসবে। আবার কবে গল্প শুনবে। সেই আম্মুই ছুটি নিয়ে চলে গেল।
রোববারের কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠে সুমন্ত। বাবা-মা সাতসকালেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়িতে। বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। সুমন্ত স্পটির সকালের কোটার দুটো বিস্কুট খাইয়ে পড়তে বসেছিল। চাকরির পরীক্ষা। ফাঁকির জো নেই। বাড়িতে তখন সাকুল্যে তিনজন। আম্মু, সুমন্ত আর স্পটি। সুমন্ত মন দিয়ে মক টেস্ট দিচ্ছে । পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে আম্মুর পাঁচালী পাঠ। চাপা একঘেয়ে সুরে। কখন পুজো শেষ হয়ে গেছে লক্ষ্যও করে নি ও। একমনে ম্যাথামেটিক্যাল এ্যাপটিচিউড পেপার সলভ করছিল। ওর ঘোর কাটে স্পটি আর আম্মুর যুগপৎ চিৎকারে। স্পটির বিপন্ন ঘেউ ঘেউ আর আম্মুর আর্তনাদ। স্টাডি থেকে ড্রইং রুমে এসে দেখে একটা আগুনের গোলা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে টলমল করতে করতে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। দাউ দাউ করে। আগুন এর লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়া ছুঁয়ে ফেলেছে ঘরের ছাদ। ওর চোখের সামনে জ্বলে যাচ্ছে ওর প্রাণের চিনি আম্মু। মাতৃসমা, না, মায়ের থেকেও কাছের । একটুর জন্য হলেও বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। যখন ঘোর কাটল তখন দেরী হতে বেশি বাকি নেই। যতক্ষণে ওদের হই হট্টগোল শুনে পাশের বাড়ির রাণা আর রাজা কাকুরা এল ততক্ষণে সব শেষ। এর পরে ফোনফুনি, অ্যাম্বুলেন্স, হসপিটাল, মর্গ, পুলিশ। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউ খেয়ালই করেনি সুমন্তর দুই হাতের তালুতে দগদগে পোড়া দাগ। পরে অনেক ভেবেছে সুমন্ত। জল ঢালা যেত। কম্বল চাপা দেওয়া যেত। মেঝেতে শুইয়ে গড়িয়ে দেওয়া যেত। হয়তো আম্মু বেঁচে যেত। কে জানে! অনেকে অনেক কথা বলেছে। শুষ্ক সান্ত্বনা, গায়ে পড়া উপদেশ, আরো কত কেতাবি কথা। এসব কথার ভিড়ে একটা কথা চাপা পড়ে থাকবে যে কথা কেউ জানবে না। আকুল আর্তি নিয়ে আম্মু যখন ছুটে এসেছিল সুমন্তর দিকে, ও দু’হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল আম্মুকে। ভয়ে আতঙ্কে আম্মুর ছাই থেকে যে আগুন পাখি জন্ম নেবে সে সারাজীবন ঠোকারাবে সুমন্তকে।
(‘চৈতন্য’ পত্রিকায় পূর্বপ্রকাশিত)