
রবি আড্ডায় সন্তু সাহা
গতবছর বিশেষ একটা কাজের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া গেছিলাম। না, না, কোন কোম্পানির কাজে নয়, নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই গেছিলাম। সম্পুর্ন ব্যক্তিগত কাজ। এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। অ্যাপয়েন্টমেন্ট আগেই নেওয়া ছিল। ছ’মাস থেকে ট্রাই করে অবশেষে তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পাওয়া গেছিল।
তো কোরিয়া পৌঁছে সময়মত সেই ভদ্রলোকের অফিসে দেখা করার জন্য ছুটলাম। খুব কষ্ট করে কয়েক লাইন ইংরেজি মুখস্থ করে গেছিলাম। শুধু আমি কী বলতে চাইছি এটা বোঝানোর জন্য যেটুকু ইংরেজি জানতে হয়, সেটকু রপ্ত করেছিলাম।
সেই বিশাল ঝাঁ চকচকে অফিসে পৌঁছে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মিস্টার লি এর আতিথেয়তাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাঁচ মিনিট সময় ছিল আমার হাতে। উনি আসতেই আমি বিষয়টা ইংরেজিতে খুলে বলতে যাব, এমন সময় উনি বললেন, আপনি বাংলায় বলতে পারেন।
আমি তো অবাক!
আপনি বাংলা জানেন?
ওই জানি একটু-আধটু।
কীভাবে শিখলেন?
যৌবন বয়সে বাংলা সিনেমা দেখে দেখে শিখে ফেলেছি।
সত্যজিৎ, মৃণাল সেনের সিনেমা দেখেছেন আপনি?
ভদ্রলোক একটু লাজুক সুরে বললেন, না, তাঁদের সিনেমা দেখা হয়নি।
তাহলে?
ওই স্বামী কেন আসামি, বাবা কেন চাকর, রাজার মেয়ে পারুল…ইত্যাদি।
কুঁচ বরণ কন্যা, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না এগুলোও দেখেছেন তাহলে?
অনেকবার। বসতির মেয়ে রাধা আর ভাই আমার ভাই ইউ টিউবে দেখে তো আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেছিলাম। ইনফ্যাক্ট এখনও কাঁদি।
আমি আর চোখের জল আটকাতে পারলাম না।
আসুন আলিঙ্গন করি আমরা। আমিও সিনেমা হলে ভাই আমার ভাই আর আদরের বোন দেখতে গিয়ে মরা কান্না কেঁদেছিলাম।
এবার কাজের কথায় আসি।
হ্যাঁ, বলুন।
ফট করে ফোনটা বেজে উঠল আমার। বউ এর ফোন। ভীষণ প্রেস্টিজে পড়ে গেলাম। স্যামসাং এর চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করতে গেছি, আর পকেটে রাখা আছে mi এর ফোন। একটা নলেনগুড়-মার্কা হাসি দিয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলাম।
আসল কথায় আসি এবার। আমি সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং মোবাইল ফোনের চেয়ারম্যান লি জে-ইয়ং এর কাছে বিশেষ একটা প্রস্তাব নিয়ে দেখা করতে এসেছি।
আমরা বাঙালিরা একটু বয়স বাড়ালেই ভুলোমনা হয়ে যাই। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস চোখের সামনে থেকেও খুঁজে পাই না। বিশেষ করে চশমা খুলে যে কোথায় রেখে দিই, কাজের সময় আর খুঁজে পাই না। ফোন খুঁজে না পেলে বউয়ের ফোন থেকে মিসড কল দিলেই ফোন বাবাজি রান্নাঘর কিংবা বাথরুম থেকে শব্দ করে তার উপস্থিতি জানান দেয়। চশমার মধ্যে যদি এরকম একটা সিম লাগানোর ব্যবস্থা থাকত, তাহলে মোবাইল থেকে রিং করলেই সহজেই খুঁজে পাওয়া যেত।
ঠিক এই বিষয়টা বলার জন্য মিস্টার লি এর কাছে আসা। স্যামসাং এর সিম লাগানো যদি কোন চশমা বাজারে আনা যেত, তাহলে বাঙালিরা গরম কেকের মতো সেই চশমা কিনত।
উনি সব কিছু শুনে-টুনে বললেন, সিম কোম্পানি এবং চশমা কোম্পানির সাথে এই নিয়ে কথা বলতে হবে। যদি কোলাবরেশন সম্ভব হয় তাহলে আপনার প্রস্তাব ভেবে দেখবো। তবে মাইক্রো সিমে তো হবে না। ডান্টির ভেতর ন্যানো সিম ঢোকাতে হবে।
অ্যাপন্টমেন্ট মোটামুটি সফল। বাড়ি ফিরে এসে বউকে সব বললাম। যদিও ফোনে সবকিছু আগেই জানিয়েছিলাম। আরেকটা কথা বলা হয়নি, উনি একটা দামি স্যামসাং ফোন আমায় গিফ্ট করেছিলেন। বউ সবকিছু শুনে বলল, বাজারে সিম-ওয়ালা চশমা এলে তুমি আরেকবার লি-বাবুর সাথে দেখা করে এসো।
থ্যাংক্স জানাতে আবার অতদূর যাব?
না, আবার একটা প্রস্তাব নিয়ে যাবে।
কী প্রস্তাব?
সিম ওয়ালা ক্লিপ আর চিরুনি যদি মার্কেটে আনা যায় তাহলে বাঙালি মেয়ে বউরা খুব উপকৃত হবে। চুরুনি আর মাথার ক্লিপ কোথায় যে রাখি কাজের সময় আর খুঁজে পাই না।
রান্নাঘর থেকে রান্নার মাসি বলল, বৌদি দাদাকে বলবেন নুনের আর চিনির কৌটোয় একখানা করে সিম লাগিয়ে নিতে। আপনারা কোথায় যে রেখে দ্যান, আমি কাজের সময় আর খুঁজে পাই না।
আমি আর কোন উত্তর করলাম না। শুধু ভাবলাম বাজারে সেই চশমা এলে ফোনে সেইসব চশমার ফোন-নম্বরগুলো কী নামে সেভ করব?
কাঁচ ফাটা আমার চশমা
পাতলা ফ্রেমের বউয়ের চশমা
মোটা ফ্রেমের আমার চশমা
সোনার জলে চোবানো বৌউয়ের চশমা
ডান্টি ভাঙা আমার চশমা
বউয়ের নীল সানগ্লাস
আমার ঘষা খাওয়া সানগ্লাস
বউয়ের দামি চশমা
আমার পাতি চশমা….ইত্যাদি…