রবি আড্ডায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
গরম গরম ভাতে বেগুনসেদ্ধ আর দু-ফোঁটা সর্ষের তেল। সঙ্গে একটু নুন আর কাঁচা লংকা। কী তার স্বাদ, আর কী তার গন্ধ ! এক গরাস মুখে দিয়ে মনে হল যেন অমৃত। ভূত জোলাকিয়া লংকায় একটা বড়সড় কামড় বসিয়েছিল ভানুমতী। তাতেই হয়েছে বিপদ। দাউ দাউ জ্বলে যাচ্ছে ব্রহ্মতালু। জিভে যেন একটুও সাড় নেই। হেঁচকি উঠতে শুরু করেছে পরপর। চোখ আর নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে স্রোতের মতো।
ঘটনা দেখে হাঁ হয়ে গেছে পটললাল। ভানুমতীকে সে বিয়ের পর থেকে দেখে আসছে টিয়াপাখির মতো টপাটপ লংকা খেতে। বউয়ের জন্য খুঁজে খুঁজে সবচাইতে ঝাল লংকা কিনে আনে সে। তবুও ভানুমতীর আশ মেটে না। তাদের অফিসের নাইটগার্ড গুপিনাথ পাঁচ ক্রোশ দুরের সাহেবপোতা থেকে আসে। সেখানকার আকাশি লংকার খুব নাম। গুপিনাথকে দিয়ে সাহেবপোতা থেকে বেশ কয়েকবার আকাশি লংকা আনিয়েছে পটললাল। অন্য লংকার মতো নিচের দিকে ঝুলে থাকে না, আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে থাকে এই লংকা। আর ঝালও মোক্ষম। পটললাল একবার সেই লংকার ছালে একটু জিভ বুলিয়ে দেখতে গিয়ে ভিরমি খেয়েছিল। তা, সেই লংকা খেয়ে ভানুমতী বহুদিন খুশি ছিল। কিন্তু একটা সময় সাহেবপোতার লংকা বিস্বাদ লাগতে লাগল ভানুমতীর মুখে।
এমন সময় সন্ধান পাওয়া গেল সিরাজগঞ্জের ধানি লংকার। পটললালের অফিসে এসে লটারির টিকিট বিক্রি করে জগবন্ধু। পটললাল লটারির টিকিট কাটে না বটে, তবে জগবন্ধুর সঙ্গে তার সুখদুঃখের কথা হয়। জগবন্ধুর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। গল্পে গল্পে একদিন জগবন্ধু বলছিল, তার গাঁয়ের ধানি লংকার তেজ নাকি মারাত্মক। চেহারায় ছোট কিন্তু প্রত্যেকটা লংকা যেন এক একটা পরমাণু বোমা। আগ্রহী হয়ে জগবন্ধুকে দিয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে কেজিখানেক ধানি লংকা আনিয়েছিল পটললাল। সেই লংকা খেয়ে ভানুমতী আনন্দে ছিল বেশ কিছুদিন। কিন্তু বিধি বাম। কয়েক মাস পর আবার গিন্নির মুখ ভার। এই জিনিস চলবে না, এর থেকেও ঝাল লংকা চাই তার।
পটললালের অফিসের বড়বাবু লালু বোস রসিক মানুষ। সিকিম ঘুরতে গিয়ে কাঠের কারুকার্য করা চাবির রিং নিয়ে এসেছিলেন সকলের জন্য। শুধু পটললালের জন্য এনেছিলেন এক ব্যাগ লংকা। গোল গোল দেখতে, অসম্ভব ঝাল। স্থানীয় নাম ডলে খরসানি। সেই লংকা খেলে হি-হি ঠান্ডাতেও শীতবস্ত্রের প্রয়োজন হয় না। মাত্র একটা লংকা দিয়েই দু-কেজি মাংস রান্না করে ওদিকের লোক। এহেন লালু বোসের আনা ডলে খরসানি দিয়েই অ্যাদ্দিন কাজ চলছিল। কিন্তু কিছুদিন হল ভানুমতীর আবার মন খারাপ। ওই ঝালস্য ঝাল লংকাও আজকাল আমসি লাগতে শুরু করেছে তার মুখে।
পটললাল নিচুতলার চাকুরে। অভাবের সংসার। কচুসেদ্ধ-বেগুনসেদ্ধ দিয়েই ভাত খেতে হয় বেশির ভাগ দিন। তবে একদিক দিয়ে বাঁচোয়া। তার বউয়ের মাছ মাংসের ওপর লোভ নেই। শাড়ি গয়নার দিকে ফিরে তাকায় না ভানুমতী। শুধু ওই একটা জিনিসের প্রতিই তার দুর্বলতা। মনের মতো ঝাল লংকা পেলে ভানুমতী শুধু নুন দিয়েই এক থালা ভাত খেয়ে নিতে পারে। আর কিচ্ছুটি চাই না তার। কিন্তু সেই তুচ্ছ জিনিস জোগাড় করতে গিয়েই পটললাল হিমসিম।
সেদিন অফিসে হাজিরা খাতায় সই করছিল পটললাল। লালু বোস কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তোর ভাঁড়ারের ডলে খরসানি নিশ্চয়ই শেষের পথে ? আমার এক বন্ধু সিকিম যাচ্ছে বেড়াতে। তাকে দিয়ে কেজি দুয়েক ডলে খরসানি আনাব ? পটললাল ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল, ছেড়ে দিন বড়বাবু। ডলে খরসানির মতো তেজি লংকাও এখন আলুনি হয়ে গেছে ভানুমতীর মুখে। লোকে যেমন কিছু খেয়ে ওঠার পর মুখশুদ্ধি খায় তেমনি করে ভাত খাবার পর দুটো করে ডলে খরসানি আজকাল চিবিয়ে খায় ভানুমতী।
লালু বোস শুনে হাঁ হয়ে গেলেন। কপালে ফুটে উঠল কয়েকটা ছুরির কাটা দাগের মতো রেখা। চিন্তিত মুখে বললেন, আমাদের প্রত্যেকের জিভে টেস্ট বাড থাকে। যাকে বলে স্বাদেন্দ্রিয়। সেটাই কোনও খাবারের টক-মিষ্টি-ঝাল-নোনতা স্বাদ আমাদের মস্তিষ্ককে জানিয়ে দেয়। আমার মনে হচ্ছে তোর বউয়ের জিভে নির্ঘাত টেস্ট বাড বলে কিছু নেই। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বলে একটা সংস্থা আছে। তাদের একটা চিঠি লিখব ভাবছি। ওরা যদি পরীক্ষা করে দেখে যে, প্রকৃতির খেয়ালে তোর বউ ওই স্বাদেন্দ্রিয় বস্তুটি ছাড়াই জন্মেছে, তাহলে কিন্তু লটারি লেগে যেতে পারে রে পটলা।
ধড়াস ধড়াস করছিল বুক। পটললাল ঠোঁট চেটে জানতে চাইছিল, কেন বড়বাবু ? লালু বোস বলেছিলেন, তোর বউকে বিরাট টাকার চেক দেবে কোম্পানি। পটললাল ঢোক গিলে বলেছিল, কত টাকা ? লালু বোস চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, অত শত জানি না। তবে দু-চার কোটি না হোক দু-চার লাখ তো দেবেই। পটললাল মাথা চুলকে বলেছিল, ইয়ে মানে … তাহলে চিঠিটা কবে করবেন বড়বাবু ? লালু বোস ফাইলের কাগজ পড়তে পড়তে বলেছিলেন, একটু সবুর কর। আগে ওদের ঠিকানাটা জোগাড় করে নিই তার পর দেখছি।
লালু বোসের কথা শুনে ঘুম ছুটে গিয়েছিল পটললালের। কতগুলো একশো টাকার নোট জড়ো করলে এক লাখ বা এক কোটি টাকা হয় সেটা ভাবতেই গুলিয়ে যাচ্ছিল মাথা। কিন্তু একটা জায়গাতেই খটকা। শরীরে জন্ম থেকেই খুঁতো মানুষ তো কত আছে। তাদের সবাইকেই কি পুরষ্কার দেয় এই বিদেশি কোম্পানি ? সে আনপড় বলে তার সঙ্গে বড়বাবু মশকরা করছেন না তো ?
কথাটা শোনার পর থেকেই পটললালের একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। বায়ু চড়ে গেলে যেমন হয়। রাতে ঘুম আসছিল না। বুকের মধ্যে সবসময় একটা ঢিপঢিপ ভাব। তাদের ছেলেপুলে নেই। টোনাটুনির সংসার। অতগুলো টাকা কোথায় রাখবে, কীভাবে খরচ করবে সেসব ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ক’দিন ধরে। এখন ভানুমতীকে ভূত জোলাকিয়া নামের এই লংকার ঝালে নাকের জলে চোখের জলে হতে দেখে পটললাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বড়লোক হবার হাজার ঝামেলা। এই বেশ ভাল আছে তারা। উটকো টাকার দরকার নেই তাদের। তবে হ্যাঁ ভূত জোলাকিয়ার প্রতি পটললালের বেশ একটা শ্রদ্ধাভক্তি হল। বাপ রে বাপ, ওইটুকু বামনবীরের মতো চেহারা, তার এত তেজ ! তুখোড় লংকাখেকো ভানুমতীকে কিনা শেষ পর্যন্ত এভাবে ঘোল খাইয়ে ছাড়ল !
ভানুমতীর ভাই জয়গোপাল থাকে বঙ্গাইগাঁওতে। বাজারে চালের আড়ত। চালু দোকান। গত বর্ষার সময় বঙ্গাইগাঁও গিয়েছিল দুজনে। দিদি আর জামাইবাবুর জন্য ব্রহ্মপুত্রের ইলিশ নিয়ে এসেছিল জয়গোপাল। কালো জিরে কাঁচা লংকা দিয়ে ঝাল ঝাল ইলিশ রেঁধেছিল জয়গোপালের বউ। পটললাল শিসোচ্ছিল সেই রান্না খেয়ে। কিন্তু ভানুমতীর মুখ ভার। একটু নাকি ঝাল হয়নি রান্নায়। জয়গোপালের বউ কাঁচুমাচু। এঁটো হাতে দিদিকে বসিয়ে রেখে জয়গোপাল স্কুটার নিয়ে ছুটল বাজারে। অসমের সবচাইতে ঝাল লংকা নিয়ে এল একটু বাদে। সেই লংকা একমুঠো ডলে নিয়ে তবেই সেবার কয়েক গরাস ভাত মুখে তুলতে পেরেছিল ভানুমতী।
সপ্তাহখানেক বাদে ফেরার পালা। বিদায় জানাতে স্টেশনে এসেছিল জয়গোপাল। একটা প্যাকেট পটললালের হাতে দিয়ে জয়গোপাল বলেছিল, ভূত জোলাকিয়া লংকার বিছন আছে এর মধ্যে। নাগাল্যান্ড থেকে আনিয়েছি। এর থেকে ঝাল লংকা সারা দেশে আর নেই। প্রবাদ আছে, মানুষ তো দূরস্থান ভূত পর্যন্ত এই লংকা জিভে ছোঁয়াতে ভয় পায়।
সেই লংকার বিছন নিয়ে এসে বাগানে লাগিয়েছিল পটললাল। এবার প্রচুর লংকা গাছ হয়েছে বাগানে। লংকাও ধরতে শুরু করেছে গাছে। গোল গোল বনকুলের মতো দেখতে। বেগুনি আর লাল মেশানো রং। কী মসৃণ আভা ঠিকরে বেরোয় তার ত্বক দিয়ে ! দেখেও সুখ। সেই গাছ থেকে লংকা ছিঁড়ে আজ প্রথম ভাতের পাতে তার স্বাদ নিতে গিয়েছিল ভানুমতী। তার পর এই লংকা কাণ্ড।
পাম্প স্টেশন চত্বরে পটললালের কোয়ার্টারস। পাশেই গভীর অরণ্য। দিনের বেলাতেই নিঝুম অন্ধকার। শাল সেগুন চিকরাশি ওদালের জঙ্গলের মধ্যে শ্বদন্ত বের করে ঘুরে বেড়ায় বুনো জন্তু। কখনও সখনও দু-একটা চিতাবাঘ ছিটকে চলে আসে লোকালয়ে। পটকা ফাটালে বা সার্চ লাইট জ্বালালে তারা আবার ফিরে যায় বনে। ভুট্টা আর সুপারির চাষ করে দিন গুজরান করে এদিকের লোক। ভুট্টা যখন পাকে জঙ্গল থেকে হাতির পাল চলে আসে তাণ্ডব চালাতে। তখন মশাল জ্বালিয়ে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে তাদের তাড়াতে হয়।
পটললালের দু-কামরার কোয়ার্টারসের হাতা কিন্তু বেশ বড়। সেখানে অনেকটা জায়গা নিয়ে ফুলগাছের চাষ করেছে পটললাল। বিকেলবেলা নিয়ম করে গাছে সারজল দেয়। গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গন্ধরাজ, হাসনুহানা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকে ফুলবাগান। একদিকে লাগিয়েছে কিছু লেবুগাছ। লেবুগুলো ছোট হলেও খুব রস। কাঁটাওয়ালা লেবুঝোপের পাশে কীভাবে যেন ঢেঁড়স গাছের মতো দেখতে বেশ কিছু লতা কস্তুরি জন্মেছে নিজে থেকে। এই গাছ সুগন্ধি তৈরিতে কাজে লাগে। তবে এর রোঁয়া বিচুটি পাতার বাবা ! গায়ে একবার লাগলে সারাদিন ধরে চুলকোতেই থাকে। ফুলবাগানের অন্যদিকে টিনের দরজার গা ঘেঁষে আছে ঝুপ্পুস একটা কাঁঠালগাছ। এবার প্রচুর ফল হয়েছে গাছে।
বর্ষাকাল শুরু হবে হবে ভাব। ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে গোটা পাম্প স্টেশন চত্বর ম-ম করছে পাকা কাঁঠালের গন্ধে। বনের মধ্যে আজকাল কাঁঠাল গাছ আর নেই। এদিকে দু-পা বাড়ালেই লোকালয়। আর গেরস্ত বাড়িতে যদি পাকা কাঁঠালের মতো এমন লোভনীয় বস্তু থাকে তাহলে হাতিরা দল বেঁধে আসবেই। কাল সন্ধেবেলা কপাল পুড়েছে দু-নম্বর কোয়ার্টারসের তারকেশ্বর লোহারের। হাতির পাল এসেছিল ভুট্টা খেতে। একটা দলছুট দাঁতাল কাঁঠালের গন্ধে গন্ধে চলে এসেছিল এদিকে। তারকেশ্বরের গাছের সব কাঁঠাল সাবাড় করে দিয়ে গেছে কাল।
হাতি এসে কাঁঠাল খেয়ে গেছে কিন্তু কারওর প্রাণ যায়নি এটাই বাঁচোয়া। এসব বন লাগোয়া বস্তিগুলোতে মাঝেমধ্যেই হাতির উপদ্রব হয়। জমির ফসল নষ্ট করে, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে হাতির পাল। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। পা দিয়ে পিষে আর শুঁড় দিয়ে আছড়ে মেরে শুধু এই তল্লাটেই গত দু-বছরে বারো জনকে মেরেছে হাতির দল। বন দপ্তর যে ক্ষতিপূরণ দেয় না তা নয়। কিন্তু সে টাকা দিয়ে কিছুই হয় না। তাছাড়া প্রাণের কি আর দাম হয় ! বাড়ির রোজগেরে মানুষটার কিছু একটা হয়ে গেলে বাকিরা পথে বসে। প্রত্যেক বছর হাতির হানায় যে বিপুল ক্ষতি হয়, সেটা সামলাতে বাসিন্দারা নাজেহাল হয়ে পড়ে।
সন্ধেবেলা রেডিয়োতে খবর শুনছিল পটললাল। হঠাৎ একটা সোরগোল। পটকা ফাটানোর আওয়াজ, ক্যানেস্তারা পেটাবার শব্দ শোনা গেল। সেই শব্দটা ক্রমশ যেন আরও কাছে আসতে লাগল। তার পর ঘটাস করে একটা শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ চিৎকার। টর্চ হাতে নিয়ে কোয়ার্টারস থেকে বাইরে বেরোল পটললাল। ঘরের বাইরে এসেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল।
একটা বিরাট চেহারার হাতি টিনের দরজা ভেঙে সটান ঢুকে পড়েছে তার কোয়ার্টারসের হাতায়। এটা নির্ঘাত কালকের সেই দাঁতালটা। কাল তারকেশ্বরের গাছের কাঁঠাল খেয়ে লোভ বেড়ে গেছে। আজ ঢুকেছে পটললালের ডেরায়। লম্বা শুঁড় দিয়ে গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে খাচ্ছে। নাগালের মধ্যে যে ক’টা কাঁঠাল ছিল সবগুলো শেষ করে এখন মাথা দিয়ে গুঁতো দিতে শুরু করেছে গাছের কাণ্ডে। হাতির শরীরে অসীম জোর। পাকা কাঁঠালগুলো গাছ থেকে খসে পড়ছে ধপধপ করে। মাটিতে পড়ে থাকা কাঁঠাল শুঁড় দিয়ে তুলে টপাটপ খেয়ে নিচ্ছে হাতিটা। চারদিকে এত হৈ চৈ চলছে তবুও তার একটুও ভ্রূক্ষেপ নেই।
খবর পেয়ে বনদপ্তরের কর্মীরা ছুটে এসেছে। মশাল জ্বালিয়ে, পটকা ফাটিয়ে, ক্যানেস্তারা পিটিয়ে চেষ্টা করছে হাতিটাকে বনে ফেরাতে। সার্চ লাইট জ্বালিয়ে হাতিটার চোখে ফেলেছিল একজন। তাতেই হয়েছিল বিপদ। কাঁঠাল খাওয়া ছেড়ে লোকটার দিকে তাকাল হাতিটা। ভয় দেখাবার জন্য একজন বনকর্মী দু-রাউন্ড শূন্যে গুলি চালিয়েছিল। চোখের পলক ফেলার আগেই ছুটে এসে লোকটার বন্ধুক শুঁড় দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে দাঁতালটা। এক আছাড়ে ভেঙে ফেলে দিল বন্দুক। লোকটা ছুটে পালাতে যাচ্ছিল। হাতিটা কেমন একটা আওয়াজ করে তাকে শুঁড় দিয়ে ধাক্কা দিল একটা। ছিটকে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল সেই লোকটা।
পটললাল খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব। হঠাৎ করেই মাথার মধ্যে একশো ওয়াটের বাতিটা জ্বলে উঠল তার। পা টিপে টিপে ঘরের ভেতর গেল পটললাল। দু-মিনিট বাদে যখন বেরোল তখন তার হাতে শালপাতার দোনা দিয়ে বানানো একটা পুঁটলি। বাতাবিলেবুর মতো তার সাইজ।
পা টিপে টিপে হাতিটার দিকে এগোল পটললাল। পুঁটলিটা বলের মতো গড়িয়ে দিল দাঁতালটার দিকে। কাঁঠাল খেতে খেতে মুখ তুলে পটললালকে একবার দেখল হাতিটা। মাথা নিচু করে শুঁড় দিয়ে পুরো পুঁটলিটাকে নাড়ল চাড়ল একটুক্ষণ। কুতকুতে দুটো চোখ দিয়ে পটললালকে জরিপ করল খানিক। তার পর শুঁড় দিয়ে টেনে পুঁটলিটা পেটে চালান করে দিল এক নিমেষে।
হাতিটা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট চোখ দিয়ে পটললালকে দেখছে এক দৃষ্টে। ঘড়ির কাঁটা যেন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে কেউ। সময় স্থির হয়ে গেছে যেন। বুক ঢিপঢিপ করছে পটললালের। হঠাৎ কন্ঠনালী দিয়ে কারখানার ভোঁ-এর মতো পিলে চমকানো আওয়াজ তুলল হাতিটা। তার পর ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। সাড় নেই একটুও।
মিনিট পাঁচেক গেল। দাঁতালটা শুয়ে আছে তো শুয়েই আছে। ওঠার নামগন্ধ নেই। পটকা ফাটানো, টিন পেটানো থেমে গেছে। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনতা।
এবার সবাইকে চমকে দিয়ে আচমকা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে দাঁতালটা। ধপ ধপ করে ছুট দিয়েছে সামনের দিকে। যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিকে না গিয়ে লেবুগাছের ওদিকটা দিয়ে বেরোবার পর খুঁজছে। লেবুর কাঁটা লেগে ছড়ে গেছে সমস্ত গা। ছাই ছাই প্রকাণ্ড শরীর থেকে গড়িয়ে নামছে লাল রক্ত। এমনিতে হাতির স্মৃতিশক্তি ভাল। এসেছে যে পথ দিয়ে সেটা ভুলে যাবার কথা নয় তার। কিন্তু কোনও কারণে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে বেচারির।
দাঁতালটা লতাকস্তুরি গাছগুলোর দিকে এসেছে। তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, আচমকা চিৎকার করে উঠল আবার। আবার ধপ করে পড়ে গেল নরম মাটিতে। অতি কষ্টে আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। লতাকস্তুরির রোঁয়া লেগে গেছে সারা গায়ে। নিশ্চয়ই চুলকোতে শুরু করেছে সারা শরীর। হাতিটা এখন পাগলের মতো গা ঘষছে দেওয়ালে। কার্ডবোর্ডের পলকা বাক্সের মতো ভেঙে পড়ল সিমেন্টের দেওয়াল। পরিত্রাহী চিৎকার করতে করতে সামনের দিকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুট লাগিয়েছে দাঁতালটা। পিছন পিছন ছুটছে বনকর্মীরা। টিন আর ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে ছুটছে উৎসাহী জনতা।
হাতিটার গমনপথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ভানুমতী। একটুক্ষণের মধ্যেই দাঁতালটা দৃশ্যের আড়ালে চলে গেল। ভানুমতী গলায় উৎকণ্ঠা মিশিয়ে জিজ্ঞেস করল, পুঁটলির মধ্যে কী ছিল গো ? সেঁকো বিষ নিশ্চয়ই ?
পটললাল মুচকি হাসল, উঁহু। সেঁকো বিষ টিষ নয়, ছিল ভূত জোলাকিয়া।
ভানুমতী চোখ গোল গোল করে বলল, মানে ?
পটললাল পায়রা ওড়ানো হাসি হাসল, ওঃ জব্বর জিনিস দিয়েছিল বটে জয়গোপাল ! কী ঝাল কী ঝাল ! তোমার মতো দুরন্ত দুর্ধর্ষ লংকাখোর মানুষ আমি আজ অবধি দেখিনি। সেই তুমি পর্যন্ত কুপোকাত হয়ে পড়েছিলে ভূত জোলাকিয়া খেয়ে। সেই লংকা গোটা পঁচিশেক খেয়ে হাতিটা যা শিক্ষা আজ পেয়েছে তাতে ওর জন্মের মতো কাঁঠাল খাওয়ার শখ ঘুচে গেছে। ব্যাটা জীবনে এদিক আর মাড়াবে না !