রবি আড্ডায় সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

হাওড়া স্টেশানে শাঁখা পলা, একমাথা সিঁদুর নিয়ে যে নতুন বিয়ে হওয়া বাঁকড়ার মেয়েটা নামলো, জাপটে ধরে আছে তার বরের হাত, বর পরে আছে একটা সস্তা উইন্ড চিটার, গলায় মাফলার, হাতে একটা টাকার ছোট ব্যাগ। মেরেকেটে কুড়ি হবে বয়স, মেয়েটার, তার বরেরও এদিক ওদিকই। তার বর এসেছে কলকাতা আগেও, এজরা স্টিটে পাইকিরি বাজারে মুটে খেটেছে মাসখানেক। বর বলছে, হাওড়া ব্রিজ দেখবিনি, মালতি, ওইদিকি দ্যাক। স্টেশানে সামনে দাঁড়িয়ে আছে চেকার সারিসারি, মালতি ওন্দা স্টেশানে চেকার দেখেছে, সে চেনে। ভয়ে মালতির হাত কুঁকড়ে যাচ্ছে তার বর রাজু মণ্ডলের হাতে। রাজু মণ্ডল পিঠে কাপড়ের ব্যাগ সামলাতে সামলাতে মালতি মণ্ডলের হাতে চাপ দিয়ে বলছে, ভয় কি তোর রে, টিকিট আছে তো বুকপকেটে, ধুর পাগলি। রাজু হাসছে, মালতি হাসছে, ঘন হচ্ছে দুইহাত, হাওড়া স্টেশানের আন্ডারপাসের লক্ষমানুষের সামনে। ভালোবাসা এরকমও হয় কলকাতা। সাব অল্টার্ন লিটারেচার না, প্রান্তিক মানুষের প্রেমের টেম্পলেট না। শুধু ভালোবাসা, এটকুই।

সেন্ট জেভিয়ারসের সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেল ভিউ এর সামনে চলে এসেছে একটা বছর পঞ্চাশের লোক। তার ছেলের পরীক্ষার সিট পড়েছে জেভিয়ারসে। শেক্সপিয়ার সরণী অবধি এলোপাথাড়ি হেঁটে লোকটা গুলিয়ে ফেলেছে রাস্তাঘাট। গায়ে জ্বর আছে বেশ, সেই কোন সকালে ভ্যানো চড়ে বাপ-বেটায় আরামবাগ এসেছে, সেখান থেকে বাস। ছেলেটা কলেজে পাস দিয়েছে দুবছর হল, শ্যালো পাম্প সারানোর কাজ শিখবে বলছে, বাপ রাজি না, একটা চাকরি হয়ে গেলে দিন ঘুরবে জানে বাপটা। ক্ষিধে পাচ্ছে বাপটার, টিফিনের কৌটোটা বাড়িতেই ভুলে এসেছে সে। ফ্ল্যাটের সিকিয়রিটি গার্ডকে সে জিজ্ঞাসা করছে, খাবার কোথায় পাবো। রাস্তার ধারে একটা ফুটপাথের দোকান খোলা পায়নি সে। বাপটা ঢুকছে দিনেও নিয়ন আলোজ্বলা পশ ক্যাফেতে, লজ্জায় কুঁকড়ে, অস্বস্তি শরীর জুড়ে। ঠাণ্ডা ক্যাফেতে বসা বুটিকের শাড়ি, মাটির গয়না আর বড়ো কালো টিপ পরা কলকাতা তাকে মাপছে। বাপটা ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করছে, একটু মুড়ি বা ছাতু হবে স্যার। মাটির গয়না আর বড়ো কালো টিপ হাসছে, ওয়েটার হাসছে। বাপটা সরি বলছে, কাকে বলছে সেও জানে না, কলকাতাকে কি সরি বলা যায়? লা মারটসের ফুটপাথে নিমগাছের নীচে বাপটা বসেছে, ঘুম আসছে, জ্বরটা বেড়েছে। তার ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে, যে পরীক্ষার OMR সীট হয়তো বা কোন নেতার বাড়িতে পচবে বছরের পর বছর। বাপটাকে দেখলে সে কথা এখুনি বলবেন না। ছোটলোক হোক, মানুষ তো। বাপটার নাম কি বিশ্বাস করুন আমিও জানি না। বাপেদের নাম হয়কি? আরামবাগ পেরিয়ে গলতা কারুই গাঁয়ের আলুক্ষেতের বাপেদের নাম মনে রাখার মত সস্তা ডেটাবেস এইদুনিয়ার না।

দিন ঢলছে, সন্ধ্যে নামছে শহর কলকাতার বুকে। শহীদ মিনারের নীচে লাল নীল হলদে সবুজ বাসগুলোর আলো জ্বলে উঠেছে। খালাসিগুলো ময়দানের ধারে পেচ্ছাপ করে বিড়ি ধরিয়েছে, বাস ছাড়বে এবার। মালদা টাউন, শান্তিপুর, বহরমপুর, কতো নাম। ইডেনের দিক থেকে একটা কমলা আভা জড়িয়ে ধরেছে চত্বরটাকে, কলকাতা থেকে গাঁ-গঞ্জ সদর বিদায় নিচ্ছে আজকের মত। ভালোবাসা যদি তুমি বুঝতে শহর, তুমি জানতে রোজ রাতের শেষ বাসটা ছেড়ে যাবার পর ভিক্টোরিয়ার পরীটা জানে ভালোবাসা ছেড়ে যায় শহরটাকে। মাঝরাতে শুনশান ময়দান, চোরঙ্গি, নিউটাউনের রাস্তা জুড়ে পরীটা উড়ে বেড়ায়। অস্কার ওয়াইল্ডের হ্যাপি প্রিন্সের ছোট্ট চড়ুই পাখিটার মত। রাজু আর মালতি মণ্ডল আর বাপ ব্যাটা মিলে হ্যাপি প্রিন্সের সোনার হৃদয়টা চুরি করে নিয়ে যায় রোজ।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *