
রবি আড্ডায় শর্মিষ্ঠা কুন্ডু
শরৎ এলে বাঙালির মনে অন্য রকম স্রোত বয়ে যায়। আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ, মাঠে কাশফুলের দোলা, বাতাসে হালকা শীতের আভাস—সব মিলে মনে করিয়ে দেয়, দুর্গাপুজো এসে গেছে। সারা বছরের ক্লান্তি ভুলে মানুষ তখন মেতে ওঠে উৎসবের প্রস্তুতিতে। নতুন জামা, আলোকসজ্জা, মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দেখা—এসবই যেন এক বিশাল আবেগের অংশ। কিন্তু এই উৎসবের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরেকটি টান—পাহাড়ের প্রতি অদম্য ভালোবাসা।
অরিজিৎ আর স্নিগ্ধার গল্পও তাই। বিয়ের পর থেকে তারা পুজো কাটিয়েছে শহরের ব্যস্ত মণ্ডপে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। কিন্তু এ বছর হঠাৎই মনে হলো—শুধু মণ্ডপ দর্শন নয়, চাই একটু নিসর্গ, চাই মুক্তির স্বাদ। অরিজিৎ বলল, “শোনো, পুজোর আসল আনন্দটা তো পাহাড়ের হাওয়ায় খুঁজে পাওয়া যায়।” স্নিগ্ধা চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ, পাহাড়েই তো প্রেম নতুন করে জন্মায়।”
ট্রেনে চেপে দার্জিলিংয়ের পথে যাত্রা শুরু হলো। জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া কাশফুল, মাঝেমধ্যেই বাজতে থাকা ঢাকের শব্দ, আর সহযাত্রীদের উচ্ছ্বাস—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, পুজো যেন তাদের সঙ্গেই ভ্রমণ করছে। ছোটবেলার মতো উত্তেজনা নিয়ে স্নিগ্ধা বলল, “এমন ভ্রমণই তো আমাদের চাওয়া—যেখানে উৎসব আর প্রকৃতি মিলেমিশে যায়।”
দার্জিলিং পৌঁছতেই পাহাড়ি বাতাস যেন তাদের আলিঙ্গন করল। ভোরে টয় ট্রেনে চেপে তারা বেরোল। পাহাড়ি পথ বেয়ে কুয়াশা নেমে আসছে, দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রথম সূর্যের আলোয় রঙ বদলাচ্ছে। অরিজিৎ স্নিগ্ধার হাত ধরে বলল, “দেখো, এ দৃশ্যটাই আমাদের জীবনের আসল পূজা।” স্নিগ্ধা আবেগে ভরে উঠল; তার মনে হলো, দেবী যেন সত্যিই এই পাহাড়ের বুকেই নেমে এসেছেন, তাদের প্রেমকে আশীর্বাদ দিতে।
সন্ধ্যায় স্থানীয় মণ্ডপে গিয়ে তারা ঢাকের তালে নাচতে থাকা মানুষদের সঙ্গে মিশে গেল। মেঘলা আকাশে পূর্ণিমার আলো, ধূপ–ধুনোর গন্ধ আর ঠান্ডা বাতাসে মিলেমিশে এক অনন্য আবহ তৈরি হলো। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে দু’জন নীরবে প্রতিজ্ঞা করল—প্রতি বছর শরৎ এলে তারা আবার এমনই এক ভ্রমণে বেরোবে, যেখানে পুজো আর পাহাড় হাত ধরাধরি করে তাদের জীবনকে নতুন আলোয় ভরিয়ে তুলবে।
পাহাড়ের নির্জনতায় তারা খুঁজে পেল এক অদ্ভুত শান্তি। ব্যস্ত শহরে যেখানে মানুষ শুধু দৌড়োয়, সেখানে পাহাড় শেখাল ধীরে বাঁচতে, গভীরভাবে অনুভব করতে। অরিজিৎ বলল, “জানো, পুজো আমাদের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত করে, আর পাহাড় আমাদের স্বপ্নের সঙ্গে।” স্নিগ্ধা মৃদু হেসে বলল, “তাহলেই বুঝি বাঙালির হৃদয় এতদিন ধরে পুজো আর পাহাড়কে সমানভাবে ভালোবেসে এসেছে।”
তাদের কাছে এই ভ্রমণ আর উৎসব আলাদা কিছু নয়; বরং একে অপরকে সম্পূর্ণ করে। পুজো যদি হয় আনন্দের উৎসব, তবে পাহাড় হলো সেই আনন্দের বিশ্রামস্থল। একে ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ।
তাই তো, প্রতি বছর শরৎ এলেই বাঙালির মনে একই প্রশ্ন জাগে—“পুজোয় কোথায় যাচ্ছ?” আর উত্তরটা আগেই যেন জানা থাকে—পাহাড়ের ডাক এড়িয়ে যাওয়া যায় না।