
রবি আড্ডায় অরিন্দম বসু
দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের বিপরীতে লেখক এক নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। সেখান থেকে তাঁর উড়িয়ে দেওয়া পাখি কখনও দূরে মিলিয়ে যায়, কখনও ফিরে হাতে এসে বসে। রোজকার জীবনের বাস্তবভূমিতে অথচ সঙ্গীত, খাদ্য, বন্ধুবান্ধব, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তাঁর মাথার ভেতরে বয়ে চলে। সেখানেই বিমূর্ত সৃষ্টির ভারা বাঁধতে থাকেন তিনি কোনও এক রাজমিস্ত্রির মতো।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার খানিকটা ব্যাখ্যা বোধহয় করা যায় এভাবে। খানিকটা, কারণ তাঁর লেখার আরও অনেকখানি শীতের কুয়াশায় রহস্যময় জ্যোৎস্না। পাঠক হিসেবে তার জ্যামিতিক আলো-আঁধার আবিষ্কারের দায়িত্ব বর্তায় আমাদের ওপর।
ধরা যাক ‘হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী’। গোহাটা থেকে গরু কিনে ফিরছে পরের জমিতে গতরখাটা হাজরা নস্কর। পথে সেই গরুর সঙ্গেই রুটি-গুড় ভাগ করে খাচ্ছে। এক সময় রুটি ফুরিয়ে গেল। “সারা তল্লাট জুড়ে সবুজ ধানচারাগুলো এখন মা বসুমতীর বুকে আপনাআপনি শিকড় নামিয়ে দিচ্ছে, তার একটা চিনেচিনে শব্দ, শিকড় নেমে পড়ার আওয়াজ হাজরা নস্কর ছায়া-গোলা জ্যোৎস্নায় বসে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল।” এ সময় পাঠকের মনেই থাকে না যে হাজরা নস্কর সামান্য গতরখাটা চাষি। তারই রূপমুগ্ধতার শরিক হয়ে যেতে হয়। যে সূক্ষ্মতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসব করেন ঠিক সেই সূক্ষ্মতাতেই তিনি অন্য এক দায় পালন করেন। তাঁর বিশ্বাস, একজন শিল্পী তাঁর দায়বদ্ধতার কথা সরবে উচ্চারণ করার লোক হতে পারেন না। শিল্পই বলে দেবে কোথায় কী।
‘ঁলক্ষ্মণ মিস্ত্রীর জীবন ও সময়’ গল্পটি পড়ুন। “বুড়ো মানুষ মরলি বড় মজা হয়। ক’বার শুধু হরি হরি বল। হরি হরি। তারপরেই লেডি, লেডিকিনি। শুধু আধপোড়া নাইকুণ্ডুলিটা মাটি মাখিয়ে তাল বানাও। তারপর আদিগঙ্গায় ছুঁড়ে দিলিই কাজ শেষ। লেডিকিনি। তারপর আলুর দম। জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। সব কথা ছাই মনেও থাকে না।”
জীবনের পাশাপাশি মৃত্যু, মানুষের আদিম রিপুর পাশাপাশি বাৎসল্য, বিশ্বাসের পাশাপাশি অবিশ্বাস শ্যামল কখনও দরদ দিয়ে বলতে বলতে নিষ্ঠুরতায় চলে যান। সব ছাপিয়ে যে গল্পে জীবনের স্বাদ, জীবনবোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে সে গল্প প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কোনও বিশ্বেরই ধারে ধারে না। তা ওমনিতেই আন্তর্জাতিক।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাম্পাহাটিতে বসবাসের সময় শ্যামল শুষে নিয়েছেন সেখানকার জল, বাতাস, মাটির গন্ধ, ভোরের শিশির, দূরের ভোর। চাষিদের নিয়ে সমবায় করে চাষ করেছেন ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে। পোকা লেগে ধান খেয়ে যাওয়ায় টাকা শুধতে না পেরে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। খাল কেটে জল এনেছেন। মাঠে হাটে এলোপাথাড়ি জীবনযাপনের ভেতরেই তাঁর দেখা হয়ে যায় হাজারো মানুষের সঙ্গে যারা এক একজন এক একটি বিস্ময়। মানবজীবনের সরল সত্য, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, নারী, সাপ, প্রান্তরের শেষে দাঁড়িয়ে থাকা একা তাল গাছ, এসবই তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি মুগ্ধ করেন পাঠককে। সেসব গল্প-উপন্যাস বেস্ট সেলার নয়। গুণী পাঠক তা খুঁজে পড়বেন।
‘রাখাল কড়াই’ গল্পে নীলাম্বর গায়েন বলে, “ওই যে রূপশাল ধান দেখিছেন ওখানটায়, ঠিক ওই খাক্ মতো জায়গাটায় খুনটো করি।” মনে পড়ে যায় রুশ উপন্যাসে কশাকদের জীবনের দুর্দান্ত নিষ্ঠুরতার কথা। যদিও এ গল্পে শ্যামল এ দেশের জল হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা মিথ, কথাবস্তু ধরে নেন জাদুকরের ভঙ্গিমায়।
গ্রামজীবন নিয়ে গল্প তৈরি করতে হবে, নগরজীবন নিয়েও গল্প লেখা চাই, এ ধরনের কোনও চিন্তা তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি। ‘রাখাল কড়াই’-এর মতো গল্প অন্তত সেভাবে লেখা যায় না। যায় না লেখা ‘বিদ্যুৎচন্দ্র পাল সম্পর্কে কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয়’ অথবা ‘তেওট তালে কনসার্ট’। শ্যামল সম্ভবত এক জীবনে পেরিয়ে যেতে থাকেন অনেক অনেক জীবন, জাতকের মতো। তাই তাঁর গল্প হয়ে ওঠে জাতকের গল্প।
মানুষের অস্তিত্বের পক্ষে পৃথিবী একটি অপরিহার্য শর্ত। সন্তোষজনক বস্তুনিষ্ঠ পৃথিবীর ছবি পাওয়ার খাতিরে লেখক তাঁর বোধশক্তি সরিয়ে রাখতে পারেন না। জল ফিরে আসার মতোই সে ফিরে ফিরে আসে। আমাদের পরিচিত পৃথিবীটার ছবি যে মালমশলায় তৈরি, তা মনেরই নির্মিতি। তার অন্য কোনওরকম অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। লেখকের মন তাঁর নিজের তৈরি করা জগতের বাইরে থাকে। সে জগতে তাঁর কোনও জায়গা নেই। শ্যামল পড়তে গেলে এ কথা মনে রাখতেই হবে। এ কারণেই ‘রাখাল কড়াই’-এর পাশাপাশি পড়ে ফেলা দরকার ‘সিধু পালের হিমসাগর’। দরকার পড়ে নেওয়া ‘বিদ্যুৎচন্দ্র পাল সম্পর্কে কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয়’।
এই একদা উপনিবেশে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির একচেটিয়া মুনাফাবাজি নিয়ে দিস্তে দিস্তে লেখা হচ্ছে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সময়ের আগেই খুব সন্তর্পণে এসব লিখে চুপচাপ বসে আছেন। গল্পে তো বটেই। উপন্যাসেও বাজার অর্থনীতির সমীকরণ তাঁর লেখায় স্পষ্ট।
বিদ্যুৎচন্দ্র পালের মতোই আরও খানকতক গল্পের নাম করতে পারি যা জন্ম নিয়েছে সমাজদর্শন আর পাগলামির জোড়ে। যে পাগলামো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কথিত দৈবী পাগলামো। ডিভাইন ম্যাডনেস। যেমন ‘জীবন্ত বায়ুমান যন্ত্র’। সে গল্পের অনন্তপ্রসাদ পালিত আর বিদ্যুৎচন্দ্র পাল কিংবা ‘পাগলাঘণ্টি’-র কমল গুহ আর লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সবাই একদম একই লোক যে কিনা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। চিন্তার স্বাধীনতা, খেয়েপরে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, কোদালকে কোদাল বলার স্বাধীনতা।
লেখক কোনও সমাজ সংস্কারক নন। তিনি আবিষ্কারক। নিজের বিশ্বাস মতো কথা বলতেই হয় তাঁকে।
ভালোবাসার কথাই তিনি বারবার বলতে চেয়েছেন তাঁর লেখায়। কখনও অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে প্রতিফলিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্ব, যার সার বক্তব্য, আনন্দ। ভালোবাসা। তা ‘পুরকায়েতের আনন্দ ও বিষাদ’-এ একরকম। আবার ‘প্রাতঃভ্রমণ’ কিংবা ‘চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়’ অন্য। না, বরং বলা ভালো দুটোই এক। শিল্পীর কাছে শিল্পের স্বরূপই আনন্দ। শ্রমিকের কাছে তার শ্রম। শিল্পী এবং শ্রমিক দুজনেই একা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রায় সব লেখারই দুটো কাঠামো। ওপরের যে কাঠামো তার নীচেই তিনি লুকিয়ে রাখেন সারবস্তুটি এবং সে বস্তুটিকে কোনওভাবেই গ্রাম বা শহর, কোনও বিশেষ শৈলী বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা কোনও ইজম বা একক-দশক-শতকে বেঁধে ফেলা যাবে না বা ছাঁচে ঢালাই করা যাবে না।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে মন বড় আশ্চর্য বস্তু। আর বস্তুনিষ্ঠ পৃথিবীতে চলে-ফিরে বেড়ানো মানুষগুলো যখন তাঁর লেখার চরিত্র হয়ে ওঠে তখন যা আপাতদৃষ্টিতে বস্তুপুঞ্জ মনে হতে পারে তা-ই হয়ে ওঠে মায়াপৃথিবীর গল্প।
লেখায় টেক্সট বলে একটি বস্তু থাকে। যাঁরা টেক্সট ছাপিয়ে ছাড়িয়ে উজিয়ে চলে যান তাঁরাই সৃষ্টিকর্তা। একইসঙ্গে নিজেকে উপস্থিত আর অনুপস্থিত রাখার লেখা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন অনেক। তাঁর দৃষ্টি ছিল অতিদূর বিস্তৃত। দেখার জগৎটিও ছিল বিশাল। পরের জমিতে গতরখাটা হাজরা নস্কর থেকে শুরু করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান রবি দত্ত পর্যন্ত।
তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে দেখতে পাই, ব্যক্তিমানুষ এই দেশ ও বিশ্বের তাবৎ সমস্যার মাঝখানে পড়ে নিজেকে খুঁজে চলেছে। নগর যে তারই গড়ে তোলা সে কথা উবে গেছে কোথায়। শহুরে যন্ত্রণা রোজ যেভাবে তাকে বিঁধে ফেলে সে কথা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গেছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাসে। কখনও লিখেছেন আপাত হাসিঠাট্টার মেজাজে আর তার ভেতরে এমন কাঁটা যা বুকে লাগলে ধক করে ওঠে।
‘উর্বরাশক্তি’ গল্পে কল্যাণ নিজেকে ‘”সূর্যের নিচে জমায়েত নিরুপায় মানবসমষ্টির একজন মাত্র’” মনে করে। নগরসভ্যতার রীতিই এই যে প্রত্যেক মানুষ নিজেকে অসহায় ও নিরুপায় মনে করার পরও তার উলটো কথাই বলতে চায়। আমরা নিজেকে লুকিয়ে রাখি, রাখার চেষ্টা করে যাই। বাইরের পৃথিবীতে নিপাট ভালোমানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াই আর ভাবি, উলটো দিকের লোকটাই হচ্ছে বদমাশ, খারাপ। এই সিস্টেমের মধ্যেই আমাদের বসবাস। বিশেষ করে শহুরে জীবনে এই সিস্টেম যাতে মসৃণভাবে চলতে থাকে সেজন্য আমরা সতত যত্নশীল। সেখানে নিজে কখনও ধরা পড়ে গেলেই চিত্তির। ‘দূরবীনের উলটো দিক’ দিয়ে দেখতে আমরা কেউ স্বস্তি পাই না।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার জগৎকে ম্যাজিক রিয়ালিজমের জগৎ বললে বোঝানো যাবে না। যেমন ‘দশ লক্ষ বছর আগে’। এই যে মানুষের এত গবেষণা মানুষ নামক প্রাণীটিকে কেন্দ্র করে তার পরিণতি কি আসলে প্রাণের মঙ্গলের জন্য? না কি ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষায়? মানুষও তাহলে আসলে বিলুপ্তপ্রায় কোনও প্রাণীর মতোই নিজেই নিজেকে সরিয়ে দেবে একদিন পৃথিবী থেকে? যে টিকে থাকার প্রশ্ন তিনি ‘দখল’ কিংবা ‘যুদ্ধ’ গল্প থেকে বুনেছেন, তারই এক পরিণতির দিকে তিনি আঙুল তুলেছেন এই লেখাটিতে।
‘নতুন ভুবন’ নামে উপন্যাসটি পড়ুন। এ লেখা এমন একটা সময় থেকে শুরু হচ্ছে যখন আসানসোল থেকে বনগাঁ, পুরোটাই কলকাতা। পরমাণু শক্তিতে গাড়ি চলে, মাথার ওপর হেলি ট্যাক্সি সাঁ সাঁ করে ওড়ে, ক্যানসার চলে গেছে, খবরের কাগজ উঠে গেছে, বাতাবিলেবুর খোসা থেকে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের ওষুধ বেরিয়েছে, একটা সেফটিপিনের মতো জিনিস বুকপকেটে আটকে রাখলে সেটা ঠান্ডা লাগা থেকে আটকায়, প্ল্যাটিনাম এখন তৈরি হয় কারখানায়। আত্মহত্যা মড়কের মতো দেখা দিয়েছে এবং মনখারাপ একটা ছোঁয়াচে রোগ যা কিনা বিকেলের দিকে অ্যাটাক করে বেশি। তাই সাধারণ মানুষের জন্য দুটো ট্যাবলেট বেরিয়েছে। একটার নাম ‘প্রফুল্ল’, আর একটার নাম ‘খুশি। ‘বি বি’ বলে একটা সংগঠন তৈরি হয়েছে। তার পুরো নাম হল, ‘বিবেকহীন বাহিনী’। তারা ঘোড়ায় চড়ে শহরে টহল দেয়। ইচ্ছেমতো মানুষ তৈরি করার ক্ষমতা এখন রাষ্ট্রের হাতে। এইরকম এক সময়ে একজন বিস্মৃত ঔপন্যাসিক একটা উপন্যাস লিখতে বসেছেন। এই উপন্যাসকে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান পাঠক সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে পড়তে পারবেন।
একটি দেশ গড়ে উঠলে ইতিহাসের তলায় চাপা পড়ে যায় মানুষ। তার ওপরে রাষ্ট্রযন্ত্রটি যে বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত কিংবা ব্যতিব্যস্ত থাকে তা নিয়ে রিপোর্ট লেখা হয় খবরের কাগজে। মাঝখানে বসে থাকেন লেখক। জিজ্ঞাসু মন নিয়ে শিল্পসম্মতভাবে লিখে চলেন তিনি। তাঁর দেখা বাধা পায় না, ভাষা হারায় না। যেমন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়।
বেহালা বাজানো খুব কঠিন। বাঁশিও। প্যাথোজ এই দুটি যন্ত্রে ভালো আসে। তবু জীবনের মূল সুরটি তো আনন্দের। বড়ো শিল্পী তাঁর খেলা দেখাবেন সেখানেই। সেখানে আমরা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দিকে এখনও তাকিয়ে থাকি। আরও এক জাতকের গল্পের জন্য। গোদা লেখার পাঠক যাঁরা নন তারা খুঁজেপেতে শ্যামল পড়েন। যাঁর দৃষ্টি বিশাল এবং বিচার ধীর, সময়ের ধুলো সরিয়ে তাঁকে দেখতেই হবে। বট গাছের বীজশক্তিকে অস্বীকার করার কোনও রাস্তা নেই।
যেদিন যেদিন লেখককে পড়ব, সেদিনই তাঁর জন্মদিন। আজও তাই।