
রবি আড্ডায় শৌভিক রায়
(পর্ব-১)
লিস্টে চব্বিশ জন। শেষ নামটা আমার।
দিনহাটা কলেজের ইংরেজি অনার্সের সেই লিস্ট আমাকে দেখে রীতিমতো ব্যঙ্গ করছিল যেন!
আসলে একেই বলে স্বর্গ হইতে পতন
। সেটা নয়ত কী! মাত্র দুই বছর আগে, ১৯৮৫ সালে, মাধ্যমিকে পেয়েছিলাম ৭২ শতাংশ নম্বর। উচ্চ মাধ্যমিকে একেবারেই যা তা। বাহাত্তর শতাংশ নম্বর নিয়ে আমাদের সময়ে আর্টস পড়বার রেওয়াজ ছিল না। খানিকটা যেন প্রথা ভেঙেছিলাম। উচ্চ মাধ্যমিকে দারুণ কিছু করব, সেটা কখনই ভাবিনি। কিন্তু তাই বলে এই নম্বর!
সেই বছর অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে, উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণের হার অত্যন্ত কম। যতদূর মনে পড়ছে ৩৯.৭%। আমাদের স্কুলে ফার্স্ট ডিভিশন কেউ নেই। অথচ মেধাবী ছাত্র ভর্তি আমাদের ব্যাচে। সায়েন্সে যেখানে এই অবস্থা, সেখানে আর্টস আর কমার্সের হাল কী সেটা তো বোঝাই যায়!
ফালাকাটায় তখন শুধুমাত্র ফালাকাটা হাই স্কুলেই উচ্চ মাধ্যমিক পড়ানো হত। মোটামুটিভাবে পুরো ব্লকে একটাই উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। বহু দূর থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসতো। প্রত্যেকের শোচনীয় দশা। অধিকাংশই ফেল। যারা পাস করেছে তাদের নম্বর অত্যন্ত বাজে। কিছু বিষয়ে অনেকের একই নম্বর। টোটাল মার্কসও এক।

দিনহাটা কলেজে ভর্তির লাইনে দাঁড়িয়ে শুধু একটা প্রশ্নই মনে ঘুরেফিরে এসেছিল। ইলেভেনের ফাইনালে আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান খাতা কৃষ্ণ স্যার (শ্রী কৃষ্ণ দেব তখন আমাদের স্কুলে ডেপুটেশনে চাকরি করছেন) জলপাইগুড়ির এ সি কলেজের অধ্যাপকদের দেখতে দিয়েছিলেন। তারা ৯৫% নম্বর দিয়েছিলেন। সেই আমিই উচ্চ মাধ্যমিকে পেলাম ৫২ শতাংশ। মাত্র কয়েক মাসে এত বাজে হয়ে গেলাম লেখাপড়ায়! নাকি অধ্যাপকরা ভুল দেখেছিলেন?
দুরন্ত বাজে রেজাল্ট করে চরম বাজে অবস্থা আমার। যারা কোনও দিন ধারে পাশে আসেনি, তাদের অনেকে আমার চাইতে বেশি নম্বর পেয়েছে। কোথায় পড়ব, কী পড়ব কিছুই বুঝতে পারছি না। আর্টস নিয়ে পড়েছি। অনেক দিকের রাস্তাই বন্ধ। অনার্স ছাড়া পড়বার কিছু নেই। যে মার্কস পেয়েছি তাতে তথাকথিত ভাল কলেজ জুটবে না বুঝতে পারছিলাম। তবুও কোচবিহারের এ বি এন শীল কলেজ, জলপাইগুড়ির এ সি কলেজ, শিলিগুড়ি কলেজ, আলিপুরদুয়ার কলেজ ইত্যাদিতে ফর্ম ফিলাপ করলাম। ফালাকাটায় কলেজ থাকলেও, তখন অনার্স পড়ানো হত না।
হঠাৎ মনে হল দিনহাটা কলেজে ফর্ম ফিলাপ করা দরকার। দিনহাটায় আমাদের পৈতৃক বাড়ি। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে, স্বাধীনতার সময়, ঠাকুরদা দিনহাটায় বাড়ি করেন। কাকুরা ওখানেই। একান্নবর্তী পরিবার। বাবা-মা দুজনেই দিনহাটায় শিক্ষকতা করতেন। পরে চলে আসেন ফালাকাটায়।
জুন-জুলাইয়ের প্রবল বৃষ্টির দিন সেবার। পুণ্ডিবাড়ির রাস্তা তখন ছিল না। ফালাকাটা থেকে কোচবিহার যেতে হত নিশিগঞ্জ হয়ে। সেই রাস্তায় ব্রিজ ভেঙেছে। সেটা বন্ধ। মাদারিহাট হয়ে হাই রোড ধরে চিলাপাতা-পুণ্ডিবাড়ি পথ বন্ধ। ফলে মাদারিহাট হাসিমারা-কালচিনি-রাজাভাতখাওয়া-আলিপুরদুয়ার-বানেশ্বর হয়ে কোচবিহার। সেখান থেকে দিনহাটা। আজকের মতো চকচকে রাস্তা নেই। কাঠের নড়বড়ে ব্রিজ সব। পৌঁছতে প্রায় একদিন শেষ। যাহোক ফর্ম ফিলাপ হল।
এ বি এন শীল কলেজ পাত্তা দিল না। কোনও বিষয়েই চান্স পেলাম না। আলিপুরদুয়ার কলেজ, এ সি কলেজ আর শিলিগুড়ি কলেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সুযোগ দিল। একমাত্র দিনহাটা কলেজে ইংরেজি অনার্স পেলাম। চব্বিশ জনের মধ্যে শেষ নাম আমার।
দিনহাটা গোপালনগর শরণার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রিয়ের অর্ধেক পড়েছিলাম। দুর্গাপুজো ছাড়াও মাসে-দু`মাসে দিনহাটায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমাদের। আত্মীয়-স্বজন কমবেশি অনেকেই দিনহাটায় থাকেন। বাড়িতে নিজেদের খান দুয়েক ঘরও আছে। মোটামুটি সব রাস্তাঘাট চেনা। সমবয়স্ক আত্মীয় ভাই, বন্ধু সবাই আছে। প্রত্যেকেই ভালবাসে। আমাদের বাড়ি মসজিদের উল্টোদিকে, বড় রাস্তার ধারে। থানা পাড়া আর গোধূলি বাজারের ঠিক মাঝখানে। কলেজ মেরেকেটে দেড় কিমি। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চাইতে ইংরেজি অনার্স পরবর্তীতে চাকরির ক্ষেত্রে সুবিধে দেবে।
সব কিছু ভেবে দিনহাটা কলেজের ইংরেজি অনার্স ভর্তির লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমার আগে তেইশ জন…..
(ক্রমশ)
- ছবি- সংগৃহিত