রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ

যশোর রোডের (দেখলেন তো বাঙালির বর্ষবরণ নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই  ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে ফেললাম, দেখুন কানের কি মোহিনীমায়া, যশোর রাস্তা/পথ কিছুই শুনতে ভালো লাগছে না, কানটাও কি পচে গেছে না শব্দের দাসত্ব মেনে নিয়েছে?) বৃক্ষ নিধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে বাঙালির নতুন বছর। হা রে আমার উৎসবে ব্যসনে মত্ত বাঙালি, হা রে আমার সৌজন্য শিষ্টাচারের আতিশয্যে মত্ত বাঙালি, গাছগুলিকে কি কোনোভাবেই বাঁচানো গেল না? গণতান্ত্রিক স্তম্ভে মানুষ ইচ্ছা করলে যেকোনো ন্যায্য অসাধ্য সাধন করতে পারে। যে বৃক্ষগুলি নিধন হবে তার বদলে পঞ্চাশ বছরেও সমোপযোগী বৃক্ষ গড়ে উঠবে না। কোথায় গেল পরিবেশবিদরা? আমরা এমন কি আধুনিক হলাম যে বৃক্ষনাশ করেই সভ্যতার অগ্রগতির রথচক্র এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে? কোথায় দাঁড়াবে বাঙালির ভবিষ্যৎ। কয়দিন পর প্রচণ্ড দাবদাহে যখন মানুষ পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, স্কুলগুলিকে গরমের নামে ছুটির মক্কা মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে তখন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন। মৌসুমীদি যশোর রোড নিয়ে আবার নতুন গান হবে কি? সময়ের গান!

 আমরা তো কতকিছুই করি, গাছকে দত্তক নিতে পারি না? শহরে স্থানাভাবে ইচ্ছা থাকলেও গাছ লাগানোর পথ নেই। গ্রামের মানুষ গাছ লাগায়। অভাবে তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। গ্রামের মানুষের কাছে বাড়ির আনাচ কানাচ, আলের ধার গাছ লাগানোর একটা বিস্তৃত পরিসর। শুধু তাই নয় গ্রামের মানুষ জানে গাছটি দশ/কুড়ি বছর গেলেই একটা অর্থ জোগান দেব। চিকিৎসা বা কন্যার বিবাহে যা অব্যর্থভাবে ব্যবহার করা যাবে। সরকার তো কত উদ্যোগ নেয় এই গাছগুলিকে দত্তক নেওয়া যায় না? সরকার না নিলে সভ্য মানুষের বিবেক তো পারে! ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করে আর কী করবেন, একদিন তো চিতাকাঠে যেতেই হবে, আমরা তো সেইদিকেই চলছি ব্রুটাস। পঙ্গুশিশু দ্বারা সমাজের যেমন কোনো উপকার হয় না তেমনি গাছ লাগানোর সময় গাছের গুণগত মান বিচার করে নেওয়া জরুরি। লাগে একটু বেশি টাকা লাগুক। কেননা দশ বছর পর গাছটি মৃত হলে আপনার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ। সরকারি প্রকল্পে যে গাছগুলি দেওয়া হয় তার গুণগতমান একেবারে জঘন্য। এইভাবে সৎচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। আমফানের সময় দেখলাম সমস্ত গাছ ভেঙে পড়ছে। অপক্ব ইঞ্জিনিয়ার, বনদপ্তর, ঠিকেদার তো জানেই না কোন গাছের শিকড় মাটির গভীর থেকে গভীরতর তলদেশে পৌঁছে যায়। ওইসব আলগা ভিত্তিহীন ভাবনা দ্বারা বউয়ের মন জোগানো যায় সভ্যতার উন্নতি অসম্ভব।

 বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ভাষাদিবস, ঐতিহ্যের শিকড়ে জল দেওয়া সব মেনে নিলাম। প্রকৃত আধুনিকতা আসে স্বীকারের মধ্য দিয়েই। সেই স্বীকার যদি সৎ হয়। প্রত্যেক উদ্যোক্তাই সৎ সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু আমরা যারা মত্ত হব তারা অন্তর থেকে আন্তরিকভাবে সৎ হলেই বাঙালির মঙ্গল। বাঙালির বাঙালিয়ানার শোভাযাত্রার ঘট কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। বর্ষবরণ মানেই তো নূতন বছরের সূচনা। আমরা আমাদের চেতনাকে কি নতুন করব না? চেতনায় যে পলি জমে গেছে তা কি নতুন আলোয় দীক্ষিত করব না?

 আলপথ দিয়ে বয়ে গেছে অনেকটা সময়। বাঙালি নিজের মেধা, পরিশ্রম নিয়ে উচ্চশিখরে পৌঁছেছে। আধুনিকতার জোয়ারে সন্তানের নাম হিসেবে আজ চিত্তরঞ্জন, প্রফুল্ল, বিনয় বাদল দিনেশ, ক্ষুদিরাম, সুভাষচন্দ্রের নাম রাখার দিন অস্তমিত হয়েছে কিন্তু চেতনাগুলিকে কিন্তু আজ বড় করে দেখার দিন এসেছে। অথচ আজ বাঙালির মজ্জায় মজ্জায় পচনের গন্ধ। কে রক্ষা করবে? বাঙালিকেই আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। নিজের স্বজাতি স্বগোত্রকে রক্ষার দায় নিজেকেই নিতে হবে। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ বা ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইলেই হয়না মজ্জায় মজ্জায় যতক্ষণ জাতিচেতনা না গড়ে উঠবে ততক্ষণ পথ নেই। একটিই জাতি পরিচয় হোক—বাঙালি। একুশ শতকের এই দহনবেলায় বারবার দেখছি উপজাতি, ধর্মকে সামনে রেখে এত শ্রেণিবিভাজন যা সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদতে চলছে যা বাঙালির বৃহৎ সত্তাকে কিন্তু ভেঙে দিচ্ছে। আপনার জাতি, পদবি, ধর্ম, নিজের শিকড়-সংস্কৃতি সন্ধান সব ঠিক আছে কিন্তু তা যেন বাঙালিয়ানা থেকে পৃথক না হয়ে যায়। বাঙালিয়ানাকে ছাপিয়ে পৃথক মেরুকরণ না গড়ে তোলে। সমূহ বিপদ ঘটছে, ঘটে যাচ্ছে। বাঙালিকে খণ্ড খণ্ড করার যে বৃহৎ প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক শাসনপর্ব থেকে চলছে তার নাটবল্টু হয়ে আপনি সেই ফুটোকে আর বড় করতে দেবেন না। ইহাই বৈশাখের বর্ণপরিচয়।

 হরদম শুনতে হয় সেই যুগ আর এই যুগ, সেই বাঙালি আর এই বাঙালি। তবে বাঙালির ভাঙন শুরু হল কোথা থেকে? সে অনেক প্রশ্ন। যা কিছু বাঙালির শ্রেষ্ঠ তা গতকালই শেষ হয়ে যায়নি। আজও চলছে বহমান হিসেবে। দেখরে নয়ন চক্ষু মেলিয়া। তবে ধর তকতা মার পেরেক জাতীয় স্বভাববিলাস থেকে বেরিয়ে এসে সত্যি যদি ঐতিহ্যের ধারকবাহক হিসেবে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার থেকে আনন্দের কিছু নেই। বৈশাখ সেই অঙ্গীকারের বার্তালিপি। শপথ গ্রহণের আদর্শ সময়। বাঙালির জয় পতাকা যারে দাও তারে দাও বহিবার শক্তি। নবীন শিশুর মধ্যে বাঙালিয়ানা জাগাতে হবে। দূষিত পরিবেশ, অপসংস্কৃতির চারপাশে থেকেও নিজের শিশুকে জাতির সংস্কৃতির অংশ হিসেবে কীভাবে বড় করে তুলবেন সেই দায়-দায়িত্ব আপনার। সাংস্কৃতিক বিপ্লব এইভাবেই শুরু হয়।

 কবিগুরু বর্ষশেষে নতুন চেতনার আহ্বান জানিয়ে পুরাতন বৎসরের অপরাধ ক্ষমা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বড় বাজার, ছোট বাজার চৈত্র সেল দিয়ে পুরাতনকে বিদায় জানাতে চাইবে। তবে আমরা কেন আমাদের পুরাতন সংস্কার, ভিত্তিহীন বিশ্বাস, সংস্কৃতির নামে কুসংস্কারকে বিসর্জন দেব না? কীভাবে জন্ম হয় নতুনের? প্রথামাফিক দিনের পালা বা পূর্ব আকাশে প্রত্যহ সূর্য ওঠার মধ্য দিয়ে নতুনের যাত্রা শুরু হতে পারে না। গ্রহণ-বর্জন, যুক্তি পরম্পরায় সময়ের নথিনক্ষত্র বিচার, তুমুল তর্ক, ঐতিহ্যকে বাঁচানোর জেহাদ ও মূল স্তরের বিপরীতে বিকল্প ভাবনার জাগরণের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে নতুনের। অস্থিরতার চামড়া থেকে স্থিরতার স্থির বিন্দু, জীর্ণতার গ্রন্থিমোচন করে উজ্জীবনের আলোকস্তম্ভ, প্রতিলিপির বদলে আদর্শলিপির যথার্থ ভিত্তিস্থাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জয়যাত্রা সূচিত হোক।

 নবচেতনা, নতুন-নবীনকে বরণ করার পক্ষে বারবার সাওয়াল হয়েছেন রবিঠাকুর। আজকের সমাজবীক্ষণে কোন নতুনকে আমরা বরণ করব? আলসেমিভরা বিকেলে দুরন্ত বাইকে ছুটে চলে মদে মত্ত বা চায়ের সঙ্গে সিগারাটের ধোঁয়ায় তুফান তোলা বালক-বালিকার চেতনাহীন সংস্কৃতিহীন, রাজনীতিহীন ফ্যাশান শো না অন্য কিছু! গুরু পুচ্ছিও জান। গুরুবাদের দেশে গুরুর বিশ্বাসও তো আজ অচল। তবে পরিবারই হয়ে উঠুক যথার্থ মানদণ্ড ও মেরুদণ্ড নির্ধারণের উপযুক্তক্ষেত্র।

 মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে অমঙ্গলবোধও কি আছে? শুভ-অশুভ, পবিত্র-অপবিত্র, মঙ্গল-অমঙ্গল, কল্যাণ-অকল্যাণ কিছুই বুঝি না কেবল বুঝি ন্যায়-অন্যায়, নৈতিক-অনৈতিক, সৎ-অসৎ। ঝরাপাতার দিনে মুণ্ডুহীন বৃক্ষের করুণ আর্তনাদে যখন চরাচর ভেসে যায় তখনও প্রকৃতি তো আলোরই গান গায়। আমরা কেন গাইব না? কচি পাতার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি যখন নবীনকে বরণ করে নিতে উন্মুখ তখন আমরা কেন বরণ করব না? কেউ কেউ এই উৎসব দেখে বিদ্রুপ করবেন, তারা চিরকালই ব্যঙ্গবাজ, বাঙালির ভালো কোনোদিন তাদের চোখে পড়েনি, পড়লে বাঙালির জয়রথ বিশ্বে সমানতালে বয়ে যেত।

 বাজে জয়ের মন্ত্র। ঐ আসে বাঙালির বিজয়কেতন। বাজুক বাজুক মাভৈঃ মাভৈঃ রব। বাউলের বীণায় বাজে যে মৈত্রীর গান সেই পথেই বাঙালির মুক্তি। ক্রমমুক্তি। এসেছে নবীন প্রহর, ওরে দরজা খুলে দে, বরণ কর নতুনের জয়ধ্বজা। বাজাতে জানলে, গাইতে জানলে যেকোনো উপকরণেই সুর তোলা সম্ভব। হোক তা ভাঙা। আগুনখেকো বৈশাখের দহনবেলাও আমাদের কাছে মিলনমেলা, ভুবনবেলার স্বপ্ন নিয়ে খেলা।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *