রবি আড্ডায় শৌভিক রায়

পর্ব – ৭

  • মোক্ষদা পিসি ছাট দিয়েছিস কেন?
    মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা। একেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি। তার ওপর এরকম কমপ্লিমেন্ট। কোনও মেয়েই আশা করবে না। রীনাও করেনি। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। এমনিতেই আমি মোটামুটি বাতিলে ছেলের দলে নাম লিখিয়েছি। যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই। যা ইচ্ছে করি। তবে ওকে রাগাতে ভালই লাগে। হয়ত আর কিছুদিন পরে হলে মোক্ষদা পিসির বদলে রেণুকা সাহানের চুলের কথা বলতাম। কিন্তু তখনও সিদ্ধার্থ কাক আর রেণুকা সাহানের সেই বিখ্যাত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সুরভি শুরু হয়নি। শুরু হয়নি প্রণয় রায়ের The World This Week। এই দুটো অনুষ্ঠানের উল্লেখ করলাম একটাই কারণে। খবর কী ও কীরকম হওয়া উচিত সেটা চোখে আঙুল দেখিয়েছিলেন প্রণয় রায়। আর সুস্থ সংস্কৃতি বলতে ঠিক কী বোঝায় সেটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল সুরভি।

সার্বিকভাবেই অবশ্য তখন সংস্কৃতি চর্চার অন্য যুগ ছিল। ফালাকাটায় নিয়মিত নাটক করতাম। যুক্ত ছিলাম নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। এখন অবশ্য সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। আসলে একটা চরম হতাশা ক্রমশ ঘিরে ধরছে। সেখানে দাঁড়িয়ে সত্যিই কিচ্ছু ভাল লাগে না। অন্তত অংশ নিতে। নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতেই বেশি ভাল লাগছে এই সময়টায়। রাতে নিজের ঘরে ইলেকট্রিক টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে থাকি চেয়ারে। সামনে কখনও খোলা থাকে পাঠ্য বই, কখনও অন্য কিছু। রাত জেগে পড়ে ফেলছি কামুর আউটসাইডারথেকে সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই চরিত মানস। নিজের মধ্যে ডুবে থাকতে সাহায্য করছে কোনও নিষিদ্ধ বস্তু। সে যেন নতুন করে চেনাচ্ছে নিজেকে।

ছবি- তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে দিনহাটা মদনমোহন বাড়ি শিশু সংস্থা আয়োজিত শিশু উৎসবে আমার দুই বোন ঝিনি ও রিনি।

তবু দিনহাটার মতো শহরে সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকা মুশকিল। এখানে মদনমোহন বাড়ির শিশু সংস্থা সি এল টি (চিলড্রেন্স লিটিল থিয়েটার) অনুমোদিত। পয়লা বৈশাখ হলের মাঠে শ্রদ্ধেয় কমল গুহর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় সংহতি উৎসব। কোনও বার গান শুনিয়ে যান রুমা গুহঠাকুরতার ক্যালকাটা ইয়ুথ ক্যয়ার, কখনও অজিত পান্ডের মতো গায়করা। আরও কয়েক বছর আগে ওই মাঠেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত মানুষরা এসেছিলেন। শুনিয়েছিলেন তাঁদের লেখা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মেজাজ শুনেছিলাম মুগ্ধ হয়ে। আগামীতে আসছেন ফুলবউ খ্যাত আবুল বাশার।

নির্মোহ হয়ে সব দেখছি। অংশ নিচ্ছি না কিছুতে। শ্মশানের চিতা বড্ড আপন মনে হচ্ছে। পুজোর অষ্টমীর দিন তাই চলে গেলাম বাবুনদের বাড়ির দীর্ঘদিনের পরিচারক বলোদা-কে দাহ করতে। মাত্র পাঁচজন। কাকিমায়েদের প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু শবদেহ কাঁধে হাঁটা আর চিতার আগুনে নিজের ভবিষ্যৎ দেখার যে ভীষণ টান সেটা অস্বীকার করব কীভাবে! রাতের বেলাতে তাই কখনও বাবুন, কখনও মধুর সঙ্গে চলে যাই। ঘাটে বসে থাকি। হয়ত কেউ পুড়ে যায়। চুপচাপ দেখি। কখনও কারও বুকফাটা আর্তনাদ শুনি, কখনও শববাহী মাতালদের লাম্পট্য দেখি। কিছুই স্পর্শ করে না। নিজের মধ্যে এভাবে থাকতে থাকতে কখনও মনে হয় নেমে যাই অতলে। ভেসে যাই চিতাভস্মের মতোই।

অধ্যাপক অলোক গঙ্গোপাধ্যায় সেই সময় দিনহাটার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত পরিচিত নাম। তাঁর লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রগতি নাট্য সংস্থাও তাঁর নাটক রিহার্সাল দিচ্ছে। সেজকাকু মদন রায় প্রগতির পরিচিত মুখ। শ্রদ্ধেয় নারায়ণ সাহা, সীতাংশু শেখর মুস্তাফি প্রমুখদের সঙ্গে তিনিও রয়েছেন। আমার দুই খুড়তুতো বোন ঝিনি আর রিনি মদনমোহনবাড়ি শিশু সংস্থায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে। বাড়িতে গান শেখাতে আসেন লোকেশকাকু। নাচ শিখিয়ে যান লিলিমাসি। লোকেশকাকুর বাড়ি মদনমোহন পাড়ায়। গায়ক হিসেবে দিনহাটায় সুনাম রয়েছে। লিলিমাসি দিনহাটা গার্লস হাই স্কুলের পাশের রাজকুমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিদিমণি। একসময় দিনহাটার স্পোর্টসের মাঠের পরিচিত মুখ। লিলিমাসির অন্য ভাই-বোনেরাও খেলাধুলায় ভাল।

কলেজের স্যারদের মধ্যে কে ডি স্যারের কথা শুনেছি। লেখক হিসেবে পরিচিত উনি। ওঁকে দেখি দূর থেকে। ডিপার্টমেন্ট আলাদা। তাই সেভাবে চেনা হয়ে ওঠে না। জানা হয় না শওকত আলি স্যারকেও। স্কুল জীবন থেকেই ওঁর কথা শুনে আসছি। নকল করা ছাত্রদের ত্রাস উনি। হঠাৎ একদিন এস সি (সুশান্ত চক্রবর্তী) স্যার ডাকলেন। ওঁর বাড়িতে সাহিত্য আলোচনা হবে। যেতে বললেন। গুটিগুটি পায়ে হাজির হলাম। এইরকম আলোচনা সভা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। তাছাড়াও সব কিছু থেকে সরে আছি। ফলে শ্রোতা ছাড়া আর কোনও ভূমিকা ছিল না।

ক্রমে শীতকাল চলে এলো। দিনহাটার শীতকালের অন্য একটা আমেজ আছে। শহরের ফুসফুস হলের মাঠ শিশিরে ভিজে থাকে। কুয়াশায় হারিয়ে যায় রাস্তাগুলো। কলেজের বিরাট মাঠ কেমন যেন মনমরা লাগে। তবে দুপুরের হালকা রোদ পিঠে লাগিয়ে আড্ডা জমে ভাল। কলেজের পাশেই প্রদীপদাদের মুদি দোকান। মাঝেমাঝে সেখানে বসে আড্ডা দিই। ক্লাস করি। কখনও বাপ্পা আর আমি উঠে পড়ি বুড়ির মন্দিরের গড়ে। ওপর থেকে নিচে তাকাতে ভাল লাগে। বিভিন্ন দিকে হরিনাম সংকীর্তন শুরু হয়েছে। আমাদের বাড়ির কাছে, থানার পাশের, শিবমন্দিরেও চলছে। অনিলকাকু আমাকে নিয়ে চললেন সেখানে একদিন। কাকু যে আধ্যাত্মিক জগতের দিকে ঝুঁকেছেন সেটা বুঝতে পারছিলাম অনেকদিন থেকেই। কোচবিহার পুরোনো পোস্ট অফিস পাড়ার দুর্গাপুজোতে এবার চন্ডীপাঠ করেছেন। কীর্তনের আসরে বসে আমাকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন কোনটা কী। কলেজের মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক আর তার সঙ্গে জিনস পরা তরুণ- কীর্তনের আসরে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলাম আমরা। মুহূর্তে মুহূর্তে সবাই ধ্বনি দিচ্ছেন আর কাকু হাপুস নয়নে কাঁদছেন। এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।

ভোরের শিশির ঝরে আমার ঘরের টিনের চালে। টুপটাপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। গাড়ি চলাচলের শব্দ কানে আসে। দিনের শুরু হচ্ছে বুঝতে পারি। এই রকম এক দিনের শুরুতেই ঠাকুমা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অসুস্থ মানুষটি আর পারছিলেন না…..

(ক্রমশ)

পর্ব – ৬

https://www.facebook.com/share/p/1CFpbPq6RK/

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *