
রবি আড্ডায় শৌভিক রায়
পর্ব – ৫
প্রত্যেকটি শহরের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। আবার শহরের ভেতর এক একটি জায়গায় এক এক ধরণের গন্ধ।
দিনহাটার মহামায়াপাটের গেলে তেল-ডাল-নুন-চিনি-চাল সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যেত। অনেকটা কোচবিহারের মীনাকুমারী চৌপথি এলাকার মতো। আবার সাহেবগঞ্জ রোডের লেভেল ক্রসিং আসবার আগে, বাঁ দিকে যে রাস্তাটা বলরামপুর রোডে গিয়ে মিশেছে, সেই রাস্তায় পাটের গন্ধ লেগে থাকত সবসময়। এই রাস্তার ওপর থাকা ভিডিও হলটি বেশ রমরম করে চলে। রাজ্যের ভিড় দুপুর থেকে। তামাকের গন্ধ পেতাম চওড়াহাট পেরিয়ে আর ঝুড়িপাড়ায়।
এই গন্ধগুলোর সঙ্গে মিশে থাকত আমার খুব ছোটবেলা। তখন কাবলিকাকু আমাকে তাঁর ফুল চেন কাভার
সাইকেলে চাপিয়ে সারা দিনহাটা ঘুরে বেড়াতেন। তখন অনেকেই জানত আমি কাবলিকাকুর ছেলে। কাবলিকাকু মানে মির্জা খান। আফগানিস্থানের মানুষ। ওঁরা কয়েকজন মিলে দিনহাটায় ব্যবসা করতেন। তাঁদের ডেরা ছিল আমাদের বাড়ির উল্টোদিকেই। কাবলিকাকু দিনহাটার এক মহিলাকে বিয়েও করেছিলেন। তাই কাবলিওয়ালার বাঙালি বৌ বললে আমি আজও ওই মহিলাকেই বুঝি। ওঁকে দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন কাবলিকাকু।
সন্ধেবেলায় আর ছুটির দিনে দিনহাটায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই আর কাবলিকাকুর কথা মনে পড়ে। এই রাস্তা দিয়ে কাবলিকাকু নিয়ে যেতেন, ওই রাস্তায় শর্টকাট করতেন। কখনও দাঁড়িয়ে পড়ি প্রপন্ন আশ্রমের সামনে। মনে পড়ে এখানেই প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম। অনুপকাকু নিয়ে আসতেন স্কুলে। অনুপকাকু এই মুহূর্তে আমার যে ছোটকাকু অর্থাৎ সুদীপকাকুর বন্ধু। আসলে আশুকাকু ছিলেন আমার সবচেয়ে ছোট কাকু। ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবলে হেড করতে গিয়ে আঘাত পান মাথায়। মাত্র তিনদিনের জ্বরে চলে যান। ওঁর মৃত্যু আমাকে এতটাই আঘাত দিয়েছিল যে, ক্লাস থ্রি-তে দিনহাটা ছেড়ে, মা কে ছেড়ে, চলে গিয়েছিলাম বাবার কাছে ফালাকাটায়।
কিন্তু চাইলেই কি আর ছেড়ে যাওয়া যায়? বোধহয় না। আসলে পুরো জীবনটাই বৃত্তপথ। যেখানে শুরু, সেখানেই শেষ। অথবা শুরু থেকে শুরু করে ফিরে আসা শুরুতেই। ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিক যুগের মহাকবি এলিয়টের কথা ধার করে বলছি।
পিসতুতো ভাই বাপ্পার দৌলতে মদনমোহন পাড়ার তাপসের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। ঝকঝকে ছেলে। আগে থেকেই তপন কর্মকার আর নির্মাল্য ঘোষকে চিনতাম। এছাড়াও নায়কের মতো চেহারার সঞ্জয় মুখার্জি, প্রলয় কুণ্ডু, বিপুল আচার্য, বিপ্লব (টাইটেল ভুলে গেছি) ভাল বন্ধু হয়ে গেল। তবে সবচেয়ে বেশি ভাব জমে গেল সুদর্শন সোমুর সঙ্গে। কোচবিহারের সোমু দিনহাটার বিখ্যাত দোকান রকমারির সাহা পরিবারের কী যেন হত। দুজনেই একসঙ্গে কলেজ যাতায়াত করতাম। কখনও সঙ্গী হত সোনা।
সোনা ডঃ আশিষ চক্রবর্তীর বাড়ির মেয়ে। ওদের একটি দোকান আছে। লক্ষ্মী ভান্ডার। পরিবারটি দিনহাটায় বেশ পরিচিত। ডঃ চক্রবর্তী নামী মানুষ। প্রচুর রুগী তাঁর। ওঁর একমাত্র মেয়ে রাখু আমাদের একটু বড় ছিল। ওই পরিবারেরই আর এক মানুষ ছিলেন বীরু দাদু। দিনহাটা গার্লস স্কুলের অফিসিয়াল কাজকর্ম সামলে, উনি এখন অবসর জীবনে। সোনার বন্ধু মৌসুমী, পপি, মাধবীরা আমার আর সোমুর বন্ধু হয়ে গেল। সোনাদের ঠিক পাশেই একাদশী ভান্ডার। সেই বাড়ির ছেলেরা আমাদের দাদা। মেয়েরা দিদি বা বোন। ওই বাড়ির বুড়ি হল আমার দিদি-বোন-বন্ধু-অভিভাবক।
কলেজে যাই। আসি। ক্লাস করি। ইংরেজি অনার্সের সঙ্গে পাস সাবজেক্ট হিসেবে ইকোনোমিক্স আর পলিটিক্যাল সায়েন্স শুনে অনেকে অবাক হয়। আমার কিন্তু দিব্যি লাগে এই দুটো বিষয়। কলেজে স্থায়ী অধ্যক্ষ নেই। পালা করে অন্য অধ্যাপকেরা কাজ চালাচ্ছেন। এই মুহূর্তে অধ্যাপক কৃষ্ণচন্দ্র চ্যাটার্জি (কে সি সি) কলেজের দায়িত্বে। ওঁর কেন জানি না ধারণা হল, আমি ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। সুতরাং বাংলায় লেকচার দিয়ে আমার জন্য সেটা আবার ইংরেজিতে তর্জমা করেন। স্যারকে বলতে যাব যে, সেটার দরকার নেই, দেখি দুই মাড়োয়ারি সহপাঠিনী ইশারা করছে আমার দিকে তাকিয়ে। আসলে ওরা বাংলায় সড়গড় নয়। ইংরেজি খানিকটা বোঝে। প্রতিদিন ক্লাস শেষ হয়ে গেলে ওদেরকে স্যারের ক্লাসটা হিন্দি-বাংলা-ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিতে হত। তবে শুধু কেসিসি স্যারের নয়, সব স্যারেরই।
অধ্যাপক প্রণব কুমার সমাজদার (পি কে এস) অত্যন্ত জনপ্রিয়। ওঁর পড়ানো এতটাই ভাল যে, বিকেল চারটে অবধি বসে থাকতেও কষ্ট হয় না। স্যার নিতাই চক্রবর্তী আমেরিকা থেকে পি এইচ ডি করে এসেছিলেন। অমিতাভ বচ্চনের মতো লম্বা, ব্যারিটোন গলা। ওঁর ব্যক্তিত্ব ভীষণ আকর্ষণীয়। সম্ভবত ওঁর স্ত্রী কোনও একসময় ফালাকাটা কলেজে লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। আর ওঁর দিদি ছিলেন ফালাকাটা হাই স্কুলের শিক্ষক দীপক ব্যানার্জির স্ত্রী ভক্তিকাকিমা। উনি কীভাবে যেন চিনে ফেললেন আমাকে। কাজেই ওঁর ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার উপায় ছিল না।
ফাঁকি দিতে পারিনি অধ্যাপক জীবনেশ্বর মিশ্রর ক্লাসও। এমন কি লাস্ট বেঞ্চে বসারও উপায় ছিল না। ওঁর শ্যেন চক্ষু ঠিক খুঁজে নিত কোথায় আছি। কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিলে খেঁকিয়ে উঠতেন। কেন জানি ওঁর ধারণা ছিল আমি জানি। কিন্তু বলছি না। অস্বীকার করব না, আগে থেকে পড়ে ফেলেছিলাম বলে উত্তরগুলো জানতাম। কিন্তু কলেজের ক্লাসে, কোন ছাত্র কবে বাচ্চাদের মতো উত্তর দেয়! কিন্তু স্যারের ক্লাসে সেটি হওয়ার জো নেই। কুঁকড়ে থাকতাম। তাপস অবশ্য ঠেলে গুঁতিয়ে আগে বসিয়ে দিত আমাকে। নিজেও বসত। কেননা স্যারের ছেলে বিজয় আমাদের সহপাঠী ও ভাল বন্ধু। আমরা যদি ঝামেলা করি ও সমস্যায় পড়বে। বিজয় অত্যন্ত ভদ্র ও নরম ছেলে। ও মাঝেমাঝে আমাদের নিয়ে যায় ওদের কোয়ার্টার্সে। ঘরে স্যার থাকলে এত আদর করেন যে বলার নয়। বুঝলাম, ওঁর বাইরেটা আসলে খোলস। ভেতরটা স্নেহের ফল্গুধারা।
এই কোয়ার্টার্সে ছোটবেলায় বহুবার এসেছি। অনিলকাকু তখন এখানেই থাকতেন। কোয়ার্টার্সের সামনে ছোট্ট পুকুর। টলটল করছে জল। মিষ্টি হাওয়ায় সন্ধে থেকে রাত সত্যিই শীতল।

মাঝে দাঁড়িয়ে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয় ইলামসি, একদম ডাইনে ঝর্ণা (বর্ধন) মাসি….
পেছনে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় পণ্ডিতদাদু ও একদম ডাইনে বীরুদাদু…..
বাকিদের কথা মনে নেই অথবা দেখিনি
মানি বাদেও দিনহাটা গার্লস স্কুলের মায়ের পুরোনো সহকর্মীদের অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। ঝর্ণা মাসি তাঁদের মধ্যে একজন। মাসির ছেলে রাজাদা সেই সময় কল্যাণীতে। রাজাদের বোন রিঙ্কু কলেজে আমার এক ব্যাচ আগে। ছোটবেলায় রিঙ্কুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল। একবার দিনহাটা গার্লস স্কুলে ও আর আমি জানালার কাছে খেলছিলাম। জানালা গলে কীভাবে যেন রিঙ্কু পড়ে গেল। হাত ভেঙে গেল। এখন বড় হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা দূরত্ব এসেছে। কিন্তু দেখা হলেই কথা হয়। রিঙ্কুর বাবা অধ্যাপক হিতেন নাগ বাংলার শিক্ষক। সুলেখক। অত্যন্ত পরিচিত নাম। তাঁকে স্যার বলব না মেসো বলব এই ঝামেলায় পড়ে সামনেই যাই না। দেখলেই পালাই। উনি সম্ভবত সেটা বোঝেন। আমাকে পালাতে দেখলেই মিটিমিটি হাসেন। মায়ের অন্য সহকর্মীদের মধ্যে ইলা মাসি, গৌরী মাসির সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মাঝে। পণ্ডিত দাদু কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন। প্রতিমা মাসির বাড়িতেও যাই। মাসির মেয়ে সুমনদি খানিকটা বড়। ছেলে অভি এক-দুই ক্লাস নিচে পড়ছে। বেলা মাসির সঙ্গেও দেখা হয়েছে এক-দুইবার। উনি অবশ্য এখন অধিকাংশ সময় কলকাতায় থাকেন। তবে দেখা হলেই মাসি ছোটবেলার মতোই আদর করেন। যেন আমি এখনও সেই ছোট্ট বাচ্চাটি রয়েছি।
এর মধ্যে রীনা আবার আর একদিন খেপে গেল। সেই বই নিয়ে ওর রাগ কমবার পর, একটু আধটু কথা বলছিল। কিন্তু আবার গন্ডগোল করেছি। সেদিন ওর নীল টিপ, নীল ব্লাউজ, নীল শাড়ি দেখে বলেছি চটিটাও নীল পরলে পারতিস
। এতেই খেপেছে। কলেজে বুক খোলা পাঞ্জাবি আর জিনস পরে আসা ফালাকাটার ছেলেটা মহা বদমাশ….এটাই বলছে সবাইকে। তার ওপর কেউ একজন খবর দিয়েছে ছেলেটা ভাল নয়। সিগারেটের নেশাও তো আছেই, রহস্য আছে আরও কিছু। প্রায়ই শ্মশানে যায়। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। হয়ত নেশাটেশা করে…..
(ক্রমশ)
পর্ব – ১
https://www.facebook.com/share/p/1EhQT8TFnh/
পর্ব – ২
https://www.facebook.com/share/p/16jG4yr2hW/
পর্ব – ৩
https://www.facebook.com/share/p/1CwTCvTFBQ/
পর্ব – ৪
https://www.facebook.com/share/p/178KLupGrr/