রবি আড্ডায় শৌভিক রায়

পর্ব – ৪

কোচবিহার শহরে প্রবেশের মুখে ঘুঘুমারির রেলব্রিজ সেই সময়ের এক বিভীষিকা।

তখনও পুন্ডিবাড়ি ফালাকাটা সড়ক তৈরি হয়নি। সোনাপুর দিয়ে শিলবাড়ীহাট বা পলাশবাড়ি হয়ে ফালাকাটা যাওয়া যায়। কিন্তু সেটি কেবল শীতকালে। পুজোর পর পর কাঠের ফেয়ার ওয়েদার ব্রিজ তৈরি হয়। বর্ষায় খুলে ফেলা হয়। একসময় এই রাস্তাটিই জাতীয় সড়ক ছিল। অস্থায়ী কাঠের ব্রিজের পাশে ভেঙে যাওয়া পুরোনো ব্রিজের বিরাট বিরাট থামগুলি দেখা যেত। আশির দশকের শুরুতেও একটি পিলারে জ্বলজ্বল করত প্রমোদ জ্যোতি মাতব্বর/ আপেল পেঁয়াজ এক দর লেখাটি।

শীতের সময়টুকু বাদে কোচবিহার থেকে সব গাড়িকেই ঘুঘুমারির রেলব্রিজ পার করতে হত। ফালাকাটা-শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির বাস নিশিগঞ্জ-হিন্দুস্থান মোড় হয়ে চলে যেত। আর দিনহাটা যেতে তো আজও ঘুঘুমারি পার করতে হয়। ট্রেনও চলত এই ব্রিজের ওপর দিয়ে। ট্রেন এলে দুদিকের গেট বন্ধ করে দেওয়া হত। ফলে, দুদিকেই গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। অবধারিত ছিল জ্যামজট। সোনায় সোহাগার মতো কখনও ব্রিজের ওপর কোনও গাড়ি নষ্ট হয়ে যেত। তারপর যে জ্যাম শুরু হত, সেটি যারা দেখেনি তারা বুঝবে না। বাস, ট্রাক, টেম্পো, রিকশা, ঠেলা, ট্রেন ইত্যাদি সব মিলিয়ে সে এক নরক গুলজার দশা! ওই সময় বহুদিন বিয়ে করতে যাওয়া টোপর মাথার বরকে হেঁটে ব্রিজ পার করতে দেখেছি। ওপারে হয়ত পাত্রীপক্ষ অন্য গাড়ি নিয়ে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছেন। লগ্ন না পেরিয়ে যায়! সবচেয়ে অসুবিধে হত রুগীদের। বিকেলে কোচবিহার থেকে রওনা দিয়ে ২৪ কিমি দূরের দিনহাটায় পৌঁছতে অনেক সময় মাঝরাত হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও কম নয়। উপায় না দেখে অনেক সময় পায়ে হেঁটে ব্রিজ পার করতে হয়েছে। একবার হরিণচওড়ার বাণী নিকেতন গার্লস হাই স্কুলের সামনে থেকে চার নম্বর অবধি হেঁটে ছিলাম। কিমির দূরত্বে মোটামুটি পাঁচ ছয় কিমি হবে সেই রাস্তা।

তবে অধ্যাপক অনিলবন্ধু দত্ত সকালে পড়াতেন বলে আমাদের খানিকটা সুবিধে ছিল। কেননা ওই সময় সেভাবে জ্যাম হত না। বাসের জানালার ধারে বসে তোর্ষার বাঁককে সকালের চিকচিকে আলোয় খাপ খোলা তলোয়ারের মতো লাগত। আরও অনেক ছোটবেলায় যখন দিনহাটা-ফালাকাটা করতাম, তখন চাকির মোরের কাছাকাছি কোনও এক বাড়ির কালো দেওয়ালে সাদা কালিতে অপরাজিতা গোপ্পীকে জয়যুক্ত করুন লেখা দেখে বুঝতাম, কোচবিহার এসে গেছে। চাকির মোড় পার করে খানিকটা এগিয়ে ভাওয়াল মোড়ের কাছে পাশাপাশি রায় ভিলা আর ভৌমিক লজ বাড়ি দুটি দেখে মনে হত, এবার শহর শুরু হচ্ছে। যখন নিয়মিত পড়তে আসছি, তখন শহরের কিছুটা বিস্তৃতি হলেও টিনের চালের একতলা, বড়জোর দোতালা বাড়ির সংখ্যাই বেশি। যে কোনও জায়গার থেকে রাজবাড়ির উঁচু গম্বুজ দেখা যায়। ছোটবেলায় দেখা সেই ভিস্তিওয়ালারা শহরের পথগুলিতে জল না দিলেও, নিয়মিত ঝাঁট পড়ে সকালে। পরিচ্ছন্ন শহর। নোংরা কম। সাগর দিঘির পরিবেশ একদম প্রাকৃতিক। মদনমোহন মন্দিরও তাই। আধুনিকতার খানিকটা হাওয়া গায়ে মেখেও, কোচবিহারের মধ্যে তখনও অনেকটা পুরোনো ব্যাপার রয়ে গেছে।

স্যারের পড়ানোটা একদম অন্যরকম ছিল। গতানুগতিক নোটস দিতেন না। বরং একগাদা বই দিয়ে দিতেন। পড়তে বলতেন। যে জায়গাগুলো ভাল লাগছে বা গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, সেগুলি লিখে রাখতে বলতেন। ঘরে টেবিল চেয়ার থাকলেও, মাদুর বিছিয়ে দিতেন বই দেখবার সুবিধে হবে বলে। এভাবে পড়ানোতে সবচেয়ে সুবিধে হল আমার। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসের বই হিসেবে আলব্যার্ট, লং, ডেভিড ডেচিস, আইফোর ইভান্স প্রমুখদের বইগুলি পড়ে ফেললাম দ্রুত। মেটাফিজিক্যাল কবিদের বুঝতে একগাদা রেফারেন্স বই দিলেন কাকু। সেগুলি পড়তে পড়তে আর ব্যাখ্যা জানতে জানতে মনে হল, এতদিন কিছুই পড়িনি। মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট পড়াতে গিয়ে স্যার যখন আবৃত্তি করছেন ....better to reign in hell than serve in heaven, তখন মনে হচ্ছে স্যাটান যেন আমার কথাই বলছেন।

শনিবার আর রবিবার পড়া। শনিবার কলেজের চাপ কম। রবিবার তো ছুটিই। সুতরাং অধ্যয়ন চলতে লাগল। কোনও শনিবার বেলা বারোটা, কোনও দিন একটা বাজত। মাঝে মাঝে গীতা কাকিমা জোর করে খাইয়ে দিতেন। তুতুনদি ইউনিভার্সিটি থেকে এলে গল্প জমে যেত দুজনের। বুবুনের সঙ্গে অবশ্য সেভাবে দেখা হত না। এক-দুদিন খাওয়া আর প্রতিদিন খাওয়া এক নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কাকিমা সেটা শুনবেন কেন! ফলে যাতে কাকিমার মুখোমুখি না হতে হয়, সেজন্য চুপচাপ পালাতাম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করত। মানিক মুখ দেখেই বুঝে নিত সেটা। মানিক ছিল মিনিবাসের কন্ডাকটার। আমাকে কেন জানি আলাদা চোখে দেখত। নিজের ভাগের খাবার অনেকদিন দিয়েছে মানিক। ড্রাইভার সাধনদা, ক্লিনার বৈরাগীদা, আর এক কন্ডাক্টার পার্থদা (পার্থদা অবশ্য দাদার সহপাঠী ছিল) সবাই ভীষণ ভালবাসত। তাই সেই সকালে বেরিয়ে ঘুঘুমারি ব্রিজে আটকে দিনহাটায় বাড়ি ফিরতে অনেকদিনই বিকেল হয়ে গেলেও, মালুম হত না কিছুই।

ইলেকট্রিক টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়তে বসতাম সন্ধ্যায়। সম্পূর্ণ ঘর অন্ধকার। আলো শুধু টেবিলে। চুপচাপ নিজের মতো দেখতাম। বুঝতে পারছিলাম, অনার্স মানে শুধু নোটস লিখে আসা নয়। কোনও প্রশ্নকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করা। জোর দিচ্ছিলাম তাই শুধু পড়ায়। অবশ্য মাঝে মাঝে ভয় লাগত। আমার সহপাঠী বিষ্ণু, করুণা, স্বপন, মহামায়ারা পড়ছে অধ্যাপক অম্লানজ্যোতি মজুমদারের কাছে। অত্যন্ত নামী শিক্ষক তিনি। কোচবিহারের নামী মানুষ। উনি বিভিন্ন নোটস দিচ্ছেন। ওদের গল্পে সেই সব জানতাম। তুলনায় আমি যেন অনেকটা পিছিয়ে। কিছু রেফারেন্স বই পড়ছি। আমার সঙ্গে সাথী আর পাঞ্চালি পড়ছে। রীনাও আছে। সাথী একটু গম্ভীর। পাঞ্চালি বিবাহিতা। রীনার সঙ্গে কথা বলার চাইতে বন্ধই বেশি। কোনও কারণ লাগে না। ওর মর্জি। লেটেস্ট কারণ হল, অধ্যাপক সুশান্ত চক্রবর্তীর ক্লাসে ওর বইকে নিজের বলে চালিয়ে ক্রেডিট নিয়েছিলাম। এতেই মারাত্মক খেপে আছে। সুতরাং ওদের কী অবস্থা সেটা জানি না। কিন্তু অন্যদের দেখে ও কথাবার্তা শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমি কিছুই জানি না।

সত্যিই জানি না। সাহিত্যের যে জগত ধীরে ধীরে আমার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, তাতে নিজেকে ছোট্ট পিঁপড়ে ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। চারদিক থেকে তাই হতাশা ঘিরে ধরছে কেবল। এইরকমই এক দিনে ফালাকাটা থেকে একটা ইনল্যান্ড লেটার এলো। অত্যন্ত চেনা হাতের লেখা। চিঠিটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। চুরমার হয়ে গেল সব কিছু। এই একটা জায়গা ছিল, যেখানে নিজের সব কিছু দিয়ে দিতে পারতাম। অত্যন্ত ভরসার ছিল সেই সেই হাত। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে সেই হাত গুটিয়ে নিল কেউ। কিন্তু কেন তা কিছুতেই জানতে পারলাম না। সম্পূর্ণ অন্ধকার নেমে এলো জীবনে। জন্মস্থান ফালাকাটা ক্রমশ এক দুঃস্বপ্নের জায়গায় বদলে গেল।

বয়সে বড় আমার এক তুতো দাদা একদিন সিগারেট দিল। ইতস্তত করলাম। হাজার হলেও বড়। পিঠে চাপড় দিয়ে সেই দাদা বলল, তোর সবটাই জানি। শান্তি দরকার তোর। সিগারেটটা টান। শুধু টানবার আগে মহাদেবকে মনে মনে প্রণাম কর। ওর কথায় কী ছিল জানি না। ধরালাম সিগারেট। গরমের রাত। সাড়ে দশটার ওপর তখন। থানার দিঘির পাশে ছোট্ট মাঠে আমরা। জ্যোৎস্না রাত। বিরাট বট গাছটার ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চারদিক সাদা রুপোর মতো আলোয় ভেসে যাচ্ছে। একটা সময় মনে হল, আমিও ভাসছি। কেউ কোত্থাও নেই। শান্ত নির্জন চারধার। অদ্ভুত বিষণ্ণতা চুঁইয়ে পড়ছে আকাশ থেকে। কিন্তু বড্ড প্রশান্তি। বহুদিন পর যেন সব যন্ত্রণা শেষ। এক অসামান্য অপার্থিব জগতে যেন আমার বিচরণ। মনে হল শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন আমার পাশে বসে বলছেন, বারবার নষ্ট হয়ে যাই প্রভু, তুমি আমাকে একবার পবিত্র করো.....

সেদিন থেকে সত্যি এক নতুন দুনিয়ায় পা দিলাম।

(ক্রমশ)

পর্ব – ১

https://www.facebook.com/share/p/1EhQT8TFnh/

পর্ব – ২

https://www.facebook.com/share/p/16jG4yr2hW/

পর্ব – ৩

https://www.facebook.com/share/p/1CwTCvTFBQ/

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *