
রবি আড্ডায় শৌভিক রায়
পর্ব -২
কলেজের পেছনেই রেল লাইন। তাতে ট্রেন চলে। এই লাইন চলে গেছে বামনহাট। দেশভাগ না হলে চলে যাওয়া যেত বাংলাদেশে। আমার ঠাকুরদা পরিবার নিয়ে এই পথে ময়মনসিংহ থেকে এসেছিলেন। এখন অবশ্য ধীরগতির লোকাল ট্রেন কোচবিহার- বানেশ্বর ছুঁয়ে আলিপুরদুয়ারে যায়। রেল লাইন পার করে খানিকটা এগোলে কোয়ালিদহ। ওই সব অঞ্চলে আমাদের জমি আছে। ধানী জমি। আধিয়ার হিসেবে আছেন রাজেনদা। ছোটবেলায় দিনহাটায় এলে বড়কাকুর সাইকেলে চেপে খামারবাড়ি যাওয়া ছিল একটা ঘটনা। কখনও শীতকালে ফ্যামিলি পিকনিক করা হত। খামারবাড়ির পেছনেই গড়। গড় মানে উঁচু ঢিবি। দীর্ঘ এর বিস্তৃতি। কলেজ থেকে কোচবিহারের দিকে একটু এগোলেই গড় শুরু হয়েছে। সেখানেই রয়েছে বুড়িমায়ের মন্দির। খুব জাগ্রত দেবী। ছোটবেলায় সামনে দিয়ে গেলেই প্রণাম করতাম।

গড়ের মোটামুটি উল্টোদিকে পিসির বাড়ি। বাংলাদেশে থাকতেই পিসির বিয়ে হয়েছিল অসমের সুখচরে। অকালে পিসেমশাই চলে গেলে পিসিকে দিনহাটায় আনা হয়েছে। জমি দেওয়া হয়েছে। ছোট্ট বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। পিসির বড় ছেলে বাবুয়াদা ছোট থেকেই ফালাকাটায়। বাবার কাছে। পড়া শেষ করে ওখানেই চাকরি পেয়েছে। ও, আমি আর দাদা একসঙ্গে বড় হয়েছি। দাদার চাইতেও বাবুয়াদার সঙ্গে আমার বেশি ভাব। পিসির অন্য দুই ছেলে দিনহাটায় থাকে। একদম ছোট বাপ্পা আমার বয়সী। আমার সঙ্গেই কলেজে ভর্তি হয়েছে।
ক্লাসরুমে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। ট্রেন চলে। কলেজ হল্টে দাঁড়ায়। কিছু লোকজন নামে। কোচবিহার থেকে স্যারেরা আসেন। ছাত্রছাত্রীদেরও নামতে দেখা যায়। ট্রেন চলে যায় নিজের মতো। মন খারাপ লাগে। ফালাকাটার ওপর দিয়ে যে ট্রেন চলে যায়, তাতে ছোঁওয়া লেগে থাকে মহানগরের। কিংবা অন্য রাজ্যের। এখানে সেটি নেই। মহানগরের কথা ভাবলে একটু কষ্ট হয়। দাদা মাধ্যমিকের পর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু তিন মাস থেকে চলে আসে। পরে ফালাকাটা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক করে স্কটিশ চার্চ কলেজে কেমিস্ট্রি নিয়ে ভর্তি হয়। বাবা আমার জন্য কিছু ভাবেননি। ফালাকাটাতেই রেখে দিয়েছিলেন। একটু অভিমান হয়। হয়ত বাইরে কোথাও পড়লে এরকম রেজাল্ট হত না!
ক্লাসে ঢুকলেন বিভাগীয় প্রধান শ্রী অনিলবন্ধু দত্ত। আমি ওঁকে চিনি। উনিও আমাকে জানেন। কিন্তু পরিচয় না দিলে চিনবেন না। মাঝে তো দীর্ঘ অদর্শন। স্বাভাবিক সেটা। উনি বাবার এক বন্ধুর ভাই। বাবা আর সেই বন্ধু ধুবড়ির বি এন কলেজের ছাত্র। বাবার ছাত্র জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছিল ধুবড়িতে। ফলে ধুবড়ির সঙ্গে বাবার সখ্য আলাদা। শুনেছি সেই বন্ধু আর বাবা ভরা বর্ষার ব্রহ্মপুত্রেও লাফিয়ে পড়তেন সাঁতার দেওয়ার জন্য। অনিলবন্ধু দত্ত যখন দিনহাটা কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পরিবার তাঁর অন্যতম পরিচিত আশ্রয় ছিল। মধুরভাষী মানুষটি ঠাকুমাকে মা ডাকেন। তাঁর স্ত্রী গীতা দত্তও (এখন প্রয়াত বলে শ্রীমতি যোগ করলাম না) দিনহাটা কলেজে ইতিহাস ডিপার্টমেন্টে। দীর্ঘদিন ওঁরা কলেজ কোয়ার্টার্সে ছিলেন। সেই সময় বহুবার গিয়েছি সেখানে। ওঁদের কন্যা তুতুনদি (সোমালি দত্ত) নিজের দিদির মতো। আর পুত্র বুবুনকে (শৌভনিক দত্ত) ভাই বলে জেনে এসেছি। আমি ক্লাস থ্রি-তে দিনহাটা থেকে চলে যাওয়ার পর, ওঁরা বাড়ি করে কোয়ার্টার্স ছাড়েন। সেই বাড়িতেও গেছি। এখন অবশ্য দিনহাটার সেই বাড়িতেও থাকেন না। কোচবিহার থেকে যাতায়াত করেন।
প্রথম ক্লাস। উনি সবার নাম জিজ্ঞাসা করছেন। আমি শেষ বেঞ্চে বসা। আমার আগের বেঞ্চে কয়েকজন মেয়ে। তার মধ্যে একজনকে ভর্তির লাইনে দেখেছিলাম। খুব ছটফটে। বাবার সঙ্গে এসেছিল। সবার নাম আর স্কুল জানতে জানতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন অনিলবন্ধু দত্ত। খুব লজ্জা লাগছে। তুতুনদি দিনহাটা গার্লস হাই স্কুলে আমার মায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রী ছিল। এই মুহূর্তে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে মাস্টার্স করছে। খুব ভাল ছাত্রী বলে পরিচিত সব জায়গাতেই। গানও গায় দুর্দান্ত। বুবুনও মেধাবী। গুণী। ছোটবেলায় যাদের দিদি আর ভাই বলে জেনে এসেছি, তাদের পাশে এই মুহূর্তে আমার পরিচয়! সত্যিই ঘেন্না হচ্ছে নিজের ওপর। মাথা নিচু করে কোনও মতে নিজের নাম আর স্কুল বললাম। স্যার তাঁর হাত আমার গালে আলতো করে ছোঁয়ালেন। মুহূর্তেই জড়তা কেটে গেল। ওই স্পর্শে যে স্নেহ লুকিয়ে আছে, সেটা সেই সময়ে অমূল্য বলে মনে হল। এত বাজে রেজাল্টের পর কেউ ফিরেও তাকায়নি। আর উনি আদর করলেন। চোখ ছলছল করে উঠল আমার।
স্যার নিজের চেয়ারের দিকে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই সামনের বেঞ্চে বসা সেই মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
- স্যার তোর গালে কেন চড় দিলেন রে ওভাবে?
বললাম উনি আমার কাকু হন।
- কাকু! অ….
ততক্ষণে আমি মেয়েটার নাম জেনে ফেলেছি। দেওয়ানহাটের মেয়ে। আমার চাইতে রেজাল্ট অনেক বেশি ভাল। নাম রীনা সাহা।
(ক্রমশ)
পর্ব -১
https://www.facebook.com/share/p/1EhQT8TFnh/