রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ

জীবনের প্রগাঢ় বাস্তবতার রূপরসের সন্ধানে বারবার অগ্রসর হয়েছেন লুৎফর রহমান। ধর্মীয় বেড়াজালের ঊর্ধ্বে তিনি মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। মানুষ বারবার হেরে যাচ্ছে ধর্ম ও রাষ্ট্রের কাছে। সেই বয়াননাম থেকে লুৎফর মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তা সম্ভব নয় বলেই আখ্যানে একের পর এক বাঁক আবিষ্কার হয়। তিনি মানুষকে শুভবোধে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান। বিশ্বাস সংস্কারের দোলার পাশাপাশি মানুষের মিলিত অবস্থান যা প্রাচীনকালে বিভেদ সৃষ্টি করেনি সেই আদিম বিশ্বাসে ফিরাতে চান। তা কি সম্ভব? আধুনিক জটিল জীবনের বর্ণমালায় তা সম্ভব নয় বলেই লুৎফরকে বারবার কলম তুলে নিতে হয়।

    বাস্তব, অধিবাস্তব, সূক্ষ্ম বাস্তব, বাস্তবের ভিতরে মরে যাওয়া বাস্তব, মিথের বাস্তবসহ একাধিক বাস্তবের সন্ধান তিনি জানেন। প্রান্তিক মানুষদের বয়াননামাকে সঙ্গী করে তিনি লালনের দেশের সন্ধান করেন। মানুষের বাঁচানামক প্রক্রিয়া কতভাবে, কত কায়দায়, কত আছিলায় ভেস্তে যাচ্ছে তা প্রতিপন্নের মধ্য দিয়ে দেখাতে চান মানুষ যে মরছে। সুসভ্যতার আলোয় মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যুর মতো ঘৃণ্য অপরাধ আর বুঝি নেই। অথচ তা নানাভাবে ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই লুৎফরকে অক্ষরসৈনিক হয়ে কলমযুদ্ধে নামতে হয়। চরিত্র নিজের রাগ ক্রোধ প্রকাশ করতে খিস্তি ব্যবহার করে। সব হারা মানুষের, সব বিচ্যুত মানুষের খিস্তিই যেন হয়ে ওঠে হাতিয়ার, প্রতিবাদের মশাল।

নিজস্ব স্টাইলে, বিন্যাসে ও সংলাপে বাস্তবের স্তর ভাঙতে ভাঙতে জীবনের যে চিত্রমালা উদ্‌ঘাটন করেন তা যেন জীবনকেই চ্যালেঞ্জ করে যায়। কথ্য ভাষায়, নিজস্ব শব্দনিকেতনে, সমাজের গভীর তলদেশ দিয়ে যে ভাষা বয়ে যায় যা মাঠ-ঘাট-পল্লি জীবনের নিজস্ব রসদ তা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। লুৎফর বঙ্গদেশের এক কোণের জীবনচিত্রের খণ্ড অংশ তুলে আনেন। বনগাঁ, নদিয়া সংলগ্ন সে জীবন। কিন্তু সমস্যার কথনে তা গোটা বঙ্গদেশেরই। সেখানে সর্বদা মনে বিভেদ, ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব আছে। এমনকি তা কর্মের তাগিদে, জীবিকার তাগিদে, বেঁচে থাকার তাগিদে। আবহমানকাল ধরে এখানে রাষ্ট্র মাথা ঘামায়নি। মাথা ঘামানোর প্রয়োজন যেমন ছিল না তেমনি উৎসও ছিল না। নিজেদের মধ্যে ছোটোখাটো বিবাদ বেঁধেছে আবার মিটেও গেছে। কিন্তু সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র হিন্দুনীতিকে সামনে রেখে বিভেদের বীজ বুনে দিচ্ছে।

    লুৎফরের বড় গুণ পারিপার্শ্বিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই দেশের রাজনীতি, ধর্মনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, শোষণ, ইন্ধন, সূক্ষ্ম দ্বেষ, সুপ্ত বিদ্বেষ, মনের কোণে মরে যাওয়া আচারনিষ্ট ধর্ম, যা মানুষকে বারবার নাজেহাল করে, মানুষের স্বাভাবিক বাঁচাকে প্রভাবিত করে তা তিনি কথার আড়ালে বুনে দেন। সেই বুনে দেওয়াটা ভৌম জলের মতো। তবে তা গৌণ নয়। শারীরিক ভাষায়, চলনে-বলনে, যাপনে-মরণে প্রকাশ পায়। তা প্রতাপ, বল, ঈর্ষা থেকে উৎসারিত। কথার আড়ালে প্রবল ব্যঙ্গে রাষ্ট্র, দেশ, রাজনীতি, নিয়মনীতি, ধর্মনীতিকে তুলোধনা তো অবশ্যই, সেই ফাঁকে মানুষের যন্ত্রণা, মর্মবেদনা, সেই নিয়মনীতির পরিণাম কত ভয়ংকর তা বাজিয়ে দেন। রকবুল ধর্মের নিয়ম কানুন জানে না। তাতে বাঁচা কোনোদিন অসুবিধা হয়নি। এসবের মধ্য দিয়ে লুৎফর কোন সত্যে যেতে চান? এই উপমহাদেশের প্রচলিত ধর্মের গাঁড় মেরে, ধর্মীয় ধ্বজার পোঁদে আগুন দিয়ে দেখিয়ে দেন বাঁচাটাই ধর্ম।

    লুৎফরের পাঠতত্ত্ব যেন এক দর্শন পাঠ। কাহিনির ভিতর দিয়ে আমাদের বাঁচা-মরা-ধর্ম-রাষ্ট্র-রাজনীতির ভাষ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক মানবিক জীবনদর্শন। সেই দর্শন আসলে লুৎফরের জীবনবেদ। যার জন্ম হয়েছে মানবিকতাবাদ থেকে। লুৎফর কোন সত্যে মানুষকে নিয়ে যেতে চান? জাগতিক পৃথিবীর, অস্তিত্বের শেষ কথা মানবিকতা, সম্প্রীতি। এর থেকে বড় বিদ্রোহ নেই, জেহাদ নেই। অথচ সৈনিকের অভাবে সেই মিলন বীণা বাজে না। লুৎফর সেই সৈনিকদের নির্মাণ করেন। করোনা, লকডাউন, হাঁটা, ধর্ম, রাষ্ট্রীয় চরিত্র, চোখ রাঙানি ও বাঁচাকে কেন্দ্র করে জীবন নামক প্রক্রিয়ার এমন এক ফ্রেম তিনি রচনা করেন ‘আন-মানুষ’ গল্পে যা সমায়ের বয়ান হিসেবে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। লকডাউনকে সামনে রেখে কতগুলি মানুষের ঘরে ফেরার বয়ান এই আখ্যান। ভাবের মানুষ আর অভাবের মানুষ। ব্যক্তি মানুষের বাঁচাকে রাষ্ট্র, পুলিশ, সমাজ নানাভাবে বিষাক্ত করে। যতন, রতন, নাগর আলি, হোসেন, নিরঞ্জনরা দলবদ্ধভাবে ফিরছে। মুসলিম বলে ধর্ম বিসর্জন দিতে হয়েছে। রাম নামে বাঁচা যায়। লুৎফর দেশের চালচিত্র দেখান। সংখ্যালঘুর জীবনসমস্যা চিহ্নিত করেন। অভাবী মানুষের বাঁচাটাই ধর্ম। রতন-যতন-হোসেন-নাগর আলির ধর্ম থাকলেও তা কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। অভাবী মানুষের কাছে ধর্ম নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু রাষ্ট্র বিঘ্ন ঘটিয়েছে। বর্জিত মানুষকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের নির্মমতা দেখালেও লুৎফর ফিরে যান আদিম বিশ্বাসে। যে বিশ্বাসের উৎপত্তি মহান ভারতের ঐতিহ্য থেকে। মানুষের মুক্তি মানুষের হাতেই। খ্যাপা ষষ্টির বউ এগিয়ে এসেছে। সংখ্যাটা নগণ্য তবু সব ডুবে যায়নি। কোনো রোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি নয়, লুৎফর সমাজের গভীরে প্রবেশ করে রাষ্ট্রের নির্মমতা ও ধর্মকে সঙ্গী করে চলার ফরমান স্পষ্ট করেন।

ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেই বাতাসকে কাজে লাগায়। দুনিয়ার মাঝখানে মানুষ ধর্মকে নিয়ে অস্থির। যদিও জীবনচিত্র এমন ছিল না। হিন্দু-মুসলিমের মিলিত অবস্থান বিভেদ ঘটায়নি। অন্তত সামাজিক ইতিহাস তাই বলে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা সমষ্টি যা বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসেবে হয়ত ঘটেছিল কিন্তু কেউ ইন্ধন জোগায়নি। হিন্দুত্ববাদী দল নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতেই ধর্মীয় মেরুবিভাজন চরমে উঠেছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে ধর্মের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করেই গত শতকের নয়ের দশকের সূচনাতেই বিভেদের রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। লুৎফর ‘দুনিয়ার মাঝখানে’ আখ্যান লিখছেন গত শতকের শেষের দিকে। দুনিয়ার মাঝখানে মানুষের বাঁচা কীভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আর তা সংখ্যালঘু মানুষ বলেই বিপদ ঊর্ধ্ব গগনে। বর্ডার লাইনে হিন্দু-মুসলিম মানুষের মিলিত অবস্থান। সামান্য কিছুতেই বিরোধ, হত্যা ঘটেছে। নিজেকে আত্মরক্ষার নিমিত্তে বর্ডার দিয়ে ওপারে পালিয়ে যাওয়া আছে। এপার থেকে বাঁচতে মুসলিম ওপারে যাচ্ছে, ওপার থেকে হিন্দু এপারে মুসলিম আবাস দখল করে নতুন বসতি গড়ে তুলছে। দুনিয়ার মাঝখানে আদিল, তহমিনারা সুন্দরভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। বাঁচা সম্ভব হয়নি। অশান্তি যে আঘাত করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা যেমন পালন করতে হয় তেমনি স্নেহ পরাজিত করে। ধর্ম নিয়ে মাথা না ঘামানো মানুষগুলিকে ধর্মের কারণে বলি হতে হয়। দুনিয়ার মাঝখানে প্রচলিত ধর্মকে নিয়ে মানুষের এই আদেখলাপনাকে তিনি বড় করে দেখান। যার বলি হয় মানুষ। লুৎফর দীর্ঘ কাহিনি জুড়ে মানুষের ক্রোধ, লালসা, শ্রেণি অবস্থান ও বিধর্মীকে প্রতি মুহূর্তে খতম করে দেবার যে পালাবদল এঁকে চলেন তা অন্তঃসার সময়ের চোরাবালিকে স্পষ্ট করে। আসলে লুৎফর কোন সত্যে পৌঁছতে চান? দুনিয়া দারির পাঠশালায় ধর্মের নামে হানাহানি, ব্যক্তি মানুষের পতন ও মানুষের স্বভূমিচ্যুত হওয়ার নক্করজনক ঘটনা। মানুষরতন যেখানে শ্রেষ্ঠ জীব তাদের এই নেমকহারামি যেন সভ্যতার অপরাধ। আর তার পিছনে কাজ করা ধর্ম, রাজনীতি, বিভেদনীতিকে তুলধনা করতেই যেন কাহিনির গোড়াপত্তন করেন।

    জমি, জমিসংক্রান্ত মানুষ, ভূমিরেখা, প্রকৃতি, প্রতাপ, ঈর্ষা, ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘আলছায়া’ গল্পটি। ভূমিজ মানুষের ঘরবসতি, জীবনচিত্র ও শ্রেণি অবস্থান লুৎফর খুব ভালো করেই জানেন। চাষির জীবনে প্রকৃতি এক নিয়তি। প্রকৃতির উদারতায় চাষি জয়ী হতে পারে, প্রকৃতির বিমুখতায় সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। সেই সত্যকে মাথায় রেখেই চাষি জমিতে নামে। কখনও হাসি ফোটে কখনও বিষণ্ণ হয়। আল যেমন জমির সীমানা নির্ধারণ করে তেমনি ক্ষমতার সীমাও নির্ধারণ করে না কি? ব্যক্তি মানুষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এমনকি শ্রেণিচিত্র অনুসারে মানুষের ক্ষমতার তরবারিও নির্ধারিত। ভূমিজ মানুষদের জমি সংক্রান্ত নানা চিত্র, ফসল উৎপাদনের নানা হকনামা, জমির সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংসার, প্রেম, কলহ নিয়ে জীবনের যে ফ্রেম অঙ্কিত হয় তা অনবদ্য। অনবদ্য একারণেই এইসব মানুষদের লুৎফর নিবিড়ভাবে চেনেন, জানেন। আর জানেন বলেই কথ্য সংলাপে, চাষবাসের অন্দরমহলে প্রবেশ করে জীবনের মেঘ-রৌদ্রের বিচ্ছুরণের নানা রঙচিত্র যে ভাষায় ও শব্দমালায় এঁকে দেন তা বিস্মিত করে। এমনকি নিজের পৃথক অবস্থান স্পষ্টভাবেই জানান দেয়। জীবনের প্রগাঢ় বাস্তবতা, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত অবস্থান, চাষবাসের সমস্যা, জমির চরিত্রসহ শ্রেণিমানুষের যে বর্ণময় যাপনের শব্দছক নির্মাণ করেন তা স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। ‘আলছায়া’ ও ‘দুনিয়ার মাঝখানে’ গল্পের তুলনায় বাকি তিনটি গল্পের সমস্যা মারাত্মক। সময়টা অনেক এগিয়ে এসেছে। মানুষের মিলিত অবস্থানে ধর্ম নানাভাবে মাথা ঘামিয়েছে। রাষ্ট্র নিজের ভোট ব্যাংকের প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। ফলে লুৎফরকে আরও প্রখর হতে হয়েছে, তীব্র হতে হয়েছে। সময়ের সন্তান হিসেবে লুৎফর জানে মেকিবাস্তবের আড়ালে মানুষের মৃত্যু উৎসবের গোপন ফন্দিনামাকে প্রকাশ করা। ঘটে যাওয়া বাস্তবকে শিল্পের ময়দানে উত্তীর্ণ করতে লুৎফর নিছক চিত্রমালা গড়েন না, চিত্রমালায় মধ্যে ধর্ম নামক বোমের তরবারি রেখে ধ্বংসের গূঢ় সমাচার জানিয়ে যান। তবে ধ্বংসই শেষকথা নয় লুৎফর জানেন মিলনগীতি। তাই মানবিক মিলনের ধারাভাষ্য হিসেবে লুৎফরের বয়ান পাঠ জরুরি।

    মানুষের প্রতি সহানুভূতি, বিশ্বাস, মনুষ্যত্বের ঘ্রাণই লুৎফরের জীবনস্পন্দন। রাষ্ট্র, পুলিশ, সভ্যতার উচ্ছিষ্ট অংশ যে প্রান্তিক মানুষ তাই তাঁর স্বপ্নসন্তান। ভাঙাচোরা মানুষের ওষ্ঠাগত নাভিশ্বাস, ছিন্নভিন্ন হৃৎস্পন্দন, জীবনের অনুভূতিমালা যা প্রতি মুহূর্তে জীবনকেই প্রশ্ন করে সেই আকাঙ্ক্ষিত সত্য সন্ধান। রাজনৈতিক বোধ, তীব্র বোধদীপ্ত মনন ও জনজীবনকে সম্পূর্ণভাবে জানার দক্ষতা নিয়ে লুৎফর আখ্যানে প্রবেশ করেন। রাজনীতি, রাজনীতির পঙ্কশালা, শোষণের ক্ষমতা সাধারণ-অতি সাধারণ মানুষকে প্রতিমুহূর্তে দংশন করছে। দলের লড়াইতে ঘোল ঢালা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের মাথায়। ব্যক্তি মানুষের শরীর যেন স্বাধীন নয়। রাজনীতির বন্দি জলে বদ্ধ। সেই জালে বারবার আটকে যায় প্রান্তিক মানুষ।

    লুৎফরের বড় গুণ পর্যবেক্ষণ, পরিবেশ সৃজন ও ভাষা বয়ন দক্ষতা। পরিসরের আনাচে-কানাচের কোনো সত্যকেই তিনি বাদ দেন না। পরিসর-পরিবেশসহ মানুষকে তিনি এমন সূক্ষ্মভাবে জীবন্তভাবে জানেন যা প্রান্তস্থিত মানুষের ব্যাসার্ধ-জ্যা সহ সব উঠিয়ে আনে। যে মানুষগুলি রাষ্ট্র, রাজনীতির ‘র’ জানে না তাদের উপর দিয়েই ক্ষমতার সত্য বহন করা হয়। সেই না মানুষের উপর বল প্রয়োগ ও হতচ্ছাড়া মানুষের অনুভূতির এমন বলশীল-বলহীন ভাবনাবলয় যা অনেকান্তিক স্তরে বিভাজিত সেই মানুষের হার কঙ্কাল নিয়ে লুৎফর রহমানের আখ্যান পরিকল্পনা। প্রান্তিকের সব ভাঙা মানুষ, ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া, মটকে যাওয়া মানুষের প্রাণ নিয়ে লুৎফরের আখ্যানভুবন। তাঁর জানা-দেখাটা বৃহৎ। গল্প হলেও তিনি সমগ্র মানুষকে ধরেন। সেই ফ্রেমে ধর্ম থেকে রাষ্ট্র, অভাব থেকে যৌনতা, খিস্তি থেকে প্রান্ত-পরিসর সব বর্তমান। ‘নয়নখোল’ গল্পে নসরালি-মহিতোন-দোলনকে সামনে রেখে যে ফ্রেম রচিত হয় তা ব্যক্তিগত হয়েও সমষ্টিগত। সমষ্টি জীবনের চালচিত্র। ব্যক্তির দ্বন্দ্বময় বিন্যাস গল্পবলয়ের কেন্দ্রভূমি হলেও সমস্যা ও সমস্যার চিত্রবলি গোষ্ঠীগত। মানুষ, মানুষের সমস্যা, কেন্দ্রচ্যুত-সমাজ বিচ্যুত মানুষ, অভাবী মানুষ, দরিদ্র মানুষের বেঁচেবর্তে থাকা লুৎফরের আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে নামটা গৌণ্য। একটি নাম থাকতে হয় তাই থাকা। প্রকৃতপক্ষে চারপাশটাই কেন্দ্রীয় চরিত্র।

    হিন্দু রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, ইন্ধন সংখ্যালঘু মানুষকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে ‘নয়নখোল’ আখ্যান তারই নামান্তর। জনজীবনে কোনো বিভেদ ছিল না। হরি-নসরালি ধর্মে আলাদা হলেও বিভেদ হয়নি। কোনো প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। সম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, সংখ্যালঘু তোষণ, ইন্ধনের সুড়সুড়ি মুসলিমকে কীভাবে নাস্তানুবাদ করে, করছে তার জরুরি বয়ান ‘নয়নখোল’। কী আশ্চর্য নাম। দেখ রে নয়ন চক্ষু মেলিয়া। ভিতরের বাস্তব আর ঘটিয়ে দেওয়া বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান কয়েকশত মাইল। এই বাংলা লালনের বাংলা, রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের বাংলা। এখানে ঝগড়া-বিবাদ ছিল বটে তবে তা বিভেদ নয়। সেই বিভেদ ঘটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্র, রাজনীতি-হিন্দুনীতি। নসরালির পতনের জন্য দায়ী কে? অবধারিত উত্তর আসে রাষ্ট্র। নসরালি-হরি ধর্মে আলাদা হয়ে এতকাল এক ছিল, কর্মে অভিন্ন ছিল। এই ভাঙনের জন্য দায়ী কে? রাষ্ট্র। মানুষের বিশ্বাস ভাঙনের জন্য দায়ী কে? হিন্দু রাষ্ট্রের পরিকল্পনা। হে ভালো মানুষ-শুভ মানুষ-আল্লার মানুষ-ঈশ্বরের মানুষ নয়নখোল। মরছে সহযাত্রী তোমার। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সব। নয়নখোল। খুলে মানুষের হাতে হাত দে।

    প্রান্তিক মানুষ, বিপন্ন মানুষ, অভাবী মানুষ লুৎফরের নায়ক। তিনি জানেন ভেঙে যাওয়া মানুষের জীবনে আনন্দ বলে কিছু নেই। তাদের বাঁচাটাই একটা কৌশল। সেই কৌশলে নানা ছলচাতুরি, গোলকধাঁধা, ভাব-ভালোবাসা, অস্তিত্ব-অন্ধকার বিরাজ করে, সেই জ্বালাময়ী ঋতুচক্রের ঘূর্ণিকে তিনি দেখেন, দেখান। তিনি কাহিনি গড়লেও সেখানে বিপন্নতা, ব্যর্থতা, ভাঙাচোরা জীবনযাত্রাই প্রধান। এতো কাহিনি নয় কাহিনির অন্তরালে ভেঙে যাওয়া মানুষের অন্তর্বেদনা, দীর্ঘশ্বাস। জগা মিঞা, আলিজান, মঙ্গল হালদার, হৃদয় ব্যাপারী (‘পথ মানুষ পথের মানুষ’) সবাই এক গোত্রের মানুষ। অভাব গোত্র। গ্রাম বাংলায় ধর্ম নিয়ে অভাবী মানুষের তেমন কোনো কোলাহল ছিল না। জগার কন্যা মনজান মালোদের সন্তানকে বিবাহ করেছে। বিবাদ বাধেনি। কিন্তু দিন গড়াতেই ধর্ম নিয়ে বিবাদ ঘটছে। একে অপরকে বক্রচোখে দেখছে। সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুকে পৃথকভাবে দেখছে। মানুষের শুভবোধে ভাঙন ধরছে।

    ‘পথ মানুষ পথের মানুষ’ আখ্যানের চরিত্রের নামগুলি আশ্চর্যজনক। লুৎফরের মেধাবী শব্দ বিন্যাস। শব্দই ব্রহ্ম। শব্দের সুনিপুণ ব্যবহারে লুৎফর দক্ষ। আলিজান-মনজান-বাবুজান-দেলজান। লেখক কথাজালের মাঝে ইঙ্গিত রাখেন। যে ইঙ্গিতে ধর্ম-রাষ্ট্র-পার্টি-রাজনীতি-ক্ষমতাকে মৃদু আক্রমণ করে। তিনি যে কথা পরিসর রচনা করেন তা কথ্য ভাষায় সংলাপময় আঞ্চলিক উচ্চারণ। সেই কথা বলয়ে মানুষ নিজের বিপন্ন বোধ উন্মোচন করে। অন্যের দ্বারা, ধর্মের দ্বারা, বড় মানুষের দ্বারা, সমাজের দ্বারা কীভাবে নিপীড়িত হচ্ছে সেই বয়ান উঁকি দেয়। সমাজ মানুষের ভেতরের বলয়ে ঢুকে আস্ত মানুষের ভাব-ভালোবাসা-অহংকার, নিপীড়ন তিনি দেখেন। সেই পীড়ন কোথায় ভয়ানক সূক্ষ্ম। মানুষ বোঝে কিন্তু পাত্তা না দিয়ে বাঁচে। একটি শব্দে বা একটি বাক্যে সেই অভিমান কখনও প্রকাশ করে।

    শোষণের নানা শ্রেণিচিত্র আছে। সমাজ বক্ষে তা এত সূক্ষ্মভাবে বিরাজমান ভাবতে অবাক লাগে। ধর্মকে সঙ্গী করে, ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে, সমাজের ভয় দেখিয়ে, অমঙ্গলের বার্তা ডেকে এনে, সমাজচ্যুত করার অভিপ্রায়ে তা চলে। অভাবী মানুষের, অবলম্বনহীন মানুষের জনজীবন ছাড়া সঙ্গী কেউ নেই। সেই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে অনেকে তা মেনে নেয়। কেউ প্রতিবাদ করে। মেনে নেওয়া বা প্রতিবাদের আড়ালে লুৎফর দেখান শ্রেণিচিত্র। কেমনভাবে দড়িতে ঝুলে আছে প্রান্তিক মানুষ। সমস্যা-সংস্কার-সংকল্প নিয়ে যে জীবন প্রতিমুহূর্তে বিপদগ্রস্ত, যে জীবনের ওজন শূন্য, তা যেকোনো মুহূর্তে ধ্বসে যেতে পারে তা নিয়ে কোলাহলের যে বিন্দুমাত্র সার্থকতা নেই তা স্পষ্ট করে চলেন। লুৎফর চেনে মানুষ। মনুষ্যত্ব। ধর্মকে অতিক্রম করে সে মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেই প্রতিষ্ঠায় ধর্ম-রাষ্ট্র বারবার বিঘ্ন ঘটায়। লুৎফরের যুদ্ধ এখানেই। তিনি মানুষকে আদিম ধর্ম বিশ্বাসে নিয়ে যেতে চান। প্রথাগত ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসব নয়। ধর্মকে সঙ্গী করে হানাহানি, লাঞ্ছনা নয়। গরিব মানুষ ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়নি। অথচ আজ বিপন্ন হচ্ছে। সেই বিপন্নতা কীভাবে সৃষ্টি হল তা দেখান। সেখান থেকে বাঁচার পথও আবিষ্কার করেন। ধর্ম মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। মুসলিম বলে সন্দেহ, প্রহার, হত্যা চলছে।

    পথের মানুষ যে জীবনের সত্য জানিয়ে যায় তা ভয়ংকর। এখানেও ধর্মীয় শোষণ অব্যাহত। সমস্ত থেকে বিচ্যুত করার বাসনা। আমরা কোথায় চলেছি? মানবজাতির অন্তিম যাত্রা কোথায়? বা সভ্যতার? জীবনের শেষ বেলায় রবীন্দ্রনাথ যে লিখলেন মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে হচ্ছে। বিশ্বাসী মানুষ যাবে কোথায়? শেষে কি ধর্মকেই খাবে? যাদের এতকাল কিছু ছিল না, আজও নেই তারা ধর্মকে বরণ করেনি। কেউ কেউ ধর্মকে ব্যবহার করে মুনাফা লুটছে। হিন্দুত্ব বড় সহায়ক হয়েছে। মুসলিম দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। সেই দীর্ঘশ্বাসের খণ্ডকাব্য রচনা করেন লুৎফর।

    পথই হয়ে ওঠে গল্প, গল্পের সমীকরণ। পিতা খুঁজে পায়নি কন্যাকে। ধর্ম মিলতে দেয়নি। কন্যা চিনতে পারলেও গ্লানিতে আর ফিরতে চায়নি। সে খুঁজে নিয়েছে ভিন্ন পথ। পথে পরে আছে পিতা। এ এক পিতৃহৃদয়ের আর্তনাদ আখ্যান। যে আর্তনাদের ভিতরে চাপা কান্না বাজিয়ে দেয় ধর্ম। প্রচলিত ধর্ম মানুষকে মিলিত হতে দিচ্ছে না। কন্যা-পিতার বিভেদ থেকে যাচ্ছে। নাম বদলে নানা আড়াল খুঁজলেও পিতা কন্যাকে পায়নি। সামনে পেলেও বুঝতে পারেনি। ধর্মীয় সংস্কার চিনতে দেয়নি। অথচ এই দেশ গান্ধি, বিবেকানন্দ, লালনের। ধর্মীয় মেরুকরণে বিভাজিত মানুষ লুৎফরের নায়ক। সমস্ত হারানো, বিচ্যুত, বঞ্চিত, পীড়িত মানুষ শুধু আশা খোঁজে। ধর্ম সেই আশার কড়াইতে ছাই ঢেলে দেয়। মানুষ বহু চেষ্টা করেও তা অতিক্রম করতে পারে না। হারিয়ে যায় মানুষ। সম্পর্ক। বেঁচে থাকা শুধু আর্তনাদ। বুক ফাঁটা চিৎকার। যন্ত্রণাময় চিত্রভাষ্য। চরিত্র পথ পায় না। কিছু করার নেই। পাঠকেরও কি কিছু করার আছে? পাঠ পরবর্তী চেতনার পরিবর্তন ঘটলেই লুৎফরের সার্থকতা। এক এক পদযাত্রার গল্প। সব হারানো মানুষের স্নেহ, দায়িত্ব খোঁজার গল্প। মেলেনি সন্ধান। হারিয়ে গেছে ভালোবাসা, শুভবোধ। হারিয়ে দিয়েছে ধর্ম। এ এক যাত্রাপথের গল্প। ঘরে ফেরার গল্প। ঘরের না ফেরাও গল্প। গন্তব্যে সবাই কি পৌঁছতে পারে? না পারা সম্ভব? দ্বিধায় ঝুলে থাকে যে জীবন, যে জীবনের পরিণতি একটি বিন্দুতে, সেই শূন্য তারে ঝুলতে থাকা জীবনকে এখানে ভাঙা একতারায় বাজানো হয়েছে। সুর-বেসুর, সৌন্দর্য-সৌন্দর্যহীনতাই এর মাপকাঠি। জীবনের রন্ধনশালা থেকে যে ঘ্রাণ উঠে আসে, এমনকি দরিদ্র বলেই যা পরম-চরম, সেই অরোমান্টিক জীবনস্বপ্ন বাজান লুৎফর।

    বাস্তবতার নানা অলিগলি দিয়ে মানুষরতন খোঁজের মধ্য দিয়ে লুৎফর রহমানের আত্মপ্রতিষ্ঠা। মনুষ্যত্ব, মানবতা কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সেই ভয়ানক বাস্তব প্রতিষ্ঠা করা। লুৎফরের নায়করা সহজ বিশ্বাস, জীবনানন্দের দোলায় ভর করে বেঁচে থাকে। আসলে জীবনসত্য খোঁজে। সেই চলার পথের ভয়াবহ রূপ-অরূপের মোহে বাঁচা-মরাকে বরণ করে। আত্মগ্লানিতে বিষণ্ণ হয়। কালদণ্ডের প্রহরী হয়ে শক্ত হাতে মানবতা প্রতিষ্ঠায় লুৎফর সংগ্রাম চালিয়ে যান। সেই পথের বিঘ্ন ও বিষণ্ণতা নিয়ে লুৎফরের আখ্যানভুবন।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *