রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ
দেবার্ঘ্য গোস্বামী ‘ঊনচারণ’ (২০২২) আখ্যানের শুরুতেই জানিয়েছেন ‘গল্পরা নিজেরাই গল্প করবে নে’। বাস্তবপক্ষে আখ্যান তো তাইই। লেখক কিছু সূত্রবদ্ধ দলিলকে মঞ্চে নামিয়ে দেবেন। সেখানে ভাষা ও উপস্থাপন মাধ্যম হয়ে উঠবে। ইতিহাস, সমসাময়িক প্রবাহ, মিথ, লোককথা, প্রান্তিক যুদ্ধ, রূপকথা, লোকশ্রুতি, সংকট, মাইগ্রেশন, আধিপত্যবাদ সমস্ত মিলিয়ে একটা জারণ ঘটাবে। তার মধ্যেও কাহিনি থাকবে কিন্তু তা বাস্তবের প্রথাগত স্বরকে ভেঙে দিয়ে বাস্তবকেই প্রতীয়মান করবে। দেবার্ঘ্য গোস্বামী ইতিহাসের প্রচ্ছন্ন স্বর, লোককথা-লোকশ্রুতি স্থানীয় ইতিহাসকে আখ্যানের পিঠে বয়ে বেরিয়েছেন কিন্তু ঢঙ সম্পূর্ণ নতুন। একটা বিরোধাভাস, বিচ্ছিন্নতা, একটা অদৃশ্যজাল রেখে তিনি খণ্ড খণ্ড সত্যকে ঐক্যবদ্ধ সত্যে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আখ্যানে ক্রমাগতই বিচ্ছিন্নতার খেলা চলে অথচ তা বাঙালির ইতিহাসের একটা বৃহৎ ইতিবৃত্ত রচনা করতে চায়। উপস্থাপন গুণে আখ্যান বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বৃহত্তর ইতিহাসের জানালা দিয়ে কত গল্প ছিটকে যায়, মিথের ঝুলন্ত উপত্যকায় কত গল্পের উপাদান দোদুল্যমান হয়ে থাকে, স্থানীয় লোককথা, রূপকথার আনাচে কানাচে কত অদৃশ্য কথা নদীতে ভাসে ডোবে, জেগে ওঠে। এই বিচ্ছিন্ন সত্যকে গদ্যের ঘূর্ণিতে পাক খাওয়ালে একটা তীব্রগতির ঝর্ণা প্রবাহের জন্ম হয়। সেই গদ্য ঝর্ণাই এ আখ্যান।
এ আখ্যান আসলে এক স্মৃতিগদ্য। হতাশা-আক্ষেপ-স্বপ্ন নিয়ে জীবন যুদ্ধের ফসল। নিজের জীবনতরণী কীভাবে বইছে তার সঙ্গে সমাজ-ইতিহাস-সময়ের গল্প। লেখকের দক্ষতা শব্দের আভিজাত্য ও গদ্যের মুন্সিয়ানায়। উত্তর বাংলার লোকায়ত শব্দমেলার সঙ্গে তিনি দার্শনিক সুর নিবন্ধ করে একটা চলমান জীবন সুর শুনিয়েছেন। সেখানে যাত্রা পাঁচালি থেকে লোকায়ত খাবার, উত্তর বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, প্রান্তিক সুর, বিদ্রোহ-আন্দোলন, মিথ মিলেমিশে একটা অদ্ভুত জারণ আবিষ্কৃত হয়েছে। মুখের ভাষা, লোকাল কালার ডুবে গেছে লেখকের সাবলীল ভঙ্গি ও গদ্যের দুরন্ত গতির কাছে। সংক্ষিপ্ত পরিচ্ছেদে জীবনের ঘটমান বর্তমানকে তিনি এমন এক রেখায় বেঁধেছেন যার ফল্গুধারা পাঠকের মানসবীণায় একটা দীর্ঘশ্বাস তুললেও তা অলীক জালে ভেসে যায়।
কান্নার স্বরলিপি দ্বারা এ আখ্যানের বাজনা বেজেছে। সংকট এখানে সিংহমূলে। দিন আনি দিন খাই মানুষ বন্যায় ভাসে, গ্রীষ্মে পোড়ে। আজও নদী পরাপারের ভরসা নৌকা, সাঁকো। বন্যার ফসল ডোবে, গৃহ ডোবে, নৌকা ডোবে। দুশ্চিন্তার পাহাড় নিয়ে জনপদ আবার কর্মে ডুব দেয়। দুলালের জীবনপরিক্রমা যেন জনপদেরই পরিক্রমা। সে জনপদেরই অংশ। আখ্যানের কেন্দ্রে দুলাল থাকলেও সে প্রকৃতপক্ষে জনপদের অবিচ্ছিন্ন অংশ। লেখক জনপদকেই ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। সেখানে অজস্র সংবাদ, অজস্র সংকট, অজস্র দিগন্ত। এখানে গল্প গড়ে, গল্প ভাঙে, গল্প পাক খায়, নিঃসঙ্গতা-শূন্যতায় গল্প ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ কেউ নিত্য বাউল হয়ে জনপদকে প্রদক্ষিণ করে। ক্ষোভ, অভিমান, বিতৃষ্ণা, দুশ্চিন্তা ডুবে যায় ছোট নদীতে। এখানে জীবন নিত্য বাঁক নেয়। সেই জনপদ পদাবলিই আখ্যানে রূপায়িত হয়েছে অনন্য ভাস্কর্যে।