লেখক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
আপনার বই “পর্ণাকে যা বলা হয় না” আমি সম্প্রতি সংগ্রহ করেছি। ফেসবুকে আপনার লেখা অনেকদিন ধরেই পড়ছি কিন্তু বইয়ের এই সংকলন একেবারেই আলাদা অভিজ্ঞতা। এ যেন এক আশ্রয়হীন সময়ের অন্তর্জার্নাল।
আমি কোনো সাহিত্য সমালোচক নই। একজন শিক্ষিকা, ফিজিক্স পড়াই। দিনের শেষে, নিজের মতো করে বই পড়ি। আর এই বইটা আমার কাছে শুধুমাত্র কবিতার সংকলন নয়, বরং এক ধরণের ব্যক্তিগত মনোগ্রাফ, যেখানে প্রেম, অভিমান, রাজনীতি, ধর্ম, শরীর, আত্মহনন, সব একসঙ্গে কথা বলে।
আমরা দুজন কেউ কাউকে চিনি না। কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি, কোনও সাহিত্য মঞ্চে আপনার কবিতা শুনিনি, এমনকি ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টেও আপনি নেই।তবু, আজকাল নিয়মিত আপনার লেখা পড়ি। অদ্ভুতভাবে টান পড়ে যায়। এমন কি টান, জানেন?
টানটা কল্পনায় খুব সহজ:
যেন সিগন্যাল না পাওয়া এক বিকেলবেলা, যখন ইলেকট্রনের গতি বোঝাতে গিয়ে আমি বোঝাতে পারি না নিজের ভিতরের ক্ষরণটা। ঠিক তখনই আপনার কবিতা চোখে পড়ে।
প্রথমেই বইয়ের নামের কথা বলি।
“পর্ণাকে যা বলা হয় না” — এই নামেই একধরনের অনুচ্চার সংলাপ তৈরি হয়। মনে পড়ে যায় ফাইনাল ইয়ারের সেই ছাত্রীটিকে, যার ভেতরে কোনও না বলা কথা জেগে থাকত প্রতিটি পরীক্ষার কাগজে। অথচ মুখে কখনও কিছু বলত না। পর্ণা আমার জন্য হয়ে উঠেছে এক প্রতীক। নিরুপায়, প্রতীক্ষাময় এক নারীর নয়; বরং, আমাদের সবার মধ্যেকার অপ্রকাশের ছায়া।
“দেবপ্রিয়ার জন্য শেষবার”-এ সিরিজ আমাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।আপনি কী পরিপক্বভাবে ভাঙন, মানসিক অবসাদ, অভিমান ও প্রেমের শেষাংশকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন!
“ডাক্তার তুখোড় গোয়েন্দা নয়”
“একটা নিঝুম ও অবাস্তব রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে জোনাকি সম্পর্কিত সমস্ত ধারণা ভেঙে যাচ্ছে…”
এইসব পংক্তি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, একজন আত্মজীবনীক লেখক কথা বলছেন, কিন্তু তিনি আত্মদর্শন করছেন বলে নয়, তিনি নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন অনেকগুলো চরিত্রে।
আমি নিজেও তো ঠিক এমন।মাঝে মাঝে আমার নিজের মনে হয়, আমি তিনজন: ক্লাসে পড়ানো আমি, ছাত্রের মুখে লজ্জা দেখে হাসি চাপা দেওয়া আমি, আর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আমি। যে একটা ছায়ার কাছে বলি, “চাইতেও পারিনি তো… সেইজন্যই পেলাম না”।
এই সিরিজ আমার মনে হয়েছে এক চিকিৎসাশাস্ত্রবিরোধী কবিতা সংকলন। যেখানে রোগ আছে, ওষুধ নেই। আত্মঘাতী প্রেম আছে, কোনো প্রতিকার নেই। তবু আছে কবিতা। আর কবিতাই এখানে ইসিজি রিপোর্ট।
“অশ্বত্থ ছায়ায়” —আমি পদার্থবিদ্যা পড়াই।
তাই ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, এসব নিয়ে কৌতূহল থাকলেও সরল বিশ্বাস নেই।কিন্তু আপনার “অশ্বত্থ ছায়ায়” সিরিজ আমাকে চিনিয়েছে এক অবৈষয়িক চেতনার শরীর, যেখানে জোৎস্না মানে ছায়া, আর একতারার গঠন মানেই জীবনের কাঠামো।
“অশ্বত্থ পাতার মুকুট পরে এই পৃথিবী আদর্শ ভিখিরি হতে শেখাচ্ছে বারবার”
এমন পংক্তিতে আপনি কোনও ‘ধর্মীয় তীর্থযাত্রী’ নন।আপনি এক প্রশ্নশীল ঘুমহীন পথিক।এই সিরিজে আমি যেন ফিজিক্স আর কবিতাকে একসঙ্গে হাঁটতে দেখি। একদিকে ঘূর্ণন গতি আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র, অন্যদিকে আপনার সেই কনফেশন:
“তোমাকে পেয়ে গেলে দুঃস্থ সংসার আগলে রাখার মতো অভিশপ্ত হতাম”
“পাইনি বলে, নিঃস্ব হওয়ার মতো সাধনচেষ্টায় আছি”
এমন সরল অথচ বিধ্বস্ত আত্মোপলব্ধি আমাকে থমকে দেয়।
“ইনসেপশন”- এই কবিতা যেন এক দর্শনচর্চা ও পলিটিকাল সাইকোলজি’র ল্যাব রিপোর্ট।আপনি শুধু হতাশ নন,আপনি সতর্ক, অনুমানশীল, ঘুমে ভয় পাওয়া একজন টেকনিক্যাল শব।
“চৌরাস্তা মোড়ে গোমাংস উৎসব”
“মুখ খুলে মুখোশ, মুখোশ খুলে সিরিয়াল কিলার জোকার”
এইসব লাইন যেন এক প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম, অথচ রক্তমাখা, অথচ বিষণ্ণ, অথচ সত্য।
আপনার কবিতায় রাজনীতি আছে। রাষ্ট্রের পরাজয় আছে।আপনি বিশ্বাস ভাঙেন না, বিশ্বাসের কঙ্কাল দেখান।
“বেচুর ধাবা” -এই কবিতা পড়ে মনে হলো, আপনি এক আদিম দর্শনঘর বানিয়েছেন।
যেখানে টিউশন ফেরত প্রেম, স্কুলবন্ধুদের মুখ, মাতৃস্নেহ খোঁজা বেশ্যার কোলে। সবকিছু যেন এক মানসিক অভিভাবকহীনতা।
“আমার জন্মরহস্য নিয়ে গুঞ্জন ভেসে বেড়াবে রাতের বাতাসে”
পাশে বসে থাকা মাতাল দার্শনিকের মতো আপনিও জীবনের ও গোধূলির মাঝামাঝি জায়গায় বসে আছেন
শ্মশান”, “শ্মশান থেকে বলছি”, ও “রুগ্ন মার্কশিট” —এসব লেখা আপনি অন্ধকারে লিখেছেন, গ্যাস আলোয় নয়।
“আমাকে একা ভেবো না…”
“লোকটা ছুটছে তো ছুটছেই
লোকটার ইন্টারভিউ শেষ হচ্ছে না”
এগুলো আমি কবিতা ভাবি না।এগুলো একটা জ্বলন্ত সত্তার স্ক্যান রিপোর্ট।এতে প্রেম নেই, আছে অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেঙে পড়া, পারিবারিক লজ্জা, অর্থহীনতা, প্রতিহিংসার গোপন হাহাকার।এই যে “ভাঙা মার্কশিট, বায়োডাটা” হাতে লোকটা ছুটছে, সেখানেই তো আমি, আমরা, সমাজ!
“গালিব সাহাবের পানশালা” —এই কবিতা একেবারে বিস্তৃত ব্যথার পটচিত্র।
পিছনে ফেলে আসা বন্ধু, হারানো মাউথ অর্গান, বাবার সাইকেল, জাদুকরের মতো এড়িয়ে যাওয়া প্রেম।
“মানুষ ঠুনকো জীব। অভিমানে ভেঙে যায়, প্রতিশোধে কাঁদে।”
এই লাইনটা যেন এক সাধারণ নিউট্রিনো পার্টিকেলের গতিপথ বুঝে ফেলার মতো, দৃশ্যমান নয়, কিন্তু প্রভাবময়।
“শবরীদির জন্য সেলফি”, “বেমানান”, “তখন কৈশোর” —এই কবিতাগুলো যেন একজন অজানা দার্শনিকের ব্যক্তিগত থিসিস।
আপনি যখন লেখেন :
“বাবার প্রথম প্রেমিকার বুকে দাঁত বসিয়ে মেপেছি মা-কে”
তখন পাঠিকা হিসেবে আমি শুধু স্তব্ধ হই না, একরকম ‘চিকিত্সাজনিত নৈঃশব্দ্য’ অনুভব করি।এমন কবিতা যদি কোনো সাহিত্যসভায় পড়া হয়, আমি জানি, বেশিরভাগ মানুষ মাথা নোয়াবে। বুঝতে পারবে না ঠিক কী বললেন আপনি।তবু, ঠিক সেখানেই আপনি সৎ, আপনি সাহসী।
শেষে বলি, কবি নন, আপনি এক কবিতাগ্রস্ত বিজ্ঞান.আপনার কবিতা বিশ্বাস, ধর্ম, রাজনীতি, শরীর, প্রেম, আত্মহনন, মদ, শহর,সবকিছুকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু আপনাকে স্পর্শ করতে দেয়নি।
আপনি নিজেই বলেছেন:
“আমি এমন লম্পট মন নিয়ে সাধনা করতে পারি না”
“আমাকে জানতে হলে আমাকেই ভাঙতে হবে”
এই ভাঙার ভিতরেই আপনি নিজেকে ধরেছেন।আর আমি, একজন অজানা পাঠিকা, আজ নিজেকে খুঁজে পেলাম এই ভাঙনেই।আপনার বই পড়ার পর আমার ছাত্রছাত্রীদের বলতে ইচ্ছে করে,
“দেখো, এমনও কবিতা হয় — যেখানে চেনা কষ্টরাই গায়ে গন্ধ মেখে ফিরে আসে।”
আপনার কবিতা বোদ্ধাদের জন্য নয়। অভিজ্ঞদের জন্য।যারা প্রেমে ব্যর্থ, যারা ঘুমে নষ্ট, যারা ট্রেন মিস করে।তারা বুঝবে আপনার কথা।
আপনার প্রতি শুভেচ্ছা রইল।
এই বইটা অনেককেই নাড়িয়ে দেবে,বিশ্বাস রাখি।
একদিন এই বইটিকে বলা হবে “কথার ভিতর শব্দের লুকিয়ে পড়া প্রমাণ”।
আপনার বইটির জন্য কৃতজ্ঞতা।
কারণ, এই বই শুধু কবিতার সংগ্রহ নয়। এই বই আমাদের সময়ের ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সাহস।