রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ
এম.এ. পড়ার সময় একদিন পড়ে ফেললাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থ। সে এক বিপুল উন্মাদনা। ওইরকম গদ্যে স্মৃতিকথনে নিজেদের যৌবনের দ্রোহ ও স্বপ্নের আলেখ্য বড় মধুর। কিছু পরে জীবেন্দ্র সিংহ রায়ের ‘কল্লোলের কাল’ পড়ে তথ্য জানছি, সেই কালের খুঁটিনাটি জানছি।
কলেজে পড়তেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের শত গল্প পড়ে ফেলেছি। সত্যি কথা বলতে সেসবে ডুবে গেছি। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদনের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছি না তো। মধসূদনের শব্দ, আধুনিকতা, বীরাঙ্গনার চেতনা, নারীবাদ দ্বারা আকৃষ্ট হচ্ছি বটে কিন্তু মেলাতে পারছি না। বরং কবিতায় নজরুল, সুকান্ত, জসীমউদ্দিন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলাতে পারছি। সব বোঝা যাচ্ছে। নজরুলের ‘সঞ্চিতা’, সুকান্তের ‘কবিতা সমগ্র’ ডি.এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত, যার বিধ্বংসী ভূমিকা লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জসীমউদ্দিন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা (দে’জ)। এই সম্বল। গল্পের সমাপ্তিতে অচিন্ত্যকুমারের যে দক্ষতা তা মুগ্ধ করে চলেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবন সম্পর্কিত যে আন্তরিকতা, সহানুভূতি তা মনে দাগ কেটে যাচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্র কিছু বোঝা যাচ্ছে। রবীন্দ্র উপন্যাস ঠিক আছে। শরৎচন্দ্র বড় মধুর। বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর নিয়ে ডুবে আছি। প্রভাস স্যার অনেক অনেক পড়তে বলেছেন, গ্রামীণ লাইব্রেরিতে যা পাওয়া যায় পড়ে যাচ্ছি। ভালো তো লাগছেই। গরিব মানুষের জন্য তুলির কলমের রচনাবলি যথার্থ।
কল্লোলের একটা নিজস্ব আধুনিকতা ছিল। রবীন্দ্র ভাববলয়ের বাইরে এসে প্রথম নতুন কিছু বলার সাহস দেখিয়েছিল। অনেকেই কল্লোলের আধুনিকতাকে অস্বীকার করেন। বুঝে পাইনা। জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এনে তালগোল পাকিয়ে কল্লোলকে উড়িয়ে দিতে চান। বুঝি না। সময়ের আধুনিকতা বলে তো কিছু আছে। রবীন্দ্র ভীতি তো কল্লোলই কাটিয়ে দিল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বা বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃতি টেনে আনছি না।
আমাদের স্যার ড. দীপক চন্দ্র বর্মন কল্লোল যুগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। কল্লোলের অভিমুখ, কোথা থেকে কল্লোলীয় চেতনার জন্ম হল, কেনই বা রবীন্দ্রনাথ থেকে সেদিনের তরুণ প্রজন্ম দূরে চলে গেল, কোন প্রেরণা দিয়ে সাহিত্যভূমিতে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সুর শোনালেন সে সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণী আলোচনা করেছেন।
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মণীশ ঘটকসহ লেখকরা কীভাবে নিজের আত্মপ্রতিষ্ঠা করলেন। নিম্নবর্গের চেতনা কীভাবে প্রতিষ্ঠা পেল। সাহিত্যে কোথায় কল্লোলের অবদান, কল্লোল কেন বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীকালের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কল্লোলের চেতনা কীভাবে প্রসারিত হল তা নিয়ে জরুরি তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন।
গত শতকের আটের দশকে নিম্নবর্গের চর্চার নামে যে বিপুল জোয়ার এল, কোথায় নিম্নবর্গের চর্চার সীমাবদ্ধতা, কারা কল্লোলের উত্তরাধিকার বহন করে এল, এমনকি গত শতকের সাত-আটের দশকে যে বিপুল পরিমাণে নিম্নবর্গের মানুষ বাংলা কথাসাহিত্যে উঠে এল তার সুর কোথায় ছিল, কীভাবে তা দ্বিতীয় দশক থেকে এইপর্যন্ত বয়ে এল তার তত্ত্বতালাশ করেছেন নিপুণ বিশ্লেষণে ও স্মার্ট গদ্যে। বইটি পড়ে ভালো লেগেছে।