রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ
ছোটো পরিসরে বৃহৎ ক্যানভাসের শিল্পী অরূপ মিত্র (১৯৬৬)। দেখাটা জীবন্ত বলেই গল্পের কাহিনির জন্য কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে হয়নি। সেইসঙ্গে কয়েক দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, পত্রিকা সংলগ্ন সাহিত্যের প্রখর বাস্তবতা ও পেশায় থিয়েটার কর্মীর ফলে সাহিত্যের তাত্ত্বিক ধারণাসহ বাঁকবদলের আভাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকায় আখ্যানে তিনি সহজেই উড়ান দিতে পেরেছেন। মিথ পুরাণ, লোকভাষা, আঞ্চলিকতা, উপনিবেশ-উপনিবেশোত্তর ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতির ডিসকোর্স নিয়ে তিনি এমন জারণ আবিষ্কার করেন যার নান্দনিকতা বড় প্রখর। টেক্সটের মধ্যে নানা কারুকাজ, প্রচ্ছন্ন বাস্তব, অধিবাস্তব, জাদুবাস্তবের প্রয়োগ এবং মিথের আড়াল দিয়ে সত্য-মিথ্যার উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে তিনি এমন এক স্কেচ নির্মাণ করেন যা বাস্তবকে শুধু ছিন্নভিন্ন করে তাই নয় পাঠককেও এক বড় প্রশ্নের মুখে টেনে আনে।
আখ্যান নিয়ে ভাঙাগড়া নয় সমান্তরাল আখ্যানের ভিতর দিয়েই তিনি নানা গলিপথ আবিষ্কার করেছেন। ভাষা নিয়ে সচেতন বীক্ষণ, শিল্পের নানা পরিসরের খোঁজ ও স্বতন্ত্র উপস্থাপনের ঝোঁক গল্পকে নিয়ে গেছে আলাদা ফর্মে। সর্বত্রই তিনি যে সফল তাও নয়। তবে বেশকিছু ক্ষেত্রে জরুরি। তঞ্চকতার বাইরে, ছদ্মশিল্পের একরৈখিক সীমারেখাকে ভেঙে তিনি নতুন গড়নে এগিয়ে গেছেন। সফল-ব্যর্থতার প্রশ্ন নয় কিন্তু যে টেক্সটকে ধারণ করেছেন তার বাইরে-ভিতরে রয়েছে একাধিক বীক্ষণ। সেই বীক্ষণগুণেই তিনি ভাসমান।
‘হননমেরু’ (১৯৯৬) একটা ফ্যান্টাসিতে ভেসে গেছে। অভিলাষ আত্মহননের রসদ হয়ে উঠেছে। বাস্তবের ঘনায়মান অন্ধকারকে অতিক্রম করে দুই চরিত্র (মতিন, সমরেশ) নিসর্গের সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে একটা মায়ামেঘ রচনা করতে গিয়ে বাস্তবের ধোঁয়াশায় আটকে গেছে। গল্পে একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। নিসর্গের সৌন্দর্যবিলাস থেকে প্রকৃতির নিকেতনে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে অলীক সৌরভের আধার কেমন হতে পারে, চরিত্র আত্মসত্তা রোমন্থনের মধ্য দিয়ে কীভাবে পরিসর খোঁজে, যে পরিসর ব্যক্তির আত্মমুক্তি ঘটায় অথচ যেখানে ফাঁদ অবধারিতভাবে থাকে সেই গোপন রহস্যের দুয়ার খুলে দেন।
‘ঘাতক’ (২০০৩) হয়ে ওঠে নষ্ট সময়ের দলিল। আমাদের সময় প্রক্রিয়ায় নানা পচন ধরেছে। ক্রাইম, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, পার্টি, ঘাতকতন্ত্রে ভরে গেছে গোটা সময়। সর্বত্র চুঙ্গি, কমিশন, পার্টি ফান্ড, দপ্তরে দপ্তরে শতাংশ, হফতা ইত্যাদি চিত্রনাট্যে গোটা সময়টাই দংশনখত হয়ে উঠেছে। সেই জঘন্য সময় স্বরলিপি মন্থন করে তিনি আখ্যানকে উঠিয়ে এনেছেন। ইহা তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদার অবিনাশের জীবনাভিজ্ঞতা। দলীয় রাজনীতি থেকে মিনি মস্তান, ঠিকাদারী পাওয়ার জন্য লোকাল নেতার পিছনে ঘোরা, পার্টি ফান্ডে অর্থ দান, মিনি মস্তানের খতম থেকে নিজের ব্যর্থ যৌনতা নিয়ে স্বপ্নভঙ্গের মধ্যে চুরির হইচই। ছিঁচকে চোর জানিয়েছে—“যে মানুষ জীবনে কখনও চুরি করেনি প্রথম আঘাত সেই করবে।” (হননমেরু, শহরতলি, প্রথম প্রকাশ, জুন ২০২৩, পৃ. ১৬) ডিসকোর্স চরিত্রকে জীবনজিজ্ঞাসায় উপনীত করছে। বয়ান চরিত্রের আত্মসত্তা খননের চাবিকাঠি জানান দিয়ে যাচ্ছে। অরূপ মিত্র খুব সচেতনভাবে সময়কে মন্থন করছেন। বড় সময়ের ভিতরে যে ছোট সময়, যার গোপন আঘাত ছোট বৃত্তে ক্রমেই মিনি সন্ত্রাস চালায়, যা বড় পরিসরে ধরা পড়ে না, রাজনীতির নিচু বৃত্তের কর্মকাণ্ড বলে ছাড় দিয়ে রাখে অথচ যা ব্যক্তিকে ক্রমেই ঘাতকময় করে তোলে সেই রহস্য বেরিয়ে আসে।
‘পরমা’ (১৯৯৪) গল্পে আদিনাথের চাহিদা যৌন আকাঙ্ক্ষা না বিকৃত যৌনতা? আদিনাথ জীবনের সমস্ত দিকে জয়ী হয়েও আত্মগ্লানিতে ভোগে স্ত্রীর স্তন ছোটো বলে। একি স্বাভাবিক যৌনতার অভাব না ভোগবাদী সভ্যতার প্রদর্শন প্রভাবিত অতিরিক্ত চাহিদা। স্বপ্ন দর্শনে ব্রাহ্মণের উপদেশ, তা প্রয়োগ, স্তনের আকৃতি বৃদ্ধি অবশেষে মৃত্যু ও লোভে পাপ পাপে মৃত্যুর বয়ানের মধ্য দিয়ে একি জাদুবাস্তবতা না তন্ত্রমন্ত্রের কুফল। বয়ান ঝুলে থাকে অধিবাস্তবের উপর। পাঠক যেমনভাবে গ্রহণ করবেন তেমনই বরণীয়। কিন্তু ভোগবাদী সভ্যতায় অতিরিক্ত চাওয়া পাওয়া ও ভোগবাদের গহ্বর ব্যক্তির পতন কীভাবে অনিবার্য করে তোলে সেই জীবনরহস্য উঁকি দেয়।
‘খরা’ (১৯৯০) গল্পে গ্রামীণ সমাজবাস্তবতা বড় প্রখরভাবে ব্যক্ত হয়েছে। দিনাজপুরের ভূগোলে কৃষকের সর্বস্ব বিপর্যয়ের আলেখ্য বর্ণিত হয়েছে। বন্যার পর খরা, মহাজনের সুদ, জলের লেয়ার নেমে যাওয়া ও জলের অভাবে ধানের শুকিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ সমাজবাস্তবতার নির্মম চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। আশাহত জোনাকু অবশেষে জমির দিকে তাকিয়ে হলুদ হওয়া ধান গাছ গোরু দিয়ে খাইয়ে দিয়েছে। একজনের পেট না ভরলেও পশুর তো পেট ভরুক। একজন সর্বস্বহারা হলেও অভুক্ত পশুর ক্ষুধা তো মিটুক।
‘বিদিশা ক্ষমা কোরো’ (১৯৯৮) গল্পে নাটকীয় পরিসর আছে। আছে জীবনের বাঁকবদলের আভাস। জীবনের প্রগাঢ় বাস্তবতার রসদ থেকেও গল্পের পরিণতি ঘটেছে অন্য মুহূর্তে। আবার সে মুহূর্তও বাস্তবের চিত্রকেই স্পষ্ট করে। এখন প্রশ্ন হল দুর্নীতির গন্ধ পেয়েও, দুর্নীতির ইশারা দিয়েও গল্পের বাঁকবদল কি আর্টের পরিসর সৃষ্টি না ঘোলা রাজনীতির বদলনামা থেকে গল্পকে বাঁচিয়ে রাখা। গল্পের কাহিনি এমন—অরিত্র ও দিব্যেন্দু দু’জন বন্ধু ও বেকার। অরিত্রের বোন বিদিশার সঙ্গে দিব্যেন্দুর প্রেম এবং অরিত্রের বাড়ির সকলেই তা জানে। দু’জন স্কুলের ইন্টারভিউ দিতে যায়, সেক্রেটারি টাকা চান। টাকার গন্ধ শুনে অরিত্র তা বাতিল করে দেয় আর দিব্যেন্দু সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানায় টাকা না দিলে তার কন্যাকে বিবাহ করতে হবে। দিব্যেন্দু অনেক যুক্তিতে প্রেমিকাকে বাদ দিয়ে সেক্রেটারির কন্যাকে বিবাহ করে অনিশ্চিত থেকে জীবনের নিশ্চিত পরিসরে চলে যায়। রাজনীতির একটা গন্ধ আছে, দুর্নীতির একটা ঘ্রাণ আছে কিন্তু গল্প সে পথে যেতে যেতেও বাঁকবদল করেছে। হেমন্তের শীতের মতো স্পর্শময় উষ্ণতায় তা জীবনের প্রকোষ্ঠে ঢুকে গেছে। সেই দুর্নীতি, রাজনীতিকে সামনে রেখে বাস্তবের আরও এক বৃত্ত গড়ে তোলা যেত কিন্তু অরূপ মিত্র সেদিকে না গিয়ে আরেক বৃত্ত গড়ে নিয়েছেন। এটাও কম মজবুত নয়।
অরূপ মিত্রের ন্যারেশনে একটা বিচ্ছিন্নতা আছে। আছে বাস্তবের অবভাস। সমান্তরাল জাল বিভাজিকায় চলতে চলতেই তিনি একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আছে দৃশ্যবদলের খেলা। অরূপ মিত্রের গল্প পরিসর গত শতক পর্যন্ত একটা বলয়, এই শতক থেকে আরেকটা বলয় ধরা যেতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণপ্রবণ মনন, জীবনচেতনা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘শেষকৃত্য’ (২০০৬) গল্পে যে রাজনীতির ডিসকোর্স গড়ে তোলেন তা জরুরি আয়োজন বলেই মনে হয়। পার্টি রাজনীতির দ্বন্দ্ব, পার্টির মধ্যে বেনোজল ঢুকে যাওয়া ও পার্টির মধ্যেই যে সংস্কার তার বিরোধাভাসের মুখোশ দ্বিধাহীনভাবেই খুলে দেন। কমরেড বাসু হালদার জীবনচেতনা থেকে সন্তানদের নাম রেখেছেন লেনিন, স্ট্যালিন। সত্তরের যোদ্ধা পার্টি ক্ষমতায় এলে অনেকটাই কোণঠাঁসা হয়ে গেছে। ক্ষমতাপিপাসু, লোভী মানুষ ততদিনে পার্টিকে ভোগ করছে। কিন্তু আদর্শ সচেতন, নীতিবাদী বাসু কোণঠাঁসা হয়ে গেছে। আসলে পার্টিতে এইভাবে বেনোজল ঢুকে গিয়েছিল। পিতৃ আদর্শে যে জীবনচেতনা, আদর্শ, মূল্যবোধ, সংস্কারপ্রবণ মন গড়ে উঠেছিল পিতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেখলেন পার্টিতেও সেই সংস্কার। শহীদ ট্যাগে সকলকেই ভুলিনি ভুলব না স্লোগান কোথায় যেন সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিরোধভাস। বয়ানে উঠে আসে—
“সারাদিনের এই ঘটনাক্রম এও কি এক রিচুয়াল নয়। প্রতিবার যন্ত্রবৎ একইরকম? প্রতিবার একই স্লোগান। একইরকম মুষ্টিবদ্ধ হাত। একইভাবে পুষ্পার্ঘ্য। একঘেঁয়ে যান্ত্রিক সুরে কর্তব্য পালনের মতো ‘আন্তর্জাতিক’ গেয়ে যাওয়া।” (তদেব, পৃ. ৪২)
যেখানে পার্টি সংস্কারে ভেসে যায় সেখানে একজন পার্টিকর্মীর ছেলে আবার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে কীভাবে। লেনিনও ভেসে যায় শ্রাদ্ধনামক সংস্কারে। রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি থেকেও থানায় থানায় কালী মন্দিরের নবনির্মাণ চলে। রাষ্ট্র অরগানাইজ করে ধর্মকে ইন্ধন জোগায়। ফল ভুগতে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে। তৃণমূল পার্টি বিজেপি বিরোধিতা করেও পূজা প্যান্ডেলে রাম মন্দিরের স্কেচ আটকাতে পারে না। পাবলিক ইস্যু বলে ভোটের গন্ধে পিছিয়ে আসতে হয়। গোটা সিস্টেমটাই এলোমেলো হয়ে যায়। অরূপ মিত্রের দক্ষতা এখানেই যে তিনি সেই আমলে বসেই পার্টির অভ্যন্তরীণ গোলাযোগ ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। এইসব গল্প থেকে বা গুরুত্বপূর্ণ বীক্ষণ থেকে পার্টি কোনো আধুনিক চিন্তায় পৌঁছে যায়নি, ফল যা হবার তাই হয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টি জীবনচেতনা গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনবোধ গড়তে অক্ষম হয়েছিল। শুধুমাত্র জনগণতান্ত্রিক জোয়ার ও মতাদর্শের আলগা ফানুসে ভেসে গেছে। ফলে কমিউনিস্ট পার্টি তিনদশকের বেশি ক্ষমতায় থেকেও কুসংস্কার, বিশ্বাস, জাতপাতের ভেদাভেদ ঘোঁচে না। এমনকি যারা পার্টিতে এসেছে বহুক্ষেত্রে তারা কেবল মতাদর্শ প্রচারের বাহক হয়েছে, নিজের বোধ থেকে তা গ্রহণ করেনি। এমনকি সেসব বিশ্বাসও করেনি। নইলে ক্ষমতাচ্যুত হতে পার্টি এমনভাবে ভেঙে পরে? সংগঠনের ভিতর কত গলদ আছে তা পার্টির পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। এই নষ্ট পুঁজ রক্ত মাংস ঘেঁটে অরূপ মিত্র দেখাতে চান প্রকৃত বাস্তব এমন। ফলে সংঘাতে যেতে গল্পের আয়োজন বড় করতে হয় না। খুব সাধারণভাবেই তিনি সেই সত্যে পৌঁছে যেতে পারেন।
‘আংটি’ (২০১৮) গল্পের ত্রিদিবেশ ছাত্রজীবনে কমিউনিস্ট রাজনীতি, পরে শিক্ষক হয়ে বিজ্ঞান আন্দোলনের শরিক হলেও নিজের মেসে নবাগত মুসলিম ছাত্রের জন্য জায়গা দেয়নি। ভেদাভেদ, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে সে উঠতে পারেনি। বিজ্ঞান আন্দোলন, পার্টি এসব শুধু উদ্যাপন হয়ে থেকেছে। সেই সংকটের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে দেন লেখক।
কথ্য ভাষা, আঞ্চলিক সংলাপে লোকাল কালার যেমন বজায় রাখেন তেমনি স্টোরি টেলিং এ কিছু বিচ্ছিন্ন সংবাদ এনে ইতিহাসের সূত্র ধরিয়ে দেন। আছে মিথ, ইতিহাস, রূপকথা ও বাস্তবের উপকথা নির্মাণ প্রক্রিয়া। সেই প্রকল্পে জাদুবিদ্যা এসে ন্যারেটিভকে ক্রমেই বদলে দেয়। ‘পূর্ণদাসের নৌকা’ (১৯৯৭) গল্পে মিথ, ইতিহাস, জাদুবাস্তব ও নির্মিত প্লটের আড়ালে আছে ইতিহাসের অত্যাচারের বয়ান। মুক্তিযুদ্ধকালীন বীভৎস বাস্তবতা যেমন উপস্থিত হয় তেমনি শিল্পীর জীবনচেতনার গল্প গড়ে তোলেন। সেই জীবনচেতনায় জাদুবাস্তবতায় ভেসে যায় পূর্ণদাস নির্মিত মূর্তি। শিল্পীর জীবন শিল্পের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত। শিল্প থেকে শিল্পীকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বাস্তব-অবাস্তব, অতীত-বর্তমান, ঘটমান বাস্তবের বন্যা ও রোমন্থনের বাস্তবে শিল্পীর ভেসে যাওয়া সব মিলিয়ে এক অনবদ্য স্কেচ। রাজনীতি হোক বা শিল্পীর জীবন লেখক এক বোধে উপনীত হতে চেয়েছেন। তা হল পরিচ্ছন্ন সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধ। বিকৃত সভ্যতার বুকে ঘটে যাওয়া স্বরলিপি থেকে তিনি আরেক ভুবন গড়ে তোলেন। সেই অধিবাস্তবে সংযুক্ত বাস্তব যেমন স্পর্শময় হয়ে থাকে তেমনি সাহিত্যের ফর্মগুলি সূক্ষ্মভাবে মিশে থাকে। যা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
লোককথার সঙ্গে লোকপুরাণ, বাস্তবের অন্ধকার থেকে পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারের বয়ানে পৌঁছে গেছেন ‘মেঘদেবতা’ (২০০৪) গল্পে। ঔপনিবেশিক পর্বের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে লোকায়ত পরিসরের মেলবন্ধনে নারীজীবনের এমন স্কেচ গড়ে তুলেছেন তা প্রশংসনীয়। মহাভারতের যুগ থেকে সমস্ত ক্ষেত্রে নারীকে অত্যাচারের স্বীকার হতে হয়েছে। পুরুষের লালসা থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশল হিসেবে নারী ব্যবহৃত হয়েছে। সেই ডিসকোর্সকে বাস্তবের অন্ধকারের চিত্রনাট্যে হুদুম দ্যাও নামক লোকায়ত বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে তিনি মিথের বাস্তবে পৌঁছে গেছেন। মিথকে ভেঙে ভেঙে, মিথের মধ্যে গল্পের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন জীবনের সাঁচ এমন। ন্যারেটিভে ঔপনিবেশিক পর্বের বয়ান, ঠাকুমার উপকথা শোনানোর ক্যানভাস, প্রাচীনকালে হুদুম দ্যাওয়ের ইতিহাস থেকে বাস্তবের খরা সবটা মিলে যে পরিসর গড়ে তোলেন তা গ্রামীণ সমাজ বাস্তবতার বিভীষিকাকে যেমন ব্যক্ত করে তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শোষণের ছলাকলা থেকে অর্থনৈতিক সংস্থিতি রক্ষার মাধ্যম হিসেবে নারীকে ব্যবহারের বহুমাত্রিক ইন্ধনের স্বরূপ বেরিয়ে আসে।
অরূপ মিত্র রাজনীতির ডিসকোর্সকে এমন ভঙ্গিতে, এমন বয়ানে উপস্থাপন করেছেন যা জরুরি বীক্ষণ বলেই মনে করেন। অরূপ মিত্রের লেখন সরণি যত এগিয়ে এসেছে গল্পের তীব্রতা, নান্দনিকতা ও আখ্যানের প্রখরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আখ্যানের মধ্যে প্রবাহিত সময়ের অন্ধকার, রাজনীতির অমাবস্যা, ইতিহাস, পুরাণের বিচ্ছুরণ দ্বারা এমন জাল বিভাজিকা গড়ে তোলেন তা সময়ের ভাষ্য হিসেবে যেমন গুরুত্বপূর্ণও তেমনি আখ্যানের ন্যারেটিভ হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ। অরূপ মিত্রের আখ্যানের বড় ধর্ম তিনি প্রতি আখ্যানেই ভাষাটাকে বদলে ফেলেন। ভাষা যেহেতু আখ্যানের চালিকা শক্তি তাই আগেই তিনি ঠিক করে নেন কোন ভাষায় ন্যারেটিভকে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। বহুক্ষেত্রে উপনিবেশবাদ থেকে উপনিবেশোত্তর বয়ান, ইতিহাসের ছিন্নসূত্র থেকে ঘটমান বর্তমানের অন্ধকার তাঁর আখ্যানের যাত্রাপথ। সেই যাত্রাকে তিনি জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তব, লোকায়ত পরিসরের ভুবন ও মিথের নানামাত্রিক প্রয়োগ দ্বারা উপস্থাপন করেন। ‘শবসাধনা’ (২০০৯) গল্পে প্রশ্ন উঠতে পারে কিসের শবসাধনা? অবধারিত উত্তর আসে লাশের। রাজ্যের পালাবদলে, ক্ষমতা দখলে প্রয়োজন কিছু লাশের। মফস্সলের লাশ চালন দিতে হবে মহানগরে। সেই লাশকে কেন্দ্র করে মিছিল, খতম, আঘাত-আবেগ সব দ্বারা বেগম চায় ক্ষমতা দখল। এই বীক্ষণকে তিনি জাদুবাস্তবতা, বাস্তবের অন্ধকার ও লোকায়ত পরিসরের তন্ত্রমন্ত্র দ্বারা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা সময়ের গ্রহণযোগ্য পাঠ হিসেবে বেশ কার্যকর। আখ্যানের শুরুতেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন—
“প্রিয় পাঠক আপনি যদি মোকাম কলিকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হইয়া থাকেন, অথবা প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে মহানগরীতে নিত্য যাতায়াত থাকে, তাহা হইলে আখ্যানমুখের এই নগরপরিক্রমা অংশটি না পড়িলেও চলিবে। তবে কিনা অধুনা বাঙ্গালা সাহিত্যের পাঠকভূগোল মহানাগরিক কেন্দ্রের বাহিরেও প্রসারিত। সেই সমস্ত প্রান্তবাসী, গ্রামীণ অলস অথবা নিতান্তই বিভিন্ন অপারগতা হেতু যাহাদের কখনও নগর কলিকাতার সহিত মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখ্যত তাঁহার যাহাতে এই আখ্যানকে সম্পূর্ণ অনুসরণ করিতে পারেন, তজ্জন্যই মুখবন্ধে এই নগর পরিভ্রমণ। এতদ্ব্যতীত সাহিত্য যেহেতু ইতিহাসের উপাদান মাত্র এবং কালের দ্রুত প্রবাহে এই মহানগরী দ্রুততর পরিবর্তমান তাই বর্তমানের কিছু চিহ্নকে শনাক্ত করিয়া রাখিতেও চাহিতেছে এই আখ্যান।” (তদেব, পৃ. ৬৬)
উপনিবেশ থেকে উপনিবেশোত্তর স্থাপত্যের ইতিহাস বদলে গেল। পরাধীনতার মানচিত্র দূর করতে স্থাননামের বদলের মধ্য দিয়ে যে সময়নামা গড়ে উঠল তা একদিন পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে গেল। বসুশ্রী চিত্রগৃহের ছায়াচিত্রের প্রেক্ষাপট থেকে আখ্যান অধিবাস্তবে চলছে বাস্তবের অন্ধকারে। আখ্যান জাদুবাস্তবে, অধিবাস্তবে চলছে কিন্তু তল দিয়ে যাচ্ছে বাস্তবের অন্ধকার। পাঠক রাজ্যের ক্ষমতার পালাবদলের মানচিত্র মনে মনে পরিকল্পনা করে নিন। গাড়ি কারখানা, শিল্প কারখানা, ভাতের কারখানা থাকলে লাশের কারখানা থাকবে না কেন? যেখানে লাশই বদলে দিতে পারে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সেখানে তার ব্যবহার তো জরুরি। মফস্সল থেকে লাশ চালন চলতে থাকে মহানগরে। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটলেও লাশের চালন বন্ধ হয় না। যেখানে মুনাফা লাভ হচ্ছে সেখানে লাশের চালান তো চলতেই থাকবে। দেখা যাক আখ্যানের বয়ান—
“উল্লাস শুরু হইল বেগম শিবিরে। এইবার নির্দেশ গেল শবস্রোত বন্ধ করিবার। কিন্তু উপায় নাই। লাশের কারখানা হইতে কারখানা পরিচালকদের নাহক লাভ হইতেছে। কারখানার পশ্চাতে বিনিয়োগও হইয়াছে প্রচুর। এক্ষণে হুট বলিতেই চাট্টিবাট্টি গুটাইয়া লওয়া সহজ কর্ম নহে। ফলে শবের উৎপাদন বারিতেই লাগিল। মহানগরীর সমস্ত সরণি, দপ্তর, গৃহ মৃতদেহে পরিপূর্ণ হইল। কেবল অঘোরী তান্ত্রিকের ছিন্নমুণ্ড কেন জানি বিড়বিড় করিয়া বলিতে লাগিল—এত রক্ত কেন?” (তদেব, পৃ. ৭১)
সময়কে ছিন্নভিন্ন করে বয়ান নিজেই চলতে থাকে। শুরু হয়ে যায় পৈশাচিক বীভৎস লীলা। চলতেই থাকে লাশ মিছিল। ছিন্নমুণ্ডু খেলা করে। রাজ্যপালের কমোড থেকে ছিন্নমুণ্ডু মিছিলে যেতে চায়। রক্ত চায়। ভেঙে পরে আইনশৃঙ্খলা। পালাবদল ঘটলেও লাশ মিছিল অবিচ্ছিন্ন থাকে। বাস্তবের ভয়াবহ অন্ধকারকে তিনি ভেঙে ভেঙে অদৃশ্যজালে ব্যক্ত করে চলেন। সাধুভাষার গদ্যে অঘোর তান্ত্রিকের মায়াজাল, বাস্তবের ছিন্নভিন্ন রহস্য সব মিলিয়ে যে আতশকাচ গড়ে ওঠে তা বাস্তবকেই যেন বড় প্রশ্নের সম্মুখে ফেলে দেয়। অরূপ মিত্রের আখ্যানে নন্দনতত্ত্বের নানা মাত্রা আছে। আছে কিছু জটিল জীবন জিজ্ঞাসা। জীবন ঘেঁটে তিনি পাঠককে একটা বোধে নিয়ে যেতে চান। জাগতিক পরিসরের সমস্ত ছলাকলা ও জীবনচক্রের খেলার ভিতরে রয়েছে নানা রহস্য। ব্যক্তির কাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত মননধর্ম, বোধ-বুদ্ধি ও চালিকাশক্তির পাশাপাশি আছে নিয়ন্ত্রণশক্তি। যা প্রতিমুহূর্তে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে এক বোধ থেকে আরেক বোধে নিয়ে যায়। ‘বৃক্ষজাতক’ (২০০৬) গল্পের বোধিসত্ত্বর জীবনতৃষ্ণা ও জীবনকে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখার মধ্য দিয়ে লেখক ক্ষুধা, যৌনতা, স্বাধীনতার যে বয়ান গড়ে তোলেন তা অনবদ্য।
‘অভিসর’ (২০২১) তুলনায় হালকা গল্প। রোমান্টিক জীবনচেতনায় ভেসে গেছে। লকডাউন পরবর্তীকালে অফিস ট্রিপে এসেছে অনিমেষ। লকডাউন ও লকডাউনকেন্দ্রিক সংলগ্ন বীভৎস বাস্তবতায় যাবার আভাস থাকলেও তিনি সেদিকে জাননি। এমনকি লকডাউনে রিসর্টগুলি ও পর্যটনকেন্দ্রিক জীবিকানির্ভর মানুষগুলির অনাহার নিয়ে যে আরও এক বাস্তব আছে সেদিকেও জাননি। তিনি রচনা করেছেন স্মৃতিনির্ভর রোমান্টিক প্রেমের গল্প। অনিমেষের রোমন্থনে যৌবনের প্রেম ভেসে এসেছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, বিচিত্র জীবনবোধ নিয়ে তিনি গল্পের আসরে নেমেছেন। তেমনি পাঠককে একটা শুভচেতনায়, একটা আদর্শ বোধে এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জারণ থেকে একটা কল্যাণ চেতনায় নিয়ে যেতে চান। ‘আয়ুধ’ (২০২১) গল্পে হিংসার বিরুদ্ধে সমস্ত অস্ত্র বিসর্জনসহ অহিংস নীতি গড়ে তোলার যে বয়ান আছে তা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের পৃথিবী ক্রমেই কীভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে তার বিরোধাভাস যেমন রেখে যান তেমনি মুক্তি কোথায় তারও চিত্রনাট্য বজায় থাকে।
অরূপ মিত্র সংক্ষিপ্ত পরিসরেই বহুরূপের বাজনা বাজিয়েছেন। পুনরাবৃত্তি দোষকে সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়ে বিচিত্র বীক্ষণে আখ্যানের ঘর-বাহির সাজিয়েছেন। তিনি নিজেকে ক্রমাগত ভাঙছেন। কোথাও বিচ্ছিন্নতার ঢঙে, কোথাও অ্যাবসার্ড, কোথাও লোকায়ত পরিসরের অন্দরমহলের সূত্র ধরে ন্যারেটিভকে একটা আশ্চর্য রূপকে নিয়ে যান। জটিল রহস্যজাল অপেক্ষা সাধারণভাবেই বীক্ষণকে জানান দেন। তিনি দেখান এই আমার সময়, আর সময়ের বিরোধাভাস এমন। সেই সংরূপে তিনি যেমন পার্টিহোল্ডারকে আক্রমণ করেন তেমনি দেখান এইভাবে সময় আক্রান্ত হচ্ছে। সেই আক্রান্ত সময়ের জাঁতাকলে পিষ্ট নায়কের নানা দ্বন্দ্ব, পক্ষ-বিপক্ষের ছাইচাপা বিরোধাভাস ও তত্ত্বগত পরিসর—সমস্ত মিলিয়েই তিনি নিজে যেমন বিরজমান থাকেন তেমনি পাঠককে ঘুরপাক খাওয়ান।