রবি আড্ডায় সঞ্চিতা সান্যাল
সঞ্জয় কি লেখেন? ভাবতে গিয়ে দেখেছি হারিয়ে ফেলতে চাওয়া ইতিহাস যা নথিতে বদ্ধ হতে পারেনি নানান কারণ অথবা অকারণে, তাদেরকে নির্জনে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গাঁথেন। তাঁর শব্দ ও বাক্য নিখাদ নাগরিক। কিন্তু বিস্ময়কর।
প্রত্যেকের যে কলকাতায় আসার একটা ধরণ থাকে সে কথা এভাবে ভেবে দেখা হয়নি যেভাবে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়ে হাওড়ার মফস্বল থেকে উত্তর কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হলাম। হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রিট, মানিকতলা শ্যামবাজার, বাগবাজার, শোভাবাজার আহিরিটোলার স্যাঁতসেঁতে কখনো ভ্যাপসা এই নগরজীবন দেখার লোভে হাঁটতে থাকতাম।
স্নান খাওয়া শেষে বাসন ধোয়ার জল গড়িয়ে এসেছে ফুটে। তাই ডিঙিয়ে চলেছি। পুরোনো বাড়ির ছায়া এসে পড়তো পথে। সেই ছায়া গায় মেখে দুপুরবেলা মাঝেমধ্যে হাঁটতাম ঐ সব শিরা উপশিরার মতো গলিগুলির ভেতর দিয়ে।
খিড়কি দেওয়া লম্বা জানলা, গরাদের মতো গ্রীল দেওয়া বারান্দা, রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা পোর্টিকো, ছাদের আলসে থেকে ঝোলা সাদা থান,ক্ষয়া ক্ষয়া ধরণের মিষ্টির দোকান… দেখতে দেখতে চলে যেতাম বাগবাজার ঘাট।
তারপর স্টীমার ধরে হাওড়া। জোয়ারে জেটির দোল দেখতাম। স্টীমারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছলাৎ ছলাৎ ভাগীরথী জলে ভিজতো আমার সুতির সালোয়ার। বাগবাজার ঘাটের এক ঠোঙা ঝালমুড়ি খেয়ে ঠোঙা ছুঁড়ে দিতাম জলে… ঢেউয়ের তালে তার ওঠাপড়া দেখতাম। তলিয়ে যাওয়া দেখতাম।
এসব কথা স্মৃতির অতলে চুপটি করে ছিলো ঘুমিয়ে। জাগলো তারা “ও চাঁদ, আহিরিটোলায়” পড়ে। এটি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের গদ্য চর্চার অন্তর্ভুক্ত।
সঞ্জয় কি লেখেন? ভাবতে গিয়ে দেখেছি হারিয়ে ফেলতে চাওয়া ইতিহাস যা নথিতে বদ্ধ হতে পারেনি নানান কারণ অথবা অকারণে, তাদেরকে নির্জনে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গাঁথেন। তাঁর শব্দ ও বাক্য নিখাদ নাগরিক। কিন্তু বিস্ময়কর।
উত্তর কলকাতার কথা লিখতে গিয়ে তার বিষাদকে ছুঁয়েছেন কতো না অনুভূতিময় সব বাক্যে…
” বেহুলার ভেলায় যে রূপসী ভেসে যাচ্ছে জ্যান্ত শবদেহ নিয়ে তার লাবন্য শহরের ইতিহাস। উত্তর কলকাতা অনেকটা ইস্তাম্বুলের মতো। একটি শহরের আসল নিসর্গ তো তার বিষাদ।”
এই শহরের বিষাদ- ইতিহাসে ধরা থাকে এজমালি চৌবাচ্চায় স্নান সেরে অফিসে দৌড়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর কথা।
তিনি বলেন,
মতি নন্দী থেকে রমেশ চন্দ্র সেন, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী এই কলকাতার সেইসব জনগোষ্ঠীর কথা লেখেন, যারা হাভাতে নয়, কিন্তু জীবন যুদ্ধের প্রান্তসীমায় লটকে পরিত্রাণ খোঁজে মৈথুনে।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় লেখেন, এইসব লেখক ভাগ্যিস অমরতার দরজায় রাতদুপুরে কড়া নেড়ে ছিলেন, তাই নথিগুলো বদ্ধ হতে পেরেছিলো। আমাদের মেজাজ মর্জি ও যোগ্যতায় যা অধরা ছিলো এতোদিন।
কোনির লেখককে সঞ্জয় হাজির করেছেন অনন্য উদ্ধৃতিতে…
মতি লেখেন,
“টিমটিমে একটা ইলেকট্রিক বাতি বহুদূরে একটা দেওয়ালের থেকে জিভ বার করে বৃষ্টি চাটছে…মনে হলো রাস্তাটা সাঁতার কাটছে ঝাপসা আলোয়”।
মনে পড়ে, কলেজ থেকে ফিরতে সন্ধ্যে হলে বাগবাজারের রাস্তায় দেখতাম বাতির আলোয় উত্তর কলকাতার বাড়ির দেওয়ালে লেখা ঝাপসা হয়ে আসা “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” স্লোগান গুলো মুছতে চেয়েও মুছে যায় নি কোনো এক অজানা রহস্যে। দেখতাম স্ট্রীট লাইটের আলো গড়িয়ে পড়ছে তাদের ওপর দিয়েই।
মতি নন্দী পড়া হয়নি তেমন। অপরাধ বোধে নত হই যখন সঞ্জয় মনে করিয়ে দেন,
” যে দেশে সাহিত্য পাঠক সৌন্দর্যের স্তব করে, প্রাণপনে বিশ্বাস করে বিরহ দহনের পরেও অনন্ত আছে সেখানে মতি পাতালের চিরকুট বিতরণ করেন অক্লেশে।”
এইটুকু শুধু বলা…
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় পড়তে গিয়ে বিন্দুতে সিন্ধু দেখা হয়।