সঞ্চিতা সান্যাল
গতকাল যখন শুনলাম ইয়েচুরি আর নেই… তখন আমি স্বাস্থ্য ভবনের সামনে। ডাক্তারদের আন্দোলন চলছে।
ঢাক আর কাঁসরের তালে তালে চলছে তাদের স্লোগান। তারাও বলে চলেছেন এই হলো তাদের উৎসব। কারণ, বিপ্লবই তো উৎসবের আরেক নাম।
ইয়েচুরির মৃত্যু সংবাদ আর এই আন্দোলনের ঢেউ এক সঙ্গে তখন আমার বুকে আছড়ে পড়ছে।
তখন মনে পড়ছিলো, ইয়েচুরির “রাজনীতি” নয়, তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার জগতটির কথা….
মনে পড়ছিলো একজন সর্বসময়ের মার্কসবাদী রাজনীতিবিদের সাহিত্য পাঠের পরিসরটির কথা।
মনে পড়ছিলো সমাজবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম বইগুলোর হদিশ রাখা মানুষটির কথা…
মনে পড়ছিলো
তাঁরই একটি লেখা পড়ে জালাল-আল-ই আহমেদের লেখা পত্রের সঙ্গে আমার নিজের পরিচয়ের কথা।
Westoxification অথবা west-struck-ness শব্দটি আমাদের কাছে কম পরিচিত ছিলো একটা সময় । আমি সম্ভবত ইয়েচুরির একটি প্রবন্ধেই প্রথম জালাল-ই আহমেদের কথা জানতে পারি।
পশ্চিমকে অন্ধ অনকরণ করতে গিয়ে ইরান কিভাবে নিজের সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলো, তার অসাধারণ এক বয়ান নির্মাণ করতে গিয়ে এই westoxification শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক আহমেদ ফারদিদ।
প্রাচীন গ্রিক দর্শনের সরাসরি অনুপ্রবেশ প্রাচ্যের চিন্তার রাজ্যকে একটি ক্ষয়ে যাওয়া, ছাল ওঠা গাছে পরিণত করেছে।
জালাল -আল – ই- আহমেদ, এক ফারসি সাহিত্যিক, ইরানকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে এই “westoxification” শব্দটিকে “ঘারবজাদেগী” বা কলেরার সঙ্গে তুলনা করেন।
বলেন, এই অসুখ থেকে মুক্তি পেতে গেলে ইরানকে ভোক্তা নয়, উৎপাদক হতে হবে।
ইয়েচুরি,নিউক্লিয়ার পাওয়ার হাউসের বিরোধিতা করতে গিয়ে westoxification শব্দটিকে হাজির করেছিলেন তাঁর বক্তব্যে, তাঁর লেখায়।
লিখছেন,
একটি সমাজে আধুনিকতার অর্থ দাঁড়িয়ে থাকে সেই সমাজে মানুষের “মর্যাদা” বা dignity প্রতিষ্ঠার ওপর। শুধু মাত্র পশ্চিমকে অনুকরণ করে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আধুনিক ভারতবর্ষ গড়তে গেলে সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের হাতে সুযোগ পৌঁছে দিতে হবে।
“সুযোগ” সৃষ্টি একটা পরিকল্পনা। এর বিকল্প কখনোই শুধুমাত্র আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি হতে পারে না।
ভারতবর্ষকে দেখতে হবে সুযোগপ্রাপ্ত শ্রেনী এবং সুযোগ বঞ্চিত শ্রেনীর নিরিখে।
সমাজকে আধুনিকতার বিষ ( modern toxicity) থেকে উদ্ধার করতে গেলে আধুনিকতাকে অস্বীকার করতে হয়না।
আধুনিকতার সংজ্ঞাকে নির্মাণ করতে হয়।
আধুনিকতা হলো তাই, যা প্রতিটি মানুষের হাতে সমান সুযোগ পৌঁছে দেয়!
এই ইয়েচুরিকে আমরা কতোটুকুই বা পড়েছি!
কতো টুকুই বা জেনেছি!
ইয়েচুরি ছিলেন স্বচ্ছ ও স্পষ্ট চিন্তার এক রাজনীতিবিদ…
একে একে নিভিছে দেউটি।
আপনাকে শ্রদ্ধা জানাই কমরেড!