অর্পিতা গোস্বামী চৌধুরী

তখন রেডিওর যুগ। সন্ধ্যাবেলা গানের একটা অনুষ্ঠান হত। কি নাম মনে নেই। যেমন আরও অনেক পরে টিভিতে হত চিত্রহার, অনেকটা তেমন। বাইরের ঘরের চৌকিতে রেডিও চলছে একটার পর একটা গান। হঠাৎ শুরু হল “আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ… “। গানটা শুরু হওয়ার সাথে সাথে সাদা টেপ জামা পড়া আমি উঠে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করলাম। ওখানেই বসে থাকা আমার পিসি বলল, জানতাম তুই এখনই দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করবি। আসলে সেই বছরই রিলিজ করেছিল সিনেমাটা। আর প্রতিটি গান হয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়। সালটা ১৯৮১। সিনেমার নাম “অনুসন্ধান”। অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, রাখী, আমজাদ খান। আমজাদ খান তখন শুধু অন স্ক্রিন নয় বাস্তবেও যেন সকলের মননে খলনায়ক। “ফেটে গেল ফেটে গেল কালিরামের ঢোল ” উচ্ছ্বাস সঞ্চারিত সকলের মধ্যে। তখন রেকর্ড প্লেয়ারের যায়গা করে নিচ্ছে টেপ রেকর্ড। কিন্তু সেও সবার বাড়িতে থাকত না। সবাই গান শুনতো রেডিওতে। D j বস্তুটি তখন মানুষের স্বপ্নেও আসেনি। মোবাইল টিভি এ সবের যুগও শুরু হয়নি। এরকম সময়ে দুর্গা পূজার পেন্ডেলে পেন্ডেলে চোঙা মাইক বেঁধে যে চারদিন ব্যাপি গানের সুর লহরী ভেসে বেড়াতো স্বাভাবিক ভাবেই তা অভূতপূর্ব এক শিহরণের জন্ম দিত। একেকটা পেন্ডেলে একেক রকম গান। সে বছর প্রায় সব প্যান্ডেলেই “অনুসন্ধান ” -এর গান চলছিল। দুর্গাপূজার সাথে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, “হায় রে পোড়া বাঁশি ” অথবা ওঠো ওঠো সূর্যাই রে”।
সময় গড়ায়, পুরনো দিন যায়, নতুন দিন আসে। মানুষের আবেগও নতুন রূপ রঙ ধারণ করে। মিউজিক সিস্টেম আধুনিক হয় তার তীব্রতা বাড়ে, মাধুর্য কমে। এখন সারা বছর তীব্র স্বরে গান বাজে যেমন সারা বছর নতুন জামা কেনা হয়, সারা বছর পোলাও মাংস আরও কত রকমারি খাওয়ার খাওয়া হয়। যেমন বাড়িতে বাড়িতে আর নাড়কোল নাড়ু, তিলের নাড়ু তৈরি হয় না। যেমন অনেক কিছু হয় না আর।
সেই সময়ের কথাই আরও একটু বলি। একদিন হঠাৎ করে শব্দ দূষণের দোহাই দিয়ে পূজা প্যান্ডেলে গান বাজানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবার মন খারাপ। সবার মুখে একই কথা, পূজা পূজা মনেই হচ্ছে না। এবং তখন থেকেই যেন সাবেকি পূজার শিহরণ শেষ হয়ে গেল। কিছুদিন বিরতি দিয়ে ফিরে এল নতুন ধরনের পূজা। বলা ভালো জেনারেশন চেঞ্জ হয়ে গেল। থিম পূজা ইত্যাদির আড়ালে আমাদের প্রজন্মের আবেগ কেমন যেন ইতিহাসের বিষয় বস্তু হয়ে দাঁড়াল। তবু এখনো আমাদের প্রজন্মের কেউ কেউ দুর্গা পূজার আগে আগে মহালয়ায় বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের “মহিষাসুর মর্দিনী ” শোনে। শিউলি ফুলের গন্ধ খোঁজে। ইউ টিউবে মান্না দে বা কিশোর কুমারের বাংলা গানে নস্টালজিক হয়ে ওঠে। আজ আমার অন্য কিছু নয় “অনুসন্ধান”-এর নস্টালজিয়া পূর্ণ মন বাহির মুখি। মনে গানের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষ। শহরে আলোর রোশনাই। দোকানে রাস্তায় জমজমাটি ভীড়। দূরে কোথায় থেকে যেন ভেসে আসছে পুরনো সেদিনের গান ‘হায়রে পোড়া বাঁশি, ঘরেতে, রইতে দিল না ঘরেতে’।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *