পুরুষোত্তম সিংহ
আজ বিদায়বেলা। বিষাদবেলা। সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে অধ্যাপনা করার পর অবসর নেবেন উত্তর দিনাজপুরের স্বনামধন্য অধ্যাপক ড. প্রভাস রায়চৌধুরী মহাশয়। তিনি কর্মসূত্রে রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হলেও গোটা জেলার বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক স্বরূপ ছিলেন। আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন এই মফস্সলে কর্মজীবন শুরু করেন তখন এই অঞ্চল অনেকটাই পিছিয়ে। বহু ছাত্রছাত্রীদের নিজের দক্ষতায় উপযুক্ত করে তুলেছেন। বাংলা বিভাগে পড়তে আসা সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছেন। শুধু শিক্ষাদান নয় বহু আর্থিক সাহায্যও করেছেন আড়াল থেকে। কোনোদিন আত্মপ্রচার করেননি। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে তা প্রকাশ পেয়েই গেছে।
যিনি ফুল ফোটাতে ভালোবাসেন তিনি সাহিত্যের ভুবনে ছাত্রছাত্রীদের বিকশিত করে তুলবেন এই তো স্বাভাবিক। ছাদবাগানে অজস্র ফুলের নন্দনকানন সাজানোর পাশাপাশি এই পিছিয়ে পড়া এলাকার কত ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছেন তার পরিসংখ্যান নেই। আসলে তিনি পরিসংখ্যান রাখতে চাননি, লোকমুখে নিজেই হয়ে উঠেছেন এক প্রতিষ্ঠান। আশ্রয় ও ভরসাস্থল। জীবনযুদ্ধ শুরু করেছিলেন মুর্শিদাবাদের কাগ্রাম নামক এলাকার সফল শিক্ষক পিতামহের নাতি হিসেবে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পাশ করে কর্মজীবন শুরু করার পর সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর অধীনে পিএইচ.ডি. লাভ করেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করে। থিসিসটি পরে ‘জীবন উপনিবেশের দ্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়েও সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু মহাবিদ্যালয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন।
কলেজ স্তরের পাঠ্য বিষয়ের উপর অনেকগুলি বই লিখেছেন। যদিও ভাবনা চিন্তায়, গদ্যে ও বিশ্লেষণে ছাত্র-শিক্ষক সকলের কাছেই তা বিশেষ সমাদার পেয়েছিল। বইগুলি হল—‘ইংরেজি সাহিত্য পরিক্রমা’, ‘অন্যরূপ ও ভাবনায় চণ্ডীমঙ্গল’, ‘শাক্ত পদাবলি : অষ্টাদশ শতকের বাঙালি জীবন’, ‘জীবনের দর্পণে বৈষ্ণব পদাবলি’, ‘রবীন্দ্র অনুভবে সোনারতরী’। এছাড়াও একাধিক সম্পাদিত গ্রন্থ। রসময় বাক্বিন্যাস, মৃদু শ্লেষ ও ব্যঙ্গমিশ্রিত কথনভঙ্গি দ্বারা হাস্যচ্ছলে কথা পরিসর রচনা করতেন। কখনোই বেশি কথা বলতেন না। সামান্য বক্তব্য দ্বারাই ছাত্রকে সূত্র ধরিয়ে দিতেন। প্রান্তিক এলাকার ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে এগিয়ে দেওয়া যায়, পিছিয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের কীভাবে শেষপর্যন্ত টেনে তোলা যায় সেই চেষ্টা সমস্ত জীবন ধরে করে চলেছেন তা নিজে চোখে দেখেছি। মানুষের প্রতি সদা জাগ্রত সহানুভূতিবোধ তাঁর জীবনের সম্পদ। ছাত্রছাত্রীদের ব্যর্থতা, ভেঙেচুরে যাওয়া জীবন ও দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতায় নিজেই কষ্ট পেয়েছেন সার্বাধিক। বারবার বলেছেন ‘সন্তানের মতোই তো, তাই কষ্ট পাই বেশি’।
আমি স্যারকে দেখে আসছি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। রুগ্ন দেহে পড়িয়ে চলেছেন। সামান্য বক্তব্য রেখেই একটা বিস্তৃত পরিসর গড়ে দেন। কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে দেখেছি সঠিক উত্তর না দিয়ে আশপাশ দিয়ে উত্তর দিতেন। খুঁজতে গিয়ে হতাশ হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে সঠিক উত্তর আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে বিষয়টি বুঝেছি। প্রথমে একটু অভিমান হলেও পরে বুঝেছি আসলে তিনি আমাদের সাহিত্যের আশেপাশের জগতকে খোঁজাচ্ছেন। বঙ্গসাহিত্যের বিশাল সমুদ্রের সঠিক মুক্তা খোঁজার বদলে এদিক ওদিকের স্বাদ গ্রহণের পথ তৈরি করে দিচ্ছেন। পড়ানোর ক্ষেত্রেও দেখেছি, আমাদের পাঠ্য ‘ধাত্রীদেবতা’, অথচ তিনি পড়িয়ে চলেছেন ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’। ‘ধাত্রীদেবতা’ নিয়ে স্যারের বই ছিল ‘ধাত্রীদেবতা : মা মাটি মানুষের বৃত্তান্ত’। রাজনৈতিক পালাবদলের দিনে পাছে কেউ অন্য কিছু ভাবে তাই পরের সংস্করণে নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ধাত্রীদেবতা : জননী জন্মভূমির বাক্প্রতিমা’। তবে ভয় পেতাম। গুরুগম্ভীর আচরণের তুলনায় ব্যঙ্গমিশ্রিত বাক্য প্রয়োগের জন্য।
ভাগ্যচক্রে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাকে পেলাম সহযোদ্ধা হিসেবে। সহযোদ্ধা শব্দটা বলা ভুল সেদিন থেকে তিনি আমাদের উপর বিশ্বাস করে সমস্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বলতেন ডুবিয়ে দিও না যেন। ঘটনাচক্রে আমাদের সাতজনের বিভাগের সকলেরই শিক্ষক তিনি। এমন দৃষ্টান্ত আর কোথাও আছে কি না জানা নেই। বিপদে তিনি রক্ষা করবেন কিন্তু আড়াল থেকে। নিজে মঞ্চ ছেড়ে আমাদের মঞ্চ দিয়েছেন। বারবার বলেছেন নিজেকে তৈরি করো এখান থেকে। সকলেই যখন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়, ক্ষমতাকে দখল করার জন্য নানা কলকাঠি নাড়াচাড়া করে তখন তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করে গেছেন। অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে। কিছুদিন পরে সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ে চলে আসেন। একজন নবাগত তরুণ অধ্যাপককে ক্ষমতা দখল করে রাখা অধ্যাপকরা যেভাবে দেখেন ঠিক সেইভাবেই দেখা হয়েছিল। কেউ কেউ পিছন থেকে কলকাঠি করেছিল। বারবার বলতেন বই কিনতে হবে, বই পড়তে হবে, ভালো ছাত্র হতে হবে। বলতে বলতেই একটু ব্যঙ্গ, একটু শ্লেষ। বারবার বলতেন বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে বই কিনলে অপরাধ হয়না, পূজায় জামাকাপড় কেনার বদলে বই কিনে নাও।
ঘরভর্তি বই, সারদিন বই পড়া, নোট মেকিং, নিজের লেখা ও সম্পাদিত বই করা। পূর্বোক্ত বইগুলি ছাড়াও আরও কিছু বই ছিল যা মূলত উত্তরপত্রভিত্তিক। কল্যাণী প্রকাশনীর সমরেন্দ্র উপাধ্যায় তখন বেকার যুবক। এক যুবককে জীবন সংগ্রামে সাহায্যের নিমিত্তে সেসব লেখা। এই সত্য আজ প্রকাশ্য দিবালোকে বলা থাক। বহু মানুষ এসে বিভিন্ন সাহায্য নিয়ে গেছে। লেখা, কীভাবে লিখবে, গবেষণা, মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসে বিরাট পাণ্ডুলিপি, অভাবের চিহ্ন দেখিয়ে নানা সাহায্য ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন মানুষটি সারাদিন বইপত্র আর ফুলগাছ নিয়েই থাকতেন। সেদিনও তেমন অ্যান্ড্রয়েড ফোন আসেনি। অ্যান্ড্রয়েড ফোন এলে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করে অনেকটা সময় অতিবাহিত করতেন।
আমরা যখন কলেজ স্তরে পড়তাম তখনও বই বিক্রির একটা রেওয়াজ ছিল। পরের দিকে বই কেনার প্রবণতাটা কমে এল। তখন কলেজ স্তরে প্রভাস রায়চৌধুরীর বইগুলি ভালো বিক্রি ছিল গোটা উত্তরবঙ্গেই। ছাত্রজীবনে জেলার বাইরের বন্ধুদের মধ্যে নানাসময়ে আলোচনায় দেখেছি তারা জানাচ্ছে প্রভাস রায়চৌধুরীর ওই বইটা পড়েছে। নিজের স্যার বলে সত্যি আনন্দ হত। গোটা উত্তর দিনাজপুরের বঙ্গসাহিত্যের আকাশেই PRC একটা হইহই রব। দেখেছি কেউ কেউ ক্লাসে গিয়ে তাঁর নামে দুর্নাম করে। তারা জানতো রায়গঞ্জ মানেই প্রভাস রায়চৌধুরী, যতটা দুর্নাম করে মঞ্চ ভেঙে দেওয়া যায়। তিনি কোনদিন বিবাদে যাননি, নীরবে নিভৃতে রুচিবোধ বজায় রেখে চলেছেন।
মোটা বেতনের অধিকারী বহু মানুষকে দেখেছি। তাদের সামাজিক অবস্থানও জানি। প্রভাস রায়চৌধুরীকেই দেখে চলেছি। স্পষ্ট পার্থক্য আছে। স্বভাব-চরিত্রে, বিবেকে বনেদিয়ানা এখনও বজায় আছে। পৈতৃক সম্পত্তি ত্যাগই শুধু নয় সারাজীবন দাদাকে দেখে যাওয়া। কত মানুষ এসে কত সাহায্য নিয়ে গেল, গেছে। অবসরের ভাবনায় বহুদিন থেকে ব্যাকুল হয়ে আছেন। শরীর ভেঙে গেছে যে। কোভিড পূর্বে অসুস্থ শরীরে এক বিকেলে ফোনে কান্না করে ফেললেন। থমকে গিয়েছিলাম। সত্যি সন্তানসম হিসেবেই ভালো বাসতেন। এই না পাওয়া জীবনে এ এক মস্ত বড় পাওয়া। নিজের প্রথম বইয়ের উৎসর্গপত্রে সেই স্যারকেই টেনে আনা। বই যখন হাতে তুলে দিচ্ছি বলেছিলেন—‘গুরুঋণ বলে কিছু নেই’। চিরকাল আশাবাদে বিশ্বাসী। বারবার বলতেন ‘ভালো হবেই’। ব্রাহ্মণ হলেও উদার চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন। কোনোরকম ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ব্রাহ্মণ্যবাদ ছিল না। এসব নিয়ে স্যারের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করেছি। বারবার বলতেন ‘সেসব অচল হয়ে গেছে, মানুষ কেন যে টেনে আনে’।
দিন বয়ে যায়। চেয়ার পদভারে নত হয়। সময় আসে হাজিরা খাতায় ছুটির। ম্লানমুখে চেয়ে থাকি সেই শূন্য ক্লাস রুমের দিকে। করুণা জাগে সেইসব ছাত্রছাত্রীদের জন্য যারা রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ের বারো নম্বর রুমে আর স্যারের ক্লাস পাবে না। যারা আর সেই ব্যঙ্গ, রসিকতা, শ্লেষ ও কণ্ঠ থেকে বঞ্চিত হবে। যারা শুনবে শুধু এই বিভাগে প্রভাস রায়চৌধুরী পাঠদান করতেন। এখন শুধুই বলা ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন/ বনস্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন।’