রবি আড্ডায় শৌভিক রায়

পর্ব – ৬

জুলাই-অগাস্ট মাসে দিনহাটা কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো চলে এলো।

আমার নিজের জন্ম ফালাকাটায়। খুব ছোটবেলার কয়েক বছর বাদে, ফালাকাটাতেই বড় হয়েছি। কিন্তু আমাদের কাছে পুজো মানেই দিনহাটা। মহালয়ার আগেই পৌঁছে যেতাম দিনহাটায়। আরও একবার আসা হত মাস খানেক আগে। মা ও কাকিমাদের নিয়ে বাবা যেতেন পুজোর বাজার করতে। তখন দিনহাটা চৌপথীর ওপর বিশুকাকুর পরিচ্ছদ ছিল নামী দোকান। উল্টোদিকেই হরিশ পালদের রেকর্ডের দোকান। হ্যাঁ ইনিই সেই প্রখ্যাত মানুষটি, যাঁর নামে কোচবিহারের একটি চৌমাথা পরিচিত।

ঠাকুমা-মা-পিসিমণি কাকিমায়েদের শাড়ি, কাকুদের ও পিসতুতো দাদাদের প্যান্ট-শার্টের পিস, ঠাকুরদার ধুতি-পাঞ্জাবি ইত্যাদি কিনতে প্রচুর সময় লাগত। ততক্ষণে আমি পরিচ্ছদের সাদা ফরাস পাতা গদিতে উঠে অপেক্ষা করতাম কখন নারায়ণী ড্রেস হাউসে যাব। ওখানে আমাদের অর্থাৎ ছোটদের জামা-কাপড় কেনা হবে। এখন, অর্থাৎ এই কলেজের সময়, পরিচ্ছদ দোকানটি আর নেই। বিশুকাকুরা দিনহাটার পাট চুকিয়ে কলকাতায় চলে গেছেন। বিশুকাকুর স্ত্রী বিমলা কাকিমা খুব স্নেহ করতেন। চৌপথী গেলে আর পরিচ্ছদ যেখানে ছিল, সেদিকে তাকালেই বিমলা কাকিমার কপালের বড় করে দেওয়া জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপের কথা মনে পড়ে। প্রতিযোগিতার এই বাজারে নারায়ণীও কবে যেন বন্ধ হয়ে গেছে।

কলেজের মাঠে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। দিনহাটা কলেজ পাড়ার পুজো সেই সময় খুব নামকরা। আজকের থিম পুজো বলতে যেটা বোঝায়, সেটা সেই আমলেই করে দেখাত কলেজ পাড়া। আমরা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম কলেজ পাড়া কী করে সেটা দেখবার জন্য। মহামায়াপাটের সাবেক পুজো ছাড়াও গোসানিমারী রোড আর সাহেবগঞ্জ রোডের পুজোরও আকর্ষণ ছিল। অন্যান্য পুজোগুলোও ভাল হত। দিনহাটায় আমাদের বাড়ি এমন জায়গায় যে, ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই গোধূলি বাজার, থানা পাড়া আর ডাকবাংলো পাড়ার পুজো। ভাসান হত থানা পাড়ার দিঘিতে।

দশমীর দিন তো বটেই, বাকি দিনগুলিতে বাড়ির সামনে বসে থাকলেই সময় কেটে যেত। তবে একদিন বাবার সঙ্গে আমাদের সবাইকে ঠাকুর দেখতে বেরোতে হত। সেটা বাধ্যতামূলক। সময়ের ব্যাপারে বাবার খুঁতখুঁতিনি চিরকাল। ফলে সন্ধে সাতটায় বেরিয়ে মোটামুটি রাত দশ-সাড়ে দশ ফিরে আসা হত। এটাই ছিল নিয়ম। কাকু-কাকিমায়েরা বাবার এই জলদি জলদি ব্যাপারে হাসাহাসি করলেও বড়দাকে অমান্য করতেন না। আসলে সেই সাহসটাই ছিল না।

ঠাকুরদা এখন নেই। ঠাকুমা আছেন। স্ট্রোকের পর কিছুটা উদভ্রান্ত হয়ে গেছেন। একদিন কলেজ ফেরত দেখি মসজিদের উল্টোদিকে সন্তোষী মা মন্দিরের পেছনে আগাছার মধ্যে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ঢেঁকি শাক তুলছেন। ঘরে নাকি কিছুই নেই। রান্না হবে। যে ঠাকুমা একদিন বাংলাদেশের বক্সীগঞ্জের বাড়ি থেকে নিজের জ্যেষ্ঠ সন্তান অর্থাৎ আমার বাবাকে জোর করে ধুবড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে, রামায়ণ-মহাভারত ছিল যাঁর কণ্ঠস্থ, নিরক্ষর হয়েও মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের বিভিন্ন পাঠ অনায়াসে ব্যাখ্যা করতে পারতেন যে মহিলা, তাঁর এই অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু উপায় নেই। জীবন এরকমই। বুঝতে পারছি ঠাকুমার শেষ ঘনিয়ে আসছে। আমার পাশের ঘরেই তিনি থাকেন। রাতের বেলা নানা কথা বলেন। সেই সব কথায় মৃত্যুর হাতছানি স্পষ্ট বুঝতে পারি।

এই সময় অনিলকাকু কিটসের কবিতা পড়াচ্ছেন To sorrow I bade good morrow/ And thought to leave her far away behind/ But cheerly cheerly she loves me dearly/ She is so constant to me and so kind/ I would deceive her and so leave her, but/ Ah she is so constant, so kind..... ঠাকুমাকে দেখে সেটাই মনে হয় বারবার। শুধু ঠাকুমা নন। তাঁর বয়সী সব মহিলাকে দেখেই কথাগুলি মনে পড়ে। নিজেদের সুন্দর গোছানো সংসার আর ভিটেমাটি ছেড়ে এঁরা অন্য দেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুন জায়গায় স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে আবার সংসার সাজিয়েছেন। কিন্তু এই সংসারে কোথায় সেই দেশের বাড়ির শান্তি আর স্বস্তি! সাজাতে সাজাতেই শেষদিন উপস্থিত। তবু সান্ত্বনা, কিছুটা ভরা সংসার দেখছেন তাঁরা। কিন্তু বাবার দুই পিসি, যাঁরা ছিলেন বাল্যবিধবা, তাঁরা তো জীবনে কিছুই পাননি। রাষ্ট্র ভাগ হওয়ায় নিজেদের স্বামীর ভিটেটুকুও জোটেনি। এই লজ্জা কার! কোনও রাষ্ট্র কি বোঝে সেটা? উত্তর আজও খুঁজি….

অধ্যাপক সব্যসাচী রায় ইকোনোমিক্স পড়াতেন। পাস সাবজেক্ট। সেরকম চাপ নেই। তবু ভাল লাগত ক্লাস করতে। ডেকে বললেন একদিন, তোর ইকোনোমিক্স পড়া উচিত ছিল। হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম, কোনও কলেজ সুযোগ দেয়নি। চরম হতাশায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। স্যার তো তবু বললেন। এটুকু কম কীসে! অধ্যাপক রণেন দত্ত ভারতের অর্থনীতি পড়াতেন। উনি আবার বাবার ছাত্র ছিলেন। ডাকবাংলো পাড়ায় বাড়ি। যদিও আমি পরিচয় দিইনি নিজের, কিন্তু কীভাবে যেন জেনে গেলেন। বললেন ওঁর বাড়ি যেতে। এটাও ছিল আমার বিরাট পাওনা। অধ্যাপক সাধন করকে দাদা বলেই মনে হত ওঁর ভাই সহপাঠী ভজনের জন্য।

পুজোর বাকি কিছুদিন। দিনহাটায় নানা জায়গায় প্যান্ডেলের কাজ শুরু হয়েছে। কলেজ যাওয়ার পথে মদনমোহন পাড়া, ভাটাপাড়ার আমরা কজন ক্লাবের পুজো প্রস্তুতি দেখি আর কলেজের মাঠে কলেজ পাড়া ক্লাবের। কলেজের পেছনে যে বিল রয়েছে, তাতে শালুক আর পদ্ম ফুটে গেছে। কলেজ হোস্টেলের কাছের পুকুরেও টলটলে জলের ধার ঘেঁষেও দেখা যাচ্ছে তাদের। আমাদের পাড়ায় অর্থাৎ গোধূলি বাজারে শেলিদির দোকানের পাশেই গেট বসছে বিরাট। শেলিদির দোকানের নাম প্রত্যুষা। ছোটবেলায় চিত্ত বোসের দোকান বলেই জানতাম। এই দোকানে দিনহাটার অবিসংবাদিত জননেতা কমল গুহ, শ্রদ্ধেয় দীপক সেনগুপ্ত প্রমুখদের আড্ডা দিতে দেখেছি। আসতেন অধ্যাপক হিতেন নাগ। বাবা ফালাকাটা থেকে এসে কখনও যোগ দিতেন। এখন অবশ্য সেই আড্ডা নেই। শ্রদ্ধেয় কমল গুহ এখন মন্ত্রী। আপাতত ভীষণ ব্যস্ত কোচবিহারের ক্যান্সার সেন্টার প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তাঁর স্বপ্ন আমাদের সবার আবেগ হয়ে উঠছিল ক্রমশ।

ছবি- কোচবিহার ক্যান্সার সেন্টার হসপিটালের জন্য বাবা কয়েকবার কিছু অনুদান দিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালের অনুদানের একটি রসিদ।

পুজো কেটে গেল। পুজোর ছুটির পর রীনা অনেকদিন ধরে নেই। পড়তেও আসে না। শুনলাম বেনারস গেছে। ওদের কোনও এক আত্মীয়ের বিয়েতে। একদিন সকালে কাকুর পড়ানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। রাজবাড়ির চূড়ো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি ছোট ছোট করে কাটা চুলের একটি পরিচিত মুখ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি রীনা। চুল কেটে ফেলেছে। মুখটাই বদলে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। হয়ত আমার দৃষ্টিতে কিছু ছিল। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চাপা গলায় স্বাতীকে বলল, কেমন করে দেখছে দেখ! কোনও দিন মেয়ে দেখেনি যেন......

(ক্রমশ)

পর্ব – ১

https://www.facebook.com/share/p/1EhQT8TFnh/

পর্ব -২

https://www.facebook.com/share/p/16jG4yr2hW/

পর্ব –

https://www.facebook.com/share/p/1CwTCvTFBQ/

পর্ব –

https://www.facebook.com/share/p/178KLupGrr/

পর্ব –

https://www.facebook.com/share/p/1CyRS1QJLH/

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *