
রবি আড্ডায় শৌভিক রায়
পর্ব- ৩
আমাদের দিনহাটার বাড়ি এক চিড়িয়াখানা। অদ্ভুত কিসিমের মানুষদের বাস। মানে আমার কাকুদের কথা বলছি। বড়কাকু মাঝে মাঝেই গামছা হারিয়ে বড় কাকিমার ওপর হম্বিতম্বি করেন। অধিকাংশ সময়েই অবশ্য গামছাটা তাঁর কাঁধেই দেখা যায়। আঙ্কল পোজারের দিনহাটা সংস্করণ বলা যায় তাঁকে। মেজকাকু করিৎকর্মা মানুষ। রাজমিস্ত্রির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর তৈরি করলেন। দরজার পাশেই জানালা। আলো-বাতাস বেশি করে ঢুকবে বলে মিস্ত্রির কথা উড়িয়ে দিয়ে জানালা বড় করলেন। শেষটায় দেখা গেল জানালার পাল্লা দিয়ে দরজা ঢেকে যাচ্ছে। সে এক কীর্তি। সেজকাকু শিল্পী মানুষ। নাট্যকার-অভিনেতা। কখন কোন কাণ্ড করবেন কোনও ঠিক নেই। ছোটকাকু কালী ভক্ত। ঘরে কালী মায়ের ছবি। সিঁদুর লাগানো। সামনে মড়ার খুলি। বিয়ে-থা করবেন না পণ করেছেন। এঁদের অত্যাচারে তিন কাকিমা আর ঠাকুমার অবস্থা খারাপ। এঁরা একমাত্র ভয় পায় নিজেদের বড়দা আর বৌদি অর্থাৎ আমার বাবা-মা`কে।

আমাদের প্রতিবেশীরা আমাদেরই জ্ঞাতি। তাঁরাও কেউ কম যান না। এ বলে আমায় দেখ, তো অন্যজন বলে তাকে দেখতে। সব কিছু মিলিয়ে সারাদিন হই-হট্টগোল লেগেই আছে। ফালাকাটায় আমাদের পাড়াটি অত্যন্ত নির্জন। দূরে দূরে এক একটি বাড়ি। সন্ধের পর থেকে চারদিক চুপচাপ হয়ে যায়। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর বীরপাড়াগামী যানবাহনের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। দিনহাটায় উল্টো। গায়ে গায়ে লাগানো বাড়ি। সবার কথা সবাই শুনছে। আমাদের জন্য বরাদ্দ দুটো ঘরের একটায় আমি থাকি। অন্যটায় ঠাকুমা। আমার ঘর থেকে হাত বাড়ালে পাশের বাড়ির জানালায় গিয়ে ঠেকে। পাশের বাড়িটি আবার বাবার মামাবাড়ি। আসলে স্বাধীনতার সময় সব আত্মীয়স্বজনেরা একসঙ্গে এসে এভাবেই পাশাপাশি বাড়ি করেছিলেন। অন্য পাশে যে বাড়িটি, সেটি আবার রেণুপিসির অর্থাৎ বাবার পিসতুতো বোনের। বোঝাই যাচ্ছে, সবাই জ্ঞাতি- দাদা, ভাই, কাকা, জ্যাঠা, মামা, পিসি, মাসি সম্পর্কে।
নিজের ঘর বলছি ঠিকই, আসলে ওটা বাবার ঘর। সুতরাং বাবা দিনহাটায় এলে আমি গৃহহারা। বিবাগী। আশ্রয় পিসির বাড়িতে। রেণুপিসির তিন ছেলে। তিনজনই আমার পরম বন্ধু। সম্পর্কে দাদা-ভাই হলেও, বন্ধুই বেশি। ওদের বাড়ির কোনও ঘরে বা মুদি দোকানে চাল-ডাল-তেল-নুনের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে রাতের ঘুম। গরমের রাতে দেড়টা-দুটো অবধি বড় রাস্তায় আড্ডা। বাড়িরই উল্টোদিকে মসজিদ। পাশেই দিনহাটা হাই স্কুল। স্কুলের উল্টোদিকে অর্থাৎ বাবার মামাবাড়ির পরেই থানা। পুলিশ কর্মীরা সবাই মুখ চেনা। সুতরাং আমাদের ভয় নেই। যতক্ষণ না ঘুম আসছে, আমাদের হ্যা হ্যা হি হি চলছেই।
অনার্সের কিছু বই জোগাড় হয়েছে। তার মধ্যে দুটো দিয়েছেন মানি। মানি মানে শ্রীমতী সন্ধ্যা সাহা। দিনহাটা গার্লস হাই স্কুলের সহপ্রধান শিক্ষিকা। ইতিহাসের এম এ বি এড রাশভারী মানি বিয়ে করেননি। তাঁর আভিজাত্য ও গাম্ভীর্য এতটাই যে, সবাই তাঁকে ভয় পায়। মায়ের সহকর্মী ছিলেন বলে, আমাদের বাড়িতে তাঁর নিত্য যাতায়াত। বলতে গেলে অভিভাবক। আমার দাদা ও আমি মানির অত্যন্ত স্নেহের। আমার ছোটবেলার একটা ছবি ফ্রেম বাঁধানো অবস্থায় মানির শো-কেসে রাখা। সাহেবগঞ্জ রোডে মানির বাড়ি। একাই থাকেন। অবশ্য বাড়ির অন্য অংশে তাঁর পরিজনেরা রয়েছেন। কলেজ থেকে ফিরে আমাকে প্রত্যেকদিন মানির বাড়িতে হাজিরা দিতে হয়। কোনও দিন মানি লুচি খাওয়ান, কোনও দিন পাঁপড় ভেজে দেন। দীর্ঘদিন একমাত্র মানির হাতে তৈরিই নারকেল আর তিলের নাড়ু, চিড়ের মোয়া আর পায়েস খেতাম। এমনকি মা করলেও খেতাম না। এখন মাঝে মাঝে সেসবও জোটে। স্বভাব গম্ভীর মানি প্রতিদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব খোঁজ নেন। এটা সেটা বলে বকুনিও দেন। কিন্তু তাঁর স্নেহ ফল্গুধারার মতোই অন্তঃসলিলা। বুঝতে পারতাম সেটা।
একটা সময় মানিকে নিয়ে ভীষণ অভিমান ছিল আমার। পালাতে চাইতাম মানির কাছ থেকে। প্রশ্ন ভিড় করত মনে। অনেক অপবাদে জর্জরিত হতে হতে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতাম। জানতে চাইতাম, আমি ঠিক কে। পরে বুঝেছি, সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমালোচনা শুনতে হয়। বিদ্ধ হতে হয় নানা ভাবে। কিছু সম্পর্ক থাকে যার কোনও নাম হয় না। তাছাড়াও এমন কিছু বিষয় থাকে, যা না জানাই ভাল। কেননা কোন সময়ে, কীসের পরিপ্রেক্ষিতে, কোন অবস্থায় কী ঘটে তা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সেজন্যই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শীর্ণ চেহারার অতি প্রবীণ কেউ যখন, কোমায় চলে যাওয়া মরণাপন্ন একজন মানুষকে দেখে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসেন নার্সিং হোম থেকে, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় তাঁর হাত ধরে বলি- আমি তো আছি!
কিন্তু পারি না। এক অদ্ভুত আড়ষ্ঠতা আটকে রাখে আমাকে। বারবার মনে হয়, অভিমান করার আমি কে! কতটা আমার যোগ্যতা?
…..পাস সাবজেক্ট হিসেবে অর্থনীতি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান উল্টেপাল্টে বুঝলাম এমন কিছু কঠিন নয়। মাইক্রো আর ম্যাক্রো ইকোনমিকসের পাশাপাশি ভারতীয় অর্থনীতি খুব দ্রুত শেষ করা গেল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই। কমবেশি সবটাই জানা। মোটামুটি বিগত বছর পাঁচেকের প্রশ্ন ঘেঁটে নিজের মতো সাজেশন তৈরি করে নোটস বানিয়ে ফেললাম। নিজের বই ছিল। লাইব্রেরি থেকে বই আর প্রশ্ন পেয়ে গেলাম। সীতাংশু কাকু (শ্রী সীতাংশু শেখর মুস্তাফি) সাহায্য করলেন। উনি নিজে কলেজের কর্মী। সেজকাকুর বন্ধু এবং দিনহাটা হাই স্কুলে খুব সম্ভবত বাবার ছাত্র ছিলেন। বাড়িও আমাদের বাড়ির পেছন দিকে গোধূলি বাজারে। নোটস তৈরি করায় একটা সুবিধে হল, আমার আর পাস সাবজেক্ট নিয়ে আলাদা করে কোনও টেনশন রইল না। আরও সুবিধে হল, রেণুপিসির মেজো ছেলে মধু আমার কাছে ইকোনোমিক্স বুঝতে শুরু করল। ও নিজে বি কম পড়ছে। কিন্তু পড়ে নিচ্ছে আমার কাছে। ওকে পড়ানোর ফলে নিজেরও পড়া হয়ে যাচ্ছে। ওর ছোট ভাই ভজন মাধ্যমিক দেবে। ওকে পড়াচ্ছি ইংরেজি।
কিন্তু মাধ্যমিকের ইংরেজি এক আর অনার্সের আর এক। তার জন্য দরকার বিশেষ প্রশিক্ষণ। গুটিগুটি পায়ে গেলাম অনিলকাকুর কাছে। বললেন, তাঁর বাড়িতে পড়তে যেতে। সপ্তাহে দুইদিন। কোচবিহার ইন্দিরা দেবী গার্লস স্কুলের পাশের রাস্তায় গৌরী মহলের পেছনে এক বাড়িতে উনি থাকেন। সেখানেই পড়াবেন। সকাল সাতটা থেকে।
দিনহাটা পাইওনিয়ার ক্লাবের কাছের বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ছয়টায় বাস ধরলাম। দুই টাকা ভাড়া। যাতায়াতে চার টাকা। হাত খরচ এক টাকা। সপ্তাহে দুই দিন মানে মাসে আট দিন। পাঁচ আটে চল্লিশ টাকা। বাবা হিসেবে করে বড় কাকিমার হাতে টাকা দিয়েছেন। প্রথম দিন যখন বাড়ি থেকে বেরোলাম, ঠাকুমা ছাড়া কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। ঠাকুমাকে রান্নাঘরে যেতে দেওয়া হয় না। একবার স্ট্রোকের পর ঠাকুমা একটু কেমন হয়েও গেছেন। সকালের চা বিস্কুট ছাড়া মিনি বাস ধরে চললাম কোচবিহার। নামলাম কাছারি বা কোর্ট মোড়ে। ইন্দিরা দেবী স্কুল পেরিয়ে বাঁ দিকে দেখি একটা চায়ের স্টল। চল্লিশ পয়সায় চা আর দশ পয়সার বিস্কুট খেয়ে কিছুটা শান্তি হল। দেখি রীনা ও অন্য এক সহপাঠিনী সাথীও গৌরী মহলের দিকে এগোচ্ছে। বুঝলাম ওরাও পড়তে এসেছে।
চারমিনারের দাম তখন নিতান্ত কম। দিনহাটায় এসে ধরে ফেলেছিলাম সেটা। কিছুতেই মাথা থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্টের ভাবনা যাচ্ছিল না। এমনিতেই খারাপ ছাত্রের দলে নাম লিখিয়েছি। তাই সিগারেট আর নতুন করে কী খারাপ করবে!
চা-বিস্কুট শেষে সিগারেটের শেষটুকু ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে কাকুর বাড়ির দিকে এগোলাম আমিও।
(ক্রমশ)
পর্ব-১
https://www.facebook.com/share/p/1EhQT8TFnh/
পর্ব-২
https://www.facebook.com/share/p/16jG4yr2hW/