রবি আড্ডায় রাজা

একটি ২৭ বছরের ছেলে লেখা পড়ে, যখন এমন সব মানুষেরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাদের লেখার বয়সই ছেলেটার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। তখন বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না এই ২৭ বছরের ছেলেটির মধ্যে নিশ্চয়ই বারুদ ঠাসা আছে। বলছিলাম অগ্রদীপের কথা, গল্পকার অগ্রদীপ দত্ত। ইতিমধ্যেই আমার শহরের সংস্কার মেনে যার পেছনে কাঠিবাজির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কোন হাউসে লিখবে না, কোন কোন জায়গা থেকে নাম বাতিল করাতে হবে, কী করে থামানো যায়,ইত্যাদি আড়াই প্যাঁচের খেলা। সে যাদের প্রথম থেকেই অস্তিত্ব টালমাটাল, তাদের সিন্ডিকেট-খচরামি চলতেই থাকুক। আমি জানি, অগ্রর মতো বলিষ্ঠ লেখককে থামানো যায় না।

আমার চোখে অগ্র অবশ্য এক ভিন্ন ধরনের প্রাণী। ওর ফোন আসা মানেই বুঝে নিতে হবে এখন কঠিন সব প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসবে। এবং নিজেকে যথাসম্ভব প্রস্তুত রাখা, যাতে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পারি। আমার কিন্তু সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লাগে অগ্রর পিঠে রাখা ব্যাগটা। এখন, এই মুহূর্তে যদি প্রলয় ঘটে যায়, তার থেকে বেঁচে যাবার সমস্ত ব্যবস্থা করা আছে ওর ব্যাগে। ওষুধের বাক্স, জলের বোতল, মাফলার, মাস্ক,কি নেই ওতে!

তবে অগ্রর অন্য একটা দিকের কথাও বলতেই হয়। যে অগ্র নিজের লেখার ব্যাপারে যতটা নির্মম, আমার লেখা নিয়েও তেমনি কঠোর। আমাকে অনেক ভালো বই পড়তে বাধ্য করে ও। আরও একটা বিষয় না বললেই নয়,গল্প লেখার ব্যাপারে অগ্র খানিকটা আমার গুরুর মতোই বটে। আমার শুধু একটাই অভিযোগ, গল্প লেখা নিয়ে ও যতটা সিরিয়াস, তার ১০ শতাংশ যদি কবিতা লেখা নিয়ে হতো আমরা পাঠকেরা নিশ্চিত এক দুর্দান্ত কবিকে পেয়ে যেতাম। কবি অগ্রদীপ দত্তের এখনো পর্যন্ত একটি মাত্র কবিতার বই “ঠিকানা বদল হওয়ার দিন”। বইটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল ছেলেটির ভেতর প্রচুর কবিতা আছে। আমার শহরের নিয়ম অনুসারে এই বইটি নিয়েও তেমন আলোচনা হয়নি। আমি বইটি নিয়ে আলোচনা করতে চাইনি তখন, কারণ ব্যাপারটা অনেকটা নিজের ভাইয়ের বই নিয়ে প্রচারের মতো শোনাতো। তবে অপেক্ষায় ছিলাম সিনিয়রদের কাছ থেকে নিশ্চয়ই কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে। বলা বাহুল্য, তেমন কিছুই হয়নি। অগত্যা আমাকেই কলম ধরতে হলো।
———————————————————————————–

কোনো কোনো বই হাতে নিলে মনে হয়, যেন আমরা অন্যের জীবনে প্রবেশ করছি না, বরং নিজেদের ভেতরে কোথাও ফিরে যাচ্ছি। অগ্রদীপ দত্তের “ঠিকানা বদল হওয়ার দিন” তেমনই এক কাব্যগ্রন্থ।যেখানে শোক, স্মৃতি, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, মৃত্যু, দেশভাগ, পরিবার আর প্রতিদিনের হারিয়ে ফেলা মুহূর্তগুলো একে একে এসে বসে গেছে।

প্রথমেই চোখে পড়ে উৎসর্গ-
“বাবার সাইকেলের বেল
মায়ের আঁচলের গন্ধমাখা
কোনো একটি বিকেল।”
মাত্র কয়েকটি লাইনে কবি স্পষ্ট করে দেয় তাঁর ভুবনের মাটি কোথায়।
পরিবার, শৈশব আর হারানো ঘরবাড়ির গন্ধ।

বইটির প্রথম দিকের কবিতাগুলোতেই চোখে পড়ে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা। “প্রতিবিম্ব” কবিতায় কবি ভাঙা আয়নায় খুঁজে পায় না-পাওয়া জিনিসের দলিল,মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট, প্রেমিকার ফিরিয়ে দেওয়া লকেট, ব্ল্যাকে কাটা সিনেমার টিকিট। এবং কবিতায় উঠে আসে সেই অমোঘ লাইন-
“বাবা নিজেকে আয়নায় দেখার সময় কখনও লক্ষই করে না
শরীরে ফাটল ধরে গেছে।”
এখানেই ধরা পড়ে ব্যক্তিগত ক্ষত, আর সেই ক্ষতের ভেতর পরিবারের প্রতিচ্ছবি।

“মালতী মাসি” কবিতায় কবি দেখায়, কীভাবে এক সাধারণ নারী প্রতিদিন মাতাল স্বামীর পাশে থেকে বমি কাচেন, ঝাঁটা ধোন, আবার পরদিন সব শুরু করে দেন। ছোট থেকে শোনা সেই ধারণা,’ক্ষমা এক শিল্প’,এই কবিতায় প্রাণ পায়। ক্ষমা মানে দয়া নয়, বরং যন্ত্রণার মধ্যেও আলো টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা।

এই বইয়ের অন্যতম শক্তিশালী কবিতা “মৃত্যু সম্পর্কে”। এখানে কবি আলোর মঞ্চ, পুরস্কার, সম্মান—সবকিছুর বাইরে গিয়ে ঘোষণা করে-
“আমি শুধু চমৎকার একটা মৃত্যু চেয়েছি বরাবর।”
কতটা সাহস আর নির্লিপ্তি থাকলে মৃত্যু নিয়ে এমন নান্দনিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা যায়! এখানে মৃত্যু হতাশা নয়, বরং জীবনের শুদ্ধতম সমাপ্তি।

বইয়ের নামের সঙ্গে মিশে থাকা “ঠিকানা” ধারাবাহিক চারটি কবিতা, দারুণ।

ঠিকানা ১-এ শূন্য উঠোন, তুলসীপাতার ফাঁকে নিভে যাওয়া প্রদীপ, মায়ের না-থাকা।

ঠিকানা ২-তে সংসার বদল, পুরনো ফুল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।

ঠিকানা ৩-এ টিপ খুঁটে নেওয়ার অভ্যেস আর বাবার সেই চূড়ান্ত বাক্য—“তোর মাকে রেখে গেলাম।”

ঠিকানা ৪-এ বন্ধুদের কাছে নিজের ডাকনাম ফেলে আসা।

এই কবিতাগুলো শুধু ঘর ছাড়ার গল্প নয়, বরং ভেতরের ভাঙনের দলিল।

“কাঁটাতার” কবিতায় দেশভাগকে কবি দেখে ঠাকুমার চোখ দিয়ে-
“আমি দেশভাগ দেখিনি,
স্মৃতির ছাই হাতে নিয়ে ঠাকুমাকে রোজ
ঘর-বাড়ি-সংসার
ডিঙিয়ে
পেরিয়ে যেতে দেখেছি নো-ম্যানসল্যান্ড।”
এই লাইনগুলো পড়লে মনে হয় দেশভাগ কোনো অতীত ঘটনা নয়, বরং আজও আমাদের ভেতরে বয়ে চলা ক্ষত।

প্রেম আর মৃত্যুর দ্বন্দ্ব ছুটে ওঠে “সুইসাইড পয়েন্ট” ও “অভ্যেস” কবিতাগুলিতে।

“সুইসাইড পয়েন্ট” কবিতায় মৃত্যুর টান আর জীবনের দিকে টেনে নেওয়া প্রেম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যায়। পাহাড়, সূর্যাস্ত, হাত ধরে থাকা,এসব দৃশ্যে কবি দেখায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা।
আর “অভ্যেস” কবিতায় এক চমৎকার স্বীকারোক্তি-“
তোমার কথা ভুলে যাব ভাবতে গিয়েই
তোমার কথা সবচেয়ে বেশিবার ভাবতে হয়।”
প্রেম এখানে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা নয়, বরং প্রতিবারই ফিরে আসা।

সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখতে পাই “অমৃতা”, “কোলাজ”, এবং “যার আকাশে বৃষ্টি” কবিতায়।

এই কবিতাগুলোতে দেখা যায় অচিন সম্পর্ক, হারানো ভালোবাসা, আর সমাজের অদৃশ্য ব্যথা। বিশেষ করে “যার আকাশে বৃষ্টি” কবিতায় ফুটব্রিজে দাঁড়ানো পাগল আর দূরে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখা মেয়েটির মিলিত ছবি,অসাধারণ।

বইয়ের পরের দিকের ছোট ছোট কবিতাগুলো একেকটা ছুরি।
যেমন “স্বজন” কবিতায়-
“কাচের কাপে চা খেতে গিয়ে খেয়াল হল
আরও কত রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, কৃষকের ঠোঁট ছুঁয়েছে এই কাপ।”
অথবা “বন্ধু-বান্ধব” কবিতায়-
“বয়স বাড়লে বোঝা যায়
‘কাছের মানুষ’ শব্দবন্ধটি
ইল্যুশনের প্রতিশব্দ।”
এই ছোট্ট কবিতাগুলো বইয়ের একেবারে আলাদা স্বাদ তৈরি করে।

শেষদিকে বই যেন আরও ব্যক্তিগত, গভীর হয়ে ওঠে। “মা-কে লেখা চিঠি ৩” কবিতায় কবি বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজের ভেতর মায়ের মুখ দেখে। আর শেষ লাইন-
“আসছে বছর মা আবার আসে ঠিকই
আসছে বছর শুধু তুমি আসো না।”
একেবারে বুক কেটে যাওয়ার মতো সরল অথচ গভীর সত্য।

অগ্রদীপ দত্তর “ঠিকানা বদল হওয়ার দিন” শুধু কবিতা-সংকলন নয়, বরং এক ব্যক্তিগত দিনলিপি, যা পড়তে পড়তে আমাদের নিজেদের দিনলিপি মনে হয়। শোক, প্রেম, দেশভাগ, পরিবার, ঘরবাড়ি, মৃত্যু,সব মিলিয়ে এই বই আমাদের সামনে খুলে দেয় জীবনের এক সম্পূর্ণ কোলাজ।

সবচেয়ে বড় কথা, ভাষা একেবারে সহজ। কোনো কৃত্রিম জটিলতা নেই, আবার নিছক সরলতাও নয়। প্রতিটি কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, কেউ আমাদের খুব চেনা গল্পটা একেবারে নতুন করে বলছে।

“ঠিকানা বদল হওয়ার দিন” পড়লে মনে হয়, আমরা প্রত্যেকে আসলে কোনো না কোনো ঠিকানা বদলের দিন বয়ে বেড়াচ্ছি, শুধু লিখে উঠতে পারি না। অগ্রদীপ সেই না-পারা কথাগুলো আমাদের হয়ে লিখে দিয়েছে।

অগ্রকে নিয়ে আর কোনোদিন এভাবে  হয়ত লিখব না।আমি শুধু বড় দাদা হিসেবে ওর লেখক জীবনীর নীরব সাক্ষী হয়ে থেকে যেতে চাই। কিন্তু আজ যখন এত কথা বলছি তখন ওর কবিতা নিয়ে আরও একটা বিষয় জানিয়ে যেতে চাই। অগ্র আসলে জানেই না ,ওর জীবনের অন্যতম সেরা কবিতা ও লিখে ফেলেছে ওর গল্পের বইটির(মাত্র কিছুক্ষণ)উৎসর্গতে। বন্ধুদের জন্য সেই লেখাটিও রাখলাম –

“উৎসর্গ

প্রথম যেদিন দেশ পত্রিকার চিঠি এল বাড়িতে, পোস্টম্যানের হাত থেকে চিঠিটা নিয়েছিল বাবা। হেমন্তর এক দুপুরে আমি নিজের ডেস্কে বসে প্র্যাক্টিকাল খাতায় কিছু একটা লিখছিলাম। বাবা এসে বলল, ‘তোর একটা চিঠি এসেছে। দেশ থেকে।’

শুনেই বুক কাঁপল। দেশ? চিঠি পাঠিয়েছে? কেন? তাহলে কি কোনো লেখা মনোনীত হয়েছে?

বাবার দিকে পেছন না ফিরেই বললাম, ‘খুলে দেখো।’

বাবা খুলল। কিছুক্ষণ পর একেবারেই নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘ফেরিওয়ালা” বলে কোনো গল্প পাঠিয়েছিলি? ওটাই ছাপবে লিখেছে।’ এই বলে, চিঠি আমার টেবিলের উপর রেখে বাবা চলে গেল।

আমি একই সাথে আনন্দিত ও দুঃখিত হলাম। আনন্দিত হলাম এইভেবে-দেশে গল্প লেখা আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। পত্রিকার পাতায় অন্য লেখকের নাম হাত দিয়ে ঢেকে নিজের নাম কল্পনায় দেখেছি কতবার। কিন্তু এই আনন্দ মুহূর্তে বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই? খারাপ লাগল খুব।

যাই হোক, কিছু বন্ধুকে খবরটা দিলাম। কিন্তু বাবার সাথে এই নিয়ে আর কোনো আলোচনা করলাম না। তারপর সেই দিন এল। যেদিন গল্পটা পত্রিকার পাতায় বের হল। তুমুল উৎসাহে পত্রিকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনই রাস্তায় এক চালের দোকানের মালিক আমায় হঠাৎই বলল, ‘কী মিষ্টি কবে খাওয়াচ্ছো?’

আমি একটু অবাকই হলাম। ভদ্রলোকের থেকে আমরা চাল নিই। তাই পরিচয় আছে। কিন্তু মিষ্টির প্রসঙ্গ কোথা থেকে এল না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিষ্টি? কেন?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার লেখা একটা বড় ম্যাগাজিনে ছাপবে শুনলাম। তুমি তো আমাদের হায়দার পাড়ার নাম উজ্জ্বল করে দিলে।’

অবাক ভাবটা তখনও কাটেনি আমার, ‘কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘কীভাবে জানলাম? ভদ্রলোক হাসলেন। তোমার বাবা একটা চিঠি এনে দেখিয়েছে সবাইকে। এখানকার মোটামুটি সবাই জেনে গেছে যে, তোমার লেখা বের হবে। যাইহোক অনেক ভালোবাসা রইল। অনেক বড় লেখক হও।’

এক অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে আচ্ছন্নের মতো বাড়ি ফিরলাম আমি। দেখলাম, বাবা ঘরে বসে পেপার পড়ছে। আমি মৃদুস্বরে বললাম, ‘এই যে পত্রিকা। লেখাটা আজ বেরিয়েছে।’

বাবা পেপারের ওপাশ থেকেই উত্তর দিল, ‘রেখে যা।’

আমি আর কোনো কথা বললাম না। নিজের ঘরে এসে ড্রয়ার খুলে দেখলাম, চিঠিটা আবার ঠিক জায়গায় চলে এসেছে।

বহুবার খোলা আর ভাঁজ করায় কোণের একটা অংশ খানিক ছিঁড়ে গেছে শুধু।”

Agradeep Dutta “মাত্র কিছুক্ষণ” প্রকাশ অনুষ্ঠানে বই  মেলার ভিড়ের মাঝে একটু আড়ালে দাড়িয়ে তোর বাবাকে দেখেছিলাম চোখ মুছে নিতে। আমৃত্যু সেই কবিতাটি আমার সঙ্গে থাকবে।

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *