
রবি আড্ডায় অনির্বাণ ঘোষ
আজ সোমবার। হাল্কা লিকার। দারুণ ফ্লেভার। চিনি একটু বেশি। বিকেলে ভ্যারি করে। কখনো দুধ চা। কখনোবা দুধ ছাড়া। রাতে আবার হাল্কা লিকার। এট্টু ফ্লেভার। দুধ ও চিনি দুইই মাপা। পরিমিত। মঙ্গলবার সকালে সিটিসি। ঘন দুধ ও বেশি চিনি দিয়ে। বিকেলে দুধ দিয়ে লোপচু। বুধ সকাল লিকার চা দার্জিলিং। বিকেলে কফি – দুধ দিয়ে। বৃহস্পতিবার সকাল – ঐ সোম সকাল। শুক্র বিকেল – same as সোম রাত। শনি বিকেল – ঐ বুধ বিকেল।শনি রাত – ঐ বুধ রাত। বৃহস্পতি বিকেল ও শুক্র, শনি, রবি সকাল ফাঁকা। এই হল অবনীর সাপ্তাহিক চা-চরিত।
অবনী দেখেছে চা-এর গুণমান চা-পাতার চেয়ে বেশি নির্ভর করে গৃহকর্ত্রীর সেই মুহূর্তের মেজাজ ও হাতের সময়ের ওপর। সেই মেজাজের নিয়ন্ত্রক অবনীর performance। আবার অবনীর performance –এর মাপকাঠি তার স্টুডেন্টের পারঙ্গমতা। এবং তার মাপকাঠি অবধারিতভাবে মার্কস। কারণ এই মার্কস –এর জন্যই তো ছাত্রের পেছনে মাস্টার রাখা ও মাস্টারের পেছনে পয়সা ঢালা ।
সে দার্জিলিং হোক আর সিটিসি, দুধযুক্ত বা বিমুক্ত, চিনি বেশি বা কম, ঘোড়ার মুত বা গরম জল – অবনীর বাছ বিচার নেই। সেই ঐ এক পেয়ালার তাত – তাতে মৌতাত থাক বা না থাক। গলায় ঢেলে নেয়। গলার খুসখুসভাব কমে। জিভের জড়তা যায়। তাছাড়া এটা তার উপরি। বাড়িতে জন খাটালে যেমন পয়সার সাথে খোরাকি দিতে হয়, তেমনি বাড়িতে মাস্টার এলে চা। তাই তার গুণমান নিয়ে খুঁতখুঁত করে লাভ নেই। যে বাড়ির যেমন, সেই বাড়ির তেমন। শুধু কোনো বাড়ির চা তার নির্ধারিত গুণমান হারালেই তা চিন্তার বিষয়। কারণ কি? গৃহকর্ত্রীর সময়াভাব নাকি মেজাজ ঠিক নেই? কারণ তাঁর মেজাজের সাথে রিলেটেড অবনীর তথা তার স্টুডেন্টের পারফরম্যান্স।
ছাত্রের গুণগত মান নিয়ে কোন অভিযোগ নেই অবনীর। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে সে জানে। শুধু সমস্যা সেইসব গাধাদের নিয়ে যাদের বাবারা তাঁদের গাধাদের গাধা মনে করেন না ।
- ছেলে আমার দারুণ ব্রেইনি স্যার, কিন্ত একদম পড়ে না। শুধু যদি একটু পড়ত!
অবনী মনশ্চক্ষে দেখতে পায় টিভির পর্দায় একটা গাধা পয়া প্রকাশনীর “প্রশ্নোত্তরে মাধ্যমিক জ্যাকপট” বইটি হাতে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলছে – আমিও পড়েছি, তোমরাও পড়।
এ শহরে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে তেমন পরিচিতি নেই অবনীর। পড়ানো শুরু করেছিল তার কলীগের ছেলেকে। ঠিক পড়ানো নয়। সাবজেক্ট টীচার আছেই। সপ্তাহে একদিন একটু ল্যাঙ্গুয়েজটা দেখাতে হবে। যাতে রাইট-আপটা বেটার হয়। তারপর যা হয়। ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে লিটারেচার। একদিন থেকে দু’দিন। ছাত্র ভালো। ফলও এক্সেপশনালি ভালো। তাতে অবনীর নীটফল শূণ্য। ভদ্রলোক অবনীর নাম কাউকে বলতেন না। ফলতঃ অমুক স্যারের ব্যাচে চটির সংখ্যা আরও বাড়ল। পরে ভালো স্টুডেন্ট যে পায়নি তা নয়। কিন্তু সেসব খুচরো কেস। এবং ভালো স্টুডেন্টদের পেছনে পার সাবজেক্ট দুটো টীচার। একজন সুপরিচিত। আর একজন অবনী। স্টেপনি অবনী।
- স্যার খুব চাপ। এতগুলো টিউশান। ওরা দুই ভাইবোন পড়বে। দু’জনে দেড় দেবো।
তাই-ই সই। পরে অবনী জেনেছিল যে চাপে থাকা বাপ নেসলে-র ডিস্ট্রিবিউটর। বোর্ডের পরীক্ষার আগ দিয়ে বাবার আগমন –ওদেরকে অমুক স্যারের কাছে দিয়েই দিলাম স্যার। ইন্টারনাল মার্কসের ব্যাপার। আপনিও পড়ান। অবনী পড়াতে থাকে। বোর্ডের পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য দুই ভাইবোনের। প্রচার অমুক স্যারের। ক্লাস ইলেভেনে পড়ানোর ডাক পায়না অবনী। পাঁকে না পড়লে স্টেপনির প্রয়োজন নেই।
তবে স্টুডেন্টরা অবনীকে ভালোইবাসে। ছাত্রের সাথে ওয়েভ লেন্থ মিলবে কিনা ফার্স্ট সিটিং-এই বুঝে যায় অবনী। একবার কি কারণে খুব টায়ার্ড ছিল। কম্পজিশান বা কিছু একটা লিখতে দিয়ে নাক ডাকাচ্ছিল অবনী। খুব বিরক্ত হয়ে ওর ছাত্র ঘরের দরজা আবজে দেয়। পাছে বাবা-মা দেখে ফেলে।
***
অবনী অবাক বিস্ময়ে হতবাক – এটা তোমাকে কে লিখে দিলো?
- কেউ না স্যার।
- কিন্তু এত সুন্দর তুমি লিখলে কি করে?
- বাবা বলে দিয়েছে।
বাবাই তো তাহলে পড়াতে পারে!
এখানে বলে রাখা দরকার যে বাবা চিটেগুড়ের হোলসেলার।রহস্য উদ্ঘাটন হল যখন সোহম বলল – স্যার, শ্রেয়সের তো এক এক সাবজেক্টের তিনজন করে টীচার।
- ম্যানেজ করে কি করে?
- একসাথে দু’জন টীচারের পড়া পড়লে ওর মা ঠিক করে দেয় কোনটাতে যাবে।
বোঝো !
অবনী বোঝে। বেশী বুঝে কাজ নেই। দিনগত পাপক্ষয় করে চলো। মাস পুরোলে যেটা পাচ্ছো, সেটাই প্রাপ্তি। তবুও মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। এই তো সেদিন। অবনী বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে বাঁ –এ টার্ন না নিয়ে পুরনো অভ্যাসে ঢুকে গিয়েছিল কমল টকীজ- এর পেছনের গলিতে। সত্যজিতের বাড়ির দিকে।
সত্যজিত। মানেই বত্রিশ পাটি হো হো হাসি। সত্যজিত। ফুলে যাওয়া কালশিটে পড়া নিথর দেহ। ভিজে শরীরে লতপত্ জবজবে প্যান্ট। দুইদিন কুলিকে ডুব দিয়েছিলো যে। কোন অভিমানে, কে জানে! ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি অবনী। যেদিন থেকে ও বেপাত্তা ছিল, সেদিন অবনীর পড়ানোর ডেট্ ।পরে দেখেছিল। নদীর ঢালে আটকে যাওয়া টাটা ‘ছোটা হাতি’- র শীতল ধাতব শীটের থেকে কিছু উষ্ণতা পাবার জন্য ওর সিক্ত শরীর কী প্রত্যাশী! এরপরেও দু’বার অবনী ওকে দেখেছে। একবার লাশকাটা ঘরে। একবার চিতার আগুনে। ঊনিশে এপ্রিল – অবনীর কাছে ঋতুপর্ণর ছবি নয়। সত্যজিতের জন্মদিন। ফি বছরই যায়। সাদা ফুল নিয়ে। সত্যজিতের মায়ের হাতের গোলাপজামুন খেয়ে আসে। ও ভালোবাসতো।
***
অবনীর মজা লাগে গোড়া শক্ত করার কেসগুলোতে। দু’জোড়া worried চোখ অবনীর দিকে তাকিয়ে। ভদ্রলোকের পুরুলেন্সের উপনেত্র ধরলে সংখ্যায় পাঁচ। অবনী বিব্রতবোধ করে। ভদ্রলোক স্থানীয় কলেজের এডুকেশানের অধ্যাপক। স্ত্রীও ঐ কলেজেই। কোন সাবজেক্ট? জানেনা অবনী। রিকোয়েস্ট সামান্যই – পুপুর গোড়া শক্ত করতে হবে।
অবনী জাপানী তেল নাকি!
পুপু তাদের একমাত্র ছেলে। তার ইংরিজির গোড়া শক্ত করতে হবে।
ও !
পুপু ক্লাস ফোরের ছাত্র। অবনী অসহায় বোধ করে। নিজেকে মাংকি ব্র্যান্ডের দন্তমাঞ্জনের ল্যাজগোটানো বাঁদরের মতো মনে হয়। ( ছোটবেলায় ঐ দিয়ে দাঁত মাজতো বাবা ও অবনীরা দুইভাই।) বাঁদর থেকেই মানুষে উত্তরণ।
- একদিন একটু দেখালেই হবে।
অবনী মানুষ হয়।
- শুধু গ্রামারটা একটু। আর একটু রাইট-আপটা।
- আপনার যখন সুবিধে আসবেন।
একটু ভেবে নিয়ে জানাবো বলে ফোন নাম্বারটা নিয়ে পাশ কাটায় অবনী।
মোহরের রেফারেন্স। অবনীর কলেজ লাইফের বন্ধু। ভদ্রলোক ওরই কলীগ। চেহারায় মেদ জমেছে। চশমার পাওয়ার বেড়েছে। হাত ঘুরিয়ে কব্জির মোচড়ে post-modernism বোঝায় একালের দেব-কোয়েলদের। তবুও ফিচলেমি গেল না।
- এই পুপুকে তুই পাঠিয়েছিস?
- হ্যাঁ, বিষমদার ছেলে।
- ক্লাস ফোর !!!
- খুব করে ধরল। পুপুর গোড়া শক্ত করতে হবে। তাই তোর কাছে পাঠালাম।
- আমার ছোট মেয়েটার বয়স দেড় বছর।
- তো?
- তোকে বুক করে রাখলাম। প্রেপ্ থেকে K.G. I- এ উঠলে তোর কাছে পাঠাব।
শেক্সপীয়ার পড়িয়ে দিস।
মুঠোফোনে ভেসে আবার বছর কুড়ি আগের আদি ও অকৄত্রিম হাসি – খিক, খিক, খিক!
বছর দুয়েক আগে এসেছিল অবনীর কলেজ লাইফের এক সিনিয়র। ছেলেকে ল্যাঙ্গুয়েজটা দেখাতে হবে। ছেলে ফার্স্ট হয়। ক্লাস ফাইভ।
- তোমার কাছেই পড়াবো একদম বোর্ড অব্দি। অমুক স্যারের ব্যাচে খুব ভীড়। তমুক স্যার ল্যাঙ্গুয়েজ একেবারেই দেখায় না। ক্লাস সেভেনে উঠলে ব্যাচ করে দেবো। তোমারও সুবিধে হবে। এখন ওকে শুধু সপ্তাহে একদিন দেখিয়ে দাও।
অবনী ছাত্রের দিকে তাকায় – গোলগাল, গুটগুটে এক পুঁচকে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
শুরু হয় রবিবাসরীয় পাঠ। সিলেবাসের সাথে চলে বিভূতিভূষণ – অপু-দুর্গা, রাস্কিন বন্ড – রাস্টি, উইম্পি কিড, আরও কত কি। দু’বছর অতিক্রান্ত। ক্লাস সেভেন। আবার বুলাওয়া।
কিন্তু কোথায় ব্যাচ? সেই একা। সেই সপ্তাহে একদিন। সেই ল্যাঙ্গুয়েজ ওনলি।
আ-বা-র স্টেপনি।
অবনীর মন মনিটরে বোল্ড ফন্টে ভেসে ওঠে — না !