
রবি আড্ডায় কৌন্তেয় নাগ
অন্তিম পর্ব
ভিয়েতনামে গেরিলা যুদ্ধ, কু – চি টানেল দ্বিতীয় ভাগ

সারাদিন বসে লিখলাম,কারণ প্লেন ৩ ঘন্টা দেরিতে ছেড়ে কম্বোডিয়া পৌঁছাতে সন্ধ্যা করে দিলো।
দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ এই পর্ব শেষ করে এখন হোটেলের ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কে পোস্ট করি।
ভিয়েতনামীদের পাতালে সুরঙ্গ তৈরি
আমেরিকানরা প্রথম দিকে বিমানের মাধ্যমে আকাশ থেকে প্রচুর বোমা বর্ষণ করলেও গেরিলাদের নির্মূল করা যাচ্ছিল না। আকাশ থেকে ঘন জঙ্গলের ভেতরটা দেখা যেত না। ফলে ভিয়েতনামী গেরিলারা সহজেই বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারতো।

যেহেতু বনের গাছ,জঙ্গল গেরিলাদের লুকাতে সাহায্য করছিল এবং বনের উপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে গেলেই সেটির উপর বনের ভেতর থেকে গেরিলারা আক্রমণ করে অনেক আমেরিকান বিমান, হেলিকপ্টার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল।
তাই আমেরিকানরা ঘন বন জঙ্গল পরিষ্কার করতে মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ
“এজেন্ট অরেঞ্জ” এবং “এজেন্ট ব্লু” ব্যবহার করে(এই পদার্থগুলো ব্যবহারে গাছের পাতা ঝড়ে যেত প্রচুর মানুষ পঙ্গু হয়েছে পরবর্তীতে,পরে লিখবো সেই নিয়ে)। এতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ১০লক্ষ হেক্টর বনভূমি নষ্ট হয়ে যায় এবং জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে যাবার ফলে আমেরিকার আকাশ পথে আক্রমণের পথ সুগম হয়।

দক্ষিণ ভিয়েতনামী গেরিলারা যখন আর ঘন বন জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারছিলো না। তখন তারা যে অভিনব কৌশল অবলম্বন করলো সেটাই টানেল, মাটির নিচে সুরঙ্গ খুড়ে সেখানে লুকিয়ে পড়ল।
মাটির নিচে তারা বিভিন্ন ক্যাম্প, বিশ্রামাগার, অস্ত্রের গুদাম স্থাপন করল যা বিস্ময়কর । এইসব সুরঙ্গ অনেক নিচ অব্দি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রায় ৩০ ফিটের মত গভীরে।

ফলে আমেরিকানদের ভিয়েতনামের গেরিলারা আক্রমণ করেই সুরঙ্গে লুকিয়ে যেত এবং অন্য পথ দিয়ে বের হয়ে আমেরিকানদের পেছন থেকে হামলা করতো।
গেরিলাদের বিমান থেকে বোমা মেরে নির্মূল করা যাচ্ছিল না। আবার তাদের যুদ্ধের ময়দানেও হারানো অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ কৌশলের কাছে আমেরিকান সেনারা বার বার মার খাচ্ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল সহায়তাঃ
এভাবে যুদ্ধ লড়তে লড়তে আমেরিকারা এক পর্যায়ে উত্তর ভিয়েতনামে বিমান হামলা করা শুরু দেয়।
সেই সময় আমেরিকার অনেক বিমান উত্তর ভিয়েতনামে তাদের মিসাইল ব্যবহার করে আকাশ থেকে ফেলে দিতে শুরু করল।

যে মিসাইল টি উত্তর ভিয়েতনাম সেনাবাহিনী ব্যবহার করতো সেটি ছিল সোভিয়েত নির্মিত S-75 dwina missile.[এছাড়া আরো বেশ কিছু সামরিক প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক জ্যামরও সরবরাহ করেছিল রাশিয়া]
ফলে আমেরিকানরা তার অত্যাধুনিক বিমান দিয়েও কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে পারে নি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে অপারেশন শেষে আমেরিকা F-105 বিমানগুলোর অর্ধেক, Douglas A-1,Douglas A-4,Grumman A-6 Intruder প্রায় ১/৩ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
🇻🇳 গুপ্ত বাঙ্কার নির্মাণ
ভিয়েতনামীরা সুরুঙ্গের মাথায় খুবই নিচু একধরনের বাঙ্কার নির্মাণ করেছিল। যেগুলোর ফাঁকা অংশটি এতই নিচু ও সরু ছিল যে কেবল দুই চোখ ও বন্দুকের নলটা বাঙ্কারের বাইরে বের করা যেত। বাইরে থেকে বাঙ্কারের কাছে এসেও এটি সাধারণ চোখে কোন সাপের বাসার মত দেখতে মনে হত। চোরা গুপ্তা হামলার জন্য এটি ছিল একটি মোক্ষম অভিনব উপায়। আমেরিকান সৈন্যদের খুব কাছ থেকে গুলি করলেও আমেরিকান সৈন্যরা বুজে উঠতে পারতো না যে কোথা থেকে গুলি করা হয়েছে। আমেরিকান সৈন্যরা এর আশপাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও অনেক সময় ধরতে পারতো না। যে এই ছোট গর্তটি আসলে একটি ব্যাঙ্কারের মত ব্যবহার করছে ভিয়েতনামের গেরিলারা।

গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে উত্তর ভিয়েতনামের যোদ্ধারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে এসে গেরিলাদের সাথে মিলে অপারেশন করতো।
এসময় তারা মূলত গ্রামবাসী সেজে থাকতো।
আমেরিকানরা দক্ষিণ ভিয়েতনামীদের থেকে উত্তর ভিয়েতনামীদের আলাদা করতে পারতো না। কে নিরীহ গ্রামবাসী আর কে গেরিলা যুদ্ধা সেটা বুঝা যেত না।
এসময় গেরিলারা গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে তাদের দলের জন্য সদস্য রিক্রুট করতো। কমিউনিজম চিন্তাধারা প্রচার করতো গ্রামবাসীদের মধ্যে।
আমেরিকানদের নাকের ডগা দিয়ে তথ্য পাচার করতো।
শহরের বিভিন্ন আমেরিকান সেনা জেনারেলদের উপর হামলা চালাতো অতর্কিত ভাবে।

এমনই একবার ১৯৭০ সালে আমেরিকান বিমানবাহিনীর প্রথম লেঃ এল হিউজকে উত্তর ভিয়েতনামীরা আটক করে অপমান করতে করতে রাস্তা দিয়ে হাটিয়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে।
আমেরিকান অস্ত্রের রিসাইকেলিং করে আবার ব্যবহার করা। দাঁতে দাঁত চেপে আমেরিকানদের সাথে যুদ্ধ করেছে। আমেরিকান সৈন্যদের মত আধুনিক অস্ত্র তাদের ছিল না।
অত্যাধুনিক কামান,গোলাবারুদ ছিল উত্তর ভিয়েতনামী কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর কাছে কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধ করা গেরিলাদের কাছে এসব পৌঁছানো সহজ ছিল না। গেরিলারারা নিজেদের অস্ত্র সংকট মোকাবেলা করেছে চতুরতার সাথে।

তারা আমেরিকান কামান বা বিমানের গোলা, বিধস্ত হেলিকপ্টার এর ক্লাস্টার ব্যবহার করে ছোট ছোট গ্রেনেডে রিসাইলিং করতো।
ফলে এই যুদ্ধে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির সেনা ও গেরিলাদের যুদ্ধের অর্থসংকট প্রভাব ফেলতে পারে নি। ভিয়েতনামীরা আমেরিকান বিভিন্ন অস্ত্রের বিভিন্ন টুকরো নিয়ে বাজারে বিক্রি করে নিজেদের সদস্যদের খাবার কিনতো।
বিভিন্ন আমেরিকানদের বিমান থেকে ফেলা বিভিন্ন বিস্ফোরক অস্ত্রের repair করে সেই অস্ত্রই আমেরিকানদের উপর ব্যবহার করতো।
আমেরিকা এই যুদ্ধে প্রায় ৪০ লক্ষ বোমা আকাশ থেকে ফেলেছিল।
আমেরিকার কামানের গোলা থেকে পাউডার বের করে ভিয়েতনামী যোদ্ধারা। সেগুলো দিয়ে গ্রেনেড তৈরী করে।
সুচতুরতা, রণকৌশল আর অদম্যসাহস ভিয়েতনামীদের বিশ্বের পুজিবাদী শক্তির মাথা,সামরিক প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠ আমেরিকানদের মাথা নত করতে বাধ্য করে।
আমেরিকার সেনারা এই যুদ্ধে প্রায় ৩ লক্ষের কাছাকাছি আহত হয়েছিল। আজও সেই কষ্টের স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। ২০০ বিলিয়নের কাছাকাছি অর্থ,
৪০ লাখের কাছাকাছি বোমা,
“নাপাম” রাসায়নিক গ্যাস, (পরিবেশের ভয়ংকর ক্ষতি আজও অব্যাহত)
৭০০-৮০০ বিমান নিয়েও লজ্জাজনক হার দিয়ে ভিয়েতনাম ছাড়ে আমেরিকান সেনারা।
এই হচ্ছে আমার কু চি টানেল দেখার পরের অভিজ্ঞতা।
(তথ্য সংগ্রহ ভিয়েতনাম ওয়ার মিউজিয়াম থেকে,ভিডিও দেখিয়েছে দীর্ঘক্ষণ)
