রবি আড্ডায় অমৃতা সরকার

চায়ের রঙ কেমন? বাদামি গেরুয়ার মাঝামাঝি। চায়ের স্বাদ? হাল্কা তিতকুটে ,মূলত মিষ্টি ,ঢোঁক গেলার পর জিভে দুধের  ভোঁতা স্বাদ লেগে থাকবে যা খানিক বাদে একটু টকের আভাস দিতে পারে ঠিকঠাক হজম করতে না পারলে আর পারলে কোনো কথা নেই। চা খাওয়ার বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা কী? অবশ্যই মাধ্যমিক পাশ করতে হবে ,বয়স হতে হবে ষোলো। এহেন টি কালচারে মানুষ (?)হওয়া  আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে এক দুবার লুকিয়ে চা খেয়েছি মূলত বাড়িতে আসা অতিথিদের উদবৃত্ত এঁটো চা।কারণ ফরবিডেন যা তা তো চাখতেই হবে ,বেসিক হিউম্যান ইন্সটিঙ্কট।তবে ছোটোবেলাটা চা বিহনে কাটলেও চা বাগান বাদে জীবন ছিল না। আমার মা ওদলাবাড়ি মানাবাড়ি চাবাগানের গা লাগোয়া উদবাস্তু কলোনির মেয়ে বলে  আমার  ময়মনসিঙা  নমু ঠাকুমার ঠেস খুব শুনতে হত। চলনে বলনে মনমতো না হলে,কোনোদিন ক্যটক্যাটে কমলা শাড়ি পরলে বাড়ির লোকেদের প্রায়ই বলতে শুনেছি মানাবাড়ি চাবাগান রুচি! এখন এসব মনে পড়লে মনে মনে হাসি খুব।’রাবীন্দ্রিক রুচি’র শতশত মাইল দূরে থাকা নিম্নবিত্ত আমার বাপের গুষ্টি কীসের উপর ভিত্তি করে যে রুচির গর্ব করতো কে জানে! হয়তো এখান থেকেই ভালো করে ডাবলি মারজিনালাইজড,  ট্রিপলি মারজিনালাইজড ব্যাপারগুলো বোঝা সোজা হয়ে যায় আমার কাছে। যাক গে, যা বলছিলাম, চা বাগানের কাছে দাদুর বাড়ি হওয়ায় বাগান,বাগানের কামিন,বিকেলে  স্প্রিংক্লারের জলে চা গাছের চান,বাগানের মাঝে ছোট্ট একফালি জায়গায় বাগানের হাট ,হাড়িয়া খেতে লাইন ধরে বসে থাকা বাগানের মজুর,  ঝুলে থাকা চামড়াহীন গোলাপি শূয়োর এই সবের সাথে পরিচয় থাকলেও ‘আসল’ চা যে আসলে কেমন সেইটা বুঝতে বুঝতে মাস্টারস শেষ হয়ে গেল। প্রথম দার্জিলিং চা অর্থাৎ কিনা আক্ষরিক অর্থেই দামী পাতা চায়ের টেস্ট কেমন তা শেখালো আমার শিক্ষকসম এক মানুষ ।জীবনে বহুকিছু ওর কাছ থেকে শিখেছি, তবে চা যেন তার মধ্যে অনন্য!কেমন করে বুড়বুড়িকাটা জলে আলতো করে ভেজাতে হয় পাতা ,মিনিট কয়েক পর কাপে উনি এলে, প্রথমে নাক সজাগ করতে হয় তারপর চোখ তারপর জিভ সবশেষে আলজিভে লেগে থাকা স্বাদও কেমনে উপভোগ করতে হয় সব শেখা হল। দার্জিলিং-এ পড়ানো বন্ধুর কাছ থেকে জানলাম চায়ের প্রথম ও শেষ স্পর্শের মধ্যে পার্থক্য হতে হয় গরমে পুড়ে যাওয়া জিভ আর ঠান্ডায় জুড়িয়ে জিভের দূরত্বসম। বন্ধুটি প্রেম করতে করতে শিখছিল চায়ের খুঁটিনাটি একদম ইনসাইডার চা-কালচারের মানুষের কাছ থেকে। তার কাছ থেকেই জেনেছি সারারাত ধিম আঁচে ফুটে ভোররাতের পানীয় হয়ে ওঠে এমনতর চা-ও রয়েছে।শুধুমাত্র  চা পাতা সেদ্ধ করে দিনের পর দিন খেতে বাধ্য হয়েছে এমনতর মানুষও রয়েছে দার্জিলিং-এর  বারবার উত্তাল হওয়া দিনগুলিতে। যাই হোক ছাত্র পড়িয়ে সে টাকায় নানা রকম টি পট কেনা হল যার বেশিরভাগই হোমডেকর হয়েই রয়ে গেল। কিন্তু চায়ের চর্চা চলতেই থাকলো। নতুন নামাজির মত চা নিয়ে খুঁতখুঁতানি সব সীমা পেরিয়ে গেলো। বাড়ির সকলকে নির্বিচারে হ্যাটা করতাম,ফুঃ! দুধচা খায়! অর্থাৎ পায়েস! আনকুত !
চা মৌলবাদ ঘোরতর হয়ে উঠলো। বন্ধুদের নির্বিচারে জাজ করতাম তাদের চায়ের টেস্ট রকমসকম দেখে। যুঁই গোলাপ ক্যামোমিল লেমনগ্রাস হ্যানত্যানের চা আবার চা নাকি! জ্যোৎস্নার সর পড়ে থাকা আধোজাগা চাগাছের ওপর যখন ফিসফিস করে ওস পড়ে,পাহাড়িয়া সুরের গুনগুনানি হাওয়ায় ভেসে মেঘের শরীরের অস্পষ্টতায় ডুবে যায় ,মশাল জ্বালিয়ে চাপাতা তোলে নরম আঙ্গুলের গোর্খা মেয়ে! সেই চায়ের স্বাদ অপার্থিব! দার্জিলিং পাহাড়ের ন্যাচারাল ভেজিটেশন ধ্বংস করে বাগানের পর বাগান গড়েছিল ইংরেজরা।সেই বাগানে গোর্খা কামিন পায়ে জোঁকের কামড় অগ্রাহ্য করে আজও পাতা তোলে রাতভর ।তৈরী হয় এক্সটিক চা। যত বয়স বাড়ছে চা মৌলবাদ ব্যস্তানুপাতিক হারে কমছে আমার। এখন বেল যুঁই যেকোনো চা,যা পাই খাই।দুধ চা নিয়ে নাক সিটকানো ছেড়ে দিয়েছি কবে! রাস্তার দোকানে”ঘনদুধএলাচ” চা ,টি বুটিকের “চমতকার”চা বা কলেজ ক্যান্টিনের “অখাদ্য” চা সব চা খেয়ে বোধি লাভ হয়ে গেছে ।এখন বুঝি চা নয়, চায়ে পে চর্চাটাই আসল নেশা!

By nb24x7

দিনদুনিয়ার খাসখবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *