রবি আড্ডায় অনিন্দিতা মিত্র
বয়স যত বাড়ে তত বেড়ে যেতে থাকে ফেলে আসা বস্তুর পরিমান। ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর, ডজন খানেক ডাকনাম, পুরনো পাড়া, ছেড়ে আসা ঠিকানা, আত্মীয় স্বজনদের ঘনিষ্ঠতা, পুরনো বন্ধু, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, টিউশন ব্যাচ…..কত কিছু ফেলে এসে বড় হতে হয় আমাদের। মনের কোনো কোণে থেকে যায় সবাই, কখনো ভালোলাগা আর কখনো বিরক্তির তিতকুটে স্বাদ হয়ে।
ফেলে আসা রাস্তারা আমার মনে থেকে গেছে মায়া হয়ে। রাস্তার জন্য এত মনকেমনকরা মায়া থাকতে পারে আমার মনে- এটা প্রথম বুঝেছিলাম লকডাউনের সময়। সারাটা লকডাউনে আমি শুধুমাত্র দুজনকে মিস করেছি প্রবল ভাবে, এক আমার রোজকার চলার পথ, বাড়ি থেকে কর্মস্থল অব্দি, আর দুই যে বাসে করে যাতায়াত করতাম। স্বপ্নেও কতবার দেখেছি তখন আমার সেই সাদা বাস! পুরো বিষয়টা হজম করতে আমার নিজেরই অসুবিধা হতো, কারন স্বভাবগত দিক থেকে আমি ভয়ংকর ঘরকুনো মানুষ, আমার কাছের লোকজন জানে কাজ ছাড়া আমাকে বাড়ি থেকে বের করা কী প্রবল কঠিন টাস্ক। সেই আমি দু’ বছর ধরে টানা মিস করলাম প্রায় দু’ ঘন্টার চলা একটা রাস্তাকে, আর কাউকে না! ওই রাস্তার দু’ পাশের বাড়িঘর, দোকানপাট, গাছপালা সব আমার মুখস্থ ছিল। প্রায় দশ বছরের সখ্যতা ছিল আমাদের, তারপর সেই আবার বড় হতে হলো, ঠিকানা বদল হলো।
প্রায় দেড় বছর পর আবার সেই রাস্তায় গেলাম কয়েকদিন আগে। আবারও বুঝলাম কত মায়া জমে ছিল এই রাস্তার জন্য। দেড় বছরের অদেখা চোখ জরিপ করলো প্রতিটা ইঞ্চি, আগের গাছেরা সব ঠিক আছে কিনা, তিনটে পলাশ, খান চারেক অমলতাস, অনেকগুলো ছাতিম, ডজন খানেক বট অশ্বত্থ……. ঠিক আছে সবাই, নতুন গাছও গজিয়েছে কয়েকটা! কিছু নতুন বাড়িঘর, দোকানপাট হয়েছে, পুরনো কিছু কিছু সরে গেছে। বাকি তো সব নতুন থাকে রোজ, প্রতিবার নতুন দৃশ্যপট, প্রতিবার নতুন গল্প, যে গল্পের শুরু বা শেষ কোনটাই দেখা হয়ে উঠবে না, একটা ছোট ঝলকই বরাদ্দ থাকবে আমার জন্য। একটা বাসস্ট্যান্ডের সামনে সিগনাল খেলো বাসটা, জানলা দিয়ে দেখলাম বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকা দুটো ক্লান্ত ছেলে মেয়ের দিকে, ছেলেটা একটা টিফিন বক্স থেকে চামচে করে কিছু খাচ্ছে আর মেয়েটা ভারি মায়াভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটা দু’বার ওকেও খেতে বললো, মেয়েটি মাথা নাড়লো। ছেলেটা কী যেন বললো মুচকি হেসে, মেয়েটা তা শুনে বেশ জোরে হেসে উঠলো, বাস এগিয়ে গেল, সিগন্যাল খুলেছে।
কিছু দূরে চলন্ত বাসের জানলায় বসে দেখলাম একটি বছর পাঁচেকের কন্যা তার বাবার হাত ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গিয়ে দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেল, বাবাটি অগত্যা কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, ততক্ষণে থেমে গেছে আমার বাসটিও, বিজয়গর্বে কোলে উঠে যেতে যেতে চোখাচোখি হল আমার সঙ্গে, হাত নাড়লাম, সেও। বাস আবার চলতে শুরু করলো।
আর এরকম ছোট ছোট অসমাপ্ত গল্প দেখতে দেখতে কেটে যায় পুরো যাত্রাপথ, যে গল্পের শুরু বা শেষ কোনটাই আমি জানি না। আর হয়তো সেটা জানি না বলেই তা এত বেশি ভালো লাগছে, হয়তো দূর থেকে দেখছি বলে ভালো লাগছে, হয়তো ওপেনএন্ডেড থাকছে বলেই এত আকর্ষণীয়, নিজের মতো করে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছি মনেমনে। মনেই থেকে গেছে সব পছন্দের ক্যারেক্টররা রাস্তার মতোই। জীবনের সব রঙ লেগে থাকে রাস্তার গায়ে, প্রয়োজন শুধু একটা লং ড্রাইভ আর একটা উইন্ডো সীট, কিছুটা রোদ আর হাওয়া যাবে ঠিক পিছুপিছু, কানে বাজবে “……সুহানা সফর অউর ইয়ে মৌসম হঁসি, হমে ডর হ্যায় হম খোঁ না যায়ে কঁহি…….”