রবি আড্ডায় পুরুষোত্তম সিংহ
আখ্যানের এগারোটি পরিচ্ছেদে হরেকরকম সমস্যা, প্রবাহিত সময়ের প্রবণতা, রাজনীতি, শ্রেণিচক্রে পিষ্ট মানুষের নামাবলি যে সুরে ভেসে গেছে তা প্রশংসনীয়। স্বপন পাণ্ডার ন্যারেটিভের একটি বিশেষ প্রসাদগুণ আছে। তা অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কিন্তু পরিবেশন দক্ষতা এমন নমনীয় যে তা রুক্ষ নয়। একটা আলগা পরিসর নির্মাণ করে কিছুটা আয়েস ভঙ্গিতে, কিছুটা শিথিল অথচ দ্রুত গদ্যে তা আলো দান করে। ন্যারেটিভ কোথাও ছড়া, শ্লেষ, ব্যঙ্গ, স্কেচ দ্বারা হালকা সুরে গম্ভীর জীবনচেতনার কথা উঠে আসে। আখ্যানকে তিনি কখনোই জটিল করেন না, সমস্যা কিন্তু জটিল। ন্যারেটিভে নানারকম ঠাট্টা, তামাশা, শ্লেষ, ব্যঙ্গ-হাসি, শব্দসাঁচ, চরিত্রের নানামাত্রিক গড়ন, কিছুটা উদ্ভট, কিছুটা চলতি সংস্করণ রেখে জীবনের গভীর পাদদেশে নিয়ে যান। এখানে সুনির্দিষ্ট কাহিনি নেই। আবার কাহিনির সবটাই নগরের অংশ। নাগরিক জীবনের বহমান সত্য। আর তা শেষ হয়েছে একুশ শতকের শেষ প্রহরে। করোনা, গোমূত্রপান, সংঘ শক্তির উত্থান, করোনা পূজা—সমস্ত মিলিয়ে আখ্যান হয়ে ওঠে একুশ শতকের চলমান ধারাপাত। এগারোটি বুলেটিনে নগরের নানামাত্রিক সমস্যা, চক্রান্ত, রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের নাজেহাল অবস্থা দ্বারা আখ্যান ঘটমান সময়কে যে ভাষায়, যে বয়ানে চিহ্নিত করে চলে তা একুশ শতকের বাংলা আখ্যানের জরুরি দিক বলেই বিবেচিত হবে।
‘সিটি বুলেটিন’ আসলে শহর সংস্করণের ইস্তেহার। শহর কীভাবে বদলে যাচ্ছে, শহরের সংস্কৃতি কোন খাতে যাচ্ছে, রাজনীতি কীভাবে মানুষকে ব্যবহার করছে এবং মানুষ নিজের প্রয়োজনে রাজনীতিকে কীভাবে ছুঁড়ে ফেলছে তার কাহননামা। ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতাদের বিশুদ্ধিকরণ, ক্লাবের পরিশুদ্ধিকরণ, রকবাজদের হালকা টাইট দেওয়া আবার প্রয়োজনে ভোটে ব্যবহার করা ইত্যাদি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শহরের রোজনামচা উঠে আসে।
স্বপন পাণ্ডা প্রবলভাবে রাজনীতি সচেতন। তবে আখ্যানকে পাঠক রাজনীতিমূলকভাবে একপেশে দেগে দিতে পারবেন না। স্বপন পাণ্ডার দক্ষতা এখানেই। আখ্যানে যা কথাবার্তা হচ্ছে, যে পরিসর গড়ে উঠছে তার তলদেশ দিয়ে বৃহত্তর-ক্ষুদ্র রাজনীতি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। বৃহত্তর রাজনীতি যেমন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি ক্লাব আবার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্লাব নামক ইউনিটের সংঘবদ্ধ প্রয়াস রাজনীতির পাশা খেলাকে ক্রমেই ভিন্ন চালে কিস্তিমাত করে। এইভাবে ক্লাবগুলি একদিন বামফ্রন্টকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। জনগণই যেহেতু গণতন্ত্রের নায়ায়ণ সেহেতু গণদেবতার সন্তুষ্টের নিমিত্তে নানা পূজাচার চলছে—দুয়ারে বিবিধ প্রকল্প এসেছে। ক্লাব তার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। স্বপন পাণ্ডা সময়ের পরাক্রমকে বিবিধ মাত্রায় স্পর্শ করতে চান। সেই সম্পৃক্তকরণ এতই গভীর এবং প্রকাশসজ্জা এমন মৃদু যা আখ্যানকে ভিন্ন সমীকরণে নিয়ে যায়।