রবি আড্ডায় সন্তু সাহা
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একবার হ্যাজবোল্ট না লাগিয়ে তালা মেরে চলে গেছিলাম। সেদিন বউ বাড়ি ফিরে আমার কুকীর্তি দেখে রেগে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বলে, আপনার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য বাড়ির সব চুরি গেছে।
আমি আবার কী করলাম?
কী করেছ একবার বাড়ি এসে নিজের চোখে দেখে যাও।
তালা মারিনি?
মারা না মারা সমান।
কী কী চুরি গেছে? বুকের উপর গ্রানাইট চাপিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
এখনও ঘরে ঢুকিনি।
না ঢুকে কী করে বলছ?
বেশি কথা বাড়িও না। চুরি যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
না কিছু চুরি যায়নি। তবে চুরি গেলে মনে হয় বউ বেশি শান্তি পেত। আমার ষষ্ঠী পুজো করার নৈবেদ্য আরো জোরালো হতো। তবে এই কাজের জন্য বছর খানেক কথা শুনতে হয়েছিল। প্রথম তিনমাস অফিসে নিয়ম করে ফোন আসত, তালা ঠিকঠাক মারা হয়েছ তো? চোর কিন্তু বারবার সুযোগ দেবে না।
একবছরের মাথায় এই তালা কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি মেলে আমার। যে কাজটা এক বছর আগে আমি করেছিলাম সেই কাজটা আরো গুছিয়ে উনি করলেন। আমি তো দরজা লাগিয়েছিলাম। উনি দরজা হাট করে খুলে রেখে স্কুলে চলে গেছেন। বাড়ি ফিরে দেখি দরজা হাঁ করে খোলা। ভাবলাম, গিন্নি হয়তো আগেই চলে এসেছেন।
জোর পটি পেয়ে গেছিল নাকি? দরজা বন্ধ করার সময় পায়নি?
ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে দেখি কেউ কোত্থাও নেই। ফোন করে জানলাম, উনি স্কুলেই আছেন। কিছুতেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না যে, তালা মারা তো দূরের কথা, দরজা না লাগিয়েই তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। না, এবারও কিছু চুরি যায়নি। আসলে চোর ভাবতেই পারেনি, এভাবে হাট করে দরজা খোলা রেখে কেউ চুরির জন্য প্রলোভিত করতে পারে। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই একবছর আগের মধুর স্মৃতি নিয়ে আমাকে খোঁটা দিত। তাকে আর ঘাঁটাতাম না, আমারও মুক্তি ঘটল।
এর কিছুদিন পর সমবেতভাবে এক দুর্দান্ত কীর্তি স্থাপন করলাম আমরা। অষ্টমীর দুপুরে সসপ্যানে দুধ গরম করতে দিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি গোটা রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভর্তি। দুধ উপচে পড়ে আগুন নিভে গেলেও গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওভেনের নব বন্ধ করে দেখি, সাদা সসপ্যানে দেখে মনে হচ্ছে কেউ নিপুণ হাতে আলকাতরা লেপে দিয়েছে। গোটা ঘর উৎকট গন্ধে ভরে গেছে। কিছুক্ষণ পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপের পর্ব চলল। বউয়ের বক্তব্য আমাকে নাকি গ্যাস বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু স্পষ্ট মনে পড়ছিল, ওটা ওরই বন্ধ করার কথা ছিল। যাইহোক শেষমেশ দুজন মিলেই পাপের বোঝা ভাগাভাগি করে নিলাম। পরদিন ওই সসপ্যান দেখে কাজের মাসি বউয়ের কাছে এসে বলল, বৌদি এ মাসের টাকা যা হয়েছে হিসেব করে দিয়ে দ্যান। এই সসপ্যান মাজতে হলে আমার হাতের আঙ্গুল আর থাকবে না। সসপ্যানের শ্রাদ্ধ হল।
এই ঘটনার পর কোথাও গেলে দরজার তালা মেরে বার দশেক তালায় ঝুলে ঝুলে দেখি, ঠিকঠাক লেগেছে নাকি। একসাথে বেরোলে আমার ঝোলা-ঝুলি শেষ হলে, বউ শুরু করে। চৌদ্দবার রান্নাঘরে গিয়ে কনফার্ম হই, গ্যাস বন্ধ আছে। বাথরুমের আলোর সুইচ, ঘরের ফ্যান, আলমারির লক, টিভির সুইচ, ইত্যাদি বন্ধ আছে কিনা দেখতে গিয়ে কোনদিনও সিনেমার শুরু দেখতে পাইনি।
সেবার পুজোর ছুটিতে ডুয়ার্স প্ল্যান করা ছিল। কামরুপে যাব। খাগড়াঘাট থেকে উঠব। বাড়ি থেকে গাড়িতে উঠে বউ শুরু করল, ডাইনিং এর ফ্যানটা অফ করেছিলে?
আরে মেন নামিয়ে এসেছি।
কিছুক্ষণ পর… আচ্ছা ফ্রীজের প্ল্যাগ খুলেছিলে? বললাম তো মেন নামিয়ে এসেছি।
গ্যাস সিলিন্ডার সিল করেছ?
হুম।
ছাদে তালা মারা হয়েছিল?
কাল রাতেই মেরেছিলাম।
বাথরুমের ট্যাপ খোলা ছিল না তো?
না।
গিজারের সুইচ বন্ধ করতে যে ভুলে গেছি।
আরে বাবা মেন নামিয়ে ইনভার্টারের প্ল্যাগ খুলে এসেছি। নিশ্চিন্তে থাকো।
কিছুক্ষণ পর…
আচ্ছা রাতের জন্য ডিমকষা আর রুটিগুলো নেওয়া হয়েছে?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, আমাকে আবার কখন বললে?
জানতাম ভুলে যাবে।
গাড়ি আবার ঘোরানো হলো। ডাইনিং টেবিলেই রাখা ছিল। ভুল করলে আমরা কেউই স্বীকার করি না। বিশেষ করে এইসব ক্ষেত্রে তো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যে কী শান্তি পাওয়া যায়! ওমা, রুটি ডিমের ঝোল নেওয়ার পর বউ আবার বেডরুমের দরজা খুলে ঘর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে ব্যাগে রাখল। এটা আবার কী ভুলে গেছিলে?
কিছু না।
মেকআপ কিট?
হুম।
আমিও চুপিচুপি শোকেস থেকে ইয়ারফোনটা পকেটস্থ করলাম। পরস্পর পরস্পরের দিকে ঈগল ও শকুনের দৃষ্টি বিনিময় হল। এরপর তালা-ফালা মেরে ঝোলা-ঝুলি কমপ্লিট করে যখন গাড়িতে উঠতে যাব, দেখি, ড্রাইভার ঘুমিয়ে গেছে। আমার ডাকে ধড়মড় করে উঠে বলল, আরো কিছু নেওয়ার থাকলে মনে করে নিয়ে নিন। ট্রেন এখনও অনেক দেরি। হেসে বললাম, আর কিচ্ছু নেওয়ার নেই। এবার চলো।