রবি আড্ডায় সবুজ সেন
সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি । দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে সব কিছুতেই বিরক্ত লাগে । আমারও তাই লাগছে ।
টুথব্রাশে টুথপেস্ট নেওয়ার পর মনে হল টুথব্রাশটা এত ধ্যেবড়ে গেল কি করে !!!! এখন এটাকে মনে হচ্ছে জুতা ঘষার ব্রাশ ।
চা খেতে গিয়ে মনে হল চায়ে চিনি মারাত্মক রকমের বেশি ।
সংবাদপত্র পড়তে গিয়ে মনে হল , না পড়লেই ভালো হত ।
এইরকমের বিরক্তি নিবারণের প্রাথমিক সমাধান হল ঠাণ্ডা জলে স্নান করে নেওয়া । সেখানে কোন সাবান শ্যাম্পু কিচ্ছু চলবে না ।
আমি সাবান-শ্যাম্পুবিহীন স্নান করে নিলাম ।
স্নান করার পর খানিকটা ভালো লাগা শুরু হল ।
আমি আমার লেখালেখির ঘরে গিয়ে কাগজ কলম নিলাম । ফুলের চেয়েও দিস্তা খাতা , নতুন বইয়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে ।
একটা নতুন গল্প হাতে নিয়েছি । গল্পের নাম ‘ সাদামাঠা অলৌকিক ‘… সেই গল্প এক লাইনও লেখা হয়ে ওঠেনি । এখন লিখব । এখন বেলা এগারোটা ।
তখনি কলিংবেল বাজল । টিং… …টং ।
কলিংবেল বাজানোর একটা ধরন আছে ।
যারা পরিচিত মানুষ তারা ঘনঘন কলিংবেল বাজায় । তাদের একটুও দেরি সহ্য হয় না ।
তাদের বেল বাজানোর কায়দায় একটা ভালোবাসার দাবী থাকে । আর , যারা অপরিচিত তারা সংকোচের সাথে আস্তে ধীরে বেল বাজায় ।
এই মানুষ অপরিচিত । সে সংকোচ নিয়ে বেল বাজাচ্ছে ।
আমার স্ত্রী গিয়ে দরজা খুলল এবং আমার কাছে একটা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এসে বলল , তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে ।
আমি সেই কার্ড হাতে নিতেই একটা গন্ধ পেলাম । গন্ধটা নতুন কালির ।
সেই সাদা কার্ডের ওপরে মোটা নীল কালিতে লেখা আছে…
” মাসুম মহম্মদ ,
এম.এ . , বিএড , পি.এইডি
হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক
বিঃদ্রঃ ঃ বিশেষ প্রয়োজনে জ্বীন এবং ভূত দ্বারা তাবিজ/কবজও দেওয়া হয় ”
আমার একটুও ইচ্ছা ছিল না তার সাথে দেখা করার , কিন্তু মাসুম মহম্মদ নামটা পড়ার পরেই মনে হল দেখা করি ।
মাসুম মহম্মদ নামে আমি একজনকে জানতাম । সে আমার উচ্চ ইশকুল পর্বের বন্ধু ছিল । খুবই আশ্চর্যের কথা বরাবর সে আমার চেয়ে রোল নাম্বারে সবসময় এক কদম এগিয়ে থাকত ।
যদি কখনও আমার রোল নাম্বার হত ৩৪…তো তখন তার ৩৩ । কখনও আমার ৫৬…তো তার ৫৫ ।
এভাবেই তৈরি হয়েছিল বন্ধুত্ব ।
আমার মনে হল সেই বন্ধুই এসছে । আমি তার সাথে দেখা করতে গেলাম ।
দেখা করতে গিয়ে আমি অপরিসীম হতাশ হলাম ।
একজন মানুষ সাদা পায়জামা পাঞ্জবি পরা । পায়জামাটা খাটো ।
বয়স তার যদিও আমারই কাছাকাছি । তার মুখটা লম্বা ধরনের । সেই মুখভর্তি দাড়ি । সেই দাড়িতে আবার মেহেন্দিও করা হয়েছে , তাই সেই দাড়ির রঙ বাদামী । মনে হচ্ছে উনি খুবই ধর্মপ্রাণ মুসলিম ।
মোটকথা , আমার ছোটবেলার বন্ধু মাসুম মহম্মদের সাথে তার কোনও মিল নেই । সেই মানুষ খুবই কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন । মনে হচ্ছে , আমার সাথে দেখা করতে আসাটা তার বিরাট বড় অপরাধ হয়েছে ।
আমি বললাম , বসুন । দাঁড়িয়ে আছেন কেন ?
উনি বললেন , না না , ঠিক আছে ।
বললাম , বলুন , কি বলবেন ?
উনি বললেন , আমি খুব বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি ।
জানতে চাইলাম , কি ধরনের বিপদ ?
উনি বললেন , আসলে আমি একটা জায়গায় আঁটকে গিয়েছি । আপনিই পারেন আমাকে বাঁচাতে ।
আমি কোন থই পাচ্ছি না । এই লোক কি এখন টাকা পয়সা চাইবে ? যদি চায় আমি বলব নেই । কিম্বা অন্য কিছু ? তাও বলব নেই ।
মানুষটি সম্পূর্ণ অন্য কথা বলল ।
‘ আপনার বাড়ির উত্তরপূর্ব কোনায় একটা কলা গাছ আছে । সেটা একটা মাটির টবে পোঁতা হয়েছে । সেই গাছ এখন খানিকটা বড়ও হয়েছে । ‘
আমি অবাক হয়ে বললাম , তো…!!!!
উনি বললেন , গাছটা আমার চাই ।
প্রথমবার যতটা বিস্মিত হয়েছিলাম , তার কথা শুনে দ্বিতীয়বার তার চেয়ে চোদ্দগুণ বেশি হলাম ।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম , কেন আপনি তো নিজেই জ্বিন ভূতের কারবার করেন । তাদের দিয়েই ব্যবস্থা করে নিন ।
উনি বললেন , ওরা পারবে না । তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি । আপনাকে আরও একটা কথা জানাতে চাই । আজকে আমার জন্মদিন ।
আজ মাসুম মহম্মদ নামের মানুষটির জন্মদিন । আমার ছোটবেলার বন্ধু তার জন্মদিনে আমাদের কয়েকজনকে নেমতন্ন করেছিল । সেই অনুষ্ঠানে আমি ছাড়া আমার বাকি বন্ধুরা যায়নি । সবার মনেই ভয় ছিল মুসলিম বাড়ির উৎসব যদি উল্টোপাল্টা কিছু খাইয়ে দেয় ।
মাসুমের মা মানে , কাকিমা উল্টোপাল্টা কিছুই খাওয়ায়নি । ছিল লুচি পায়েস মিষ্টি । ছিল ডাল , ঝুরি আলুভাজা , পটলপোস্ত , পমফ্রেট মাছ ।
মাসুম বারবার বলছিল , কিরে ওরা আসবে না ??
আমি ওর মন রাখার জন্য বলছিলাম , আসবে রে , আসবে । আমিই একটু আগে এসে পড়েছি ।
কিন্তু আমি জানতাম ওরা কেউই আসবে না । ওদের আসতে দেওয়া হবে না ।
আমার এইসব ভাবনার মাঝে দাড়িতে মেহেন্দি করা মাসুম মহম্মদ বুকে জড়িয়ে আমার বাড়ির টব সমেত কলাগাছটা নিয়ে টোটোতে উঠে বসল । টোটো বাইরে দাঁড় করানোই ছিল । সে বসামাত্রই টোটো রওনা দিয়ে দিল ।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
আমার বউ স্নান করে প্রতিদিন তুলশী গাছে জল দেয় । কলাগাছের টবটা তার পাশেই ছিল ।
সে দেখল সেখানে এখন কলাগাছটা আর নেই । সে আমাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করল ।
আমি উত্তর দিলাম ।
এরপরেই বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল । দুপুরে কোন রান্নাবান্না হল না । আমার মনে হতে লাগল , আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টটম জীব ।
পরের দিন আবার আমার কাছে একটা ভিজিটিং কার্ড এল । কার্ডটা নিয়ে এল আমার স্ত্রী । অবাক হয়ে দেখলাম আবার সেই মাসুম মহম্মদ এসেছে ।
আমার মনে হল সে হয়ত কলাগাছের ব্যাপারটা নিয়ে অনুশোচনা জানাতে এসেছে ।
কিন্তু দেখলাম তা নয় । ঘটনা আরও জটিল ।
উনি গতকাল যা যা বলেছিলেন তাই তাই বললেন । উনি কলাগাছটা নিয়ে যেতে চান কারন উনি কোথাও একটা জায়গায় আঁটকে গিয়েছেন ।
আমি বললাম , আপনি গতকালই টবে বসানো গাছটা নিয়ে গিয়েছেন ।
উনি বললেন , হ্যাঁ…আপনার কথা সত্য । কিন্তু আজ আবার নিতে হবে । আমার বড় বিপদ । আমি একটা সময়ে আঁটকে গিয়েছি । গতকাল আমার জন্মদিন ছিল ।
আমি বললাম , জন্মদিনের ব্যাপারটা আমি জানি ।
সেই সাথে আমার এটাও মনে পড়ল মাসুমের জন্মদিনে আমি ওকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ন আর মহাভারত বইটা উপহার দিয়েছিলাম । বইটা পড়ে ও আমাকে বলেছিল , দারুন লাগলো রে বইটা । চমৎকার লেখনী ।
মাসুমের ডানহাতে কনুইয়ের কাছাকাছি একটা জড়ুল ছিল । সেটা ছিল নীল রঙের ।
আমার স্মৃতিচারণ শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম লোকটা গতকালের মত টব সমেত কলাগাছটা নিয়ে টোটোতে উঠে বসেছে । তার সাদা পাঞ্জাবীতে টবের কাদা লেগে রয়েছে ।
সেদিনও দুপুরে খাওয়া হল না । আমার স্ত্রী তুলসীগাছে জল দেওয়ার সময় লক্ষ্য করেছে যে কলাগাছটা নেই । কেন নেই , আমি তাকে সেই কারনও বলেছি ।
পরেরদিন দিন আবার সেই ভিজিটিং কার্ড । তাতে নীল কালির গন্ধ । মাসুম মহম্মদ এসেছে ।
আমি আজ তৈরি হয়েই ছিলাম ।
বললাম , কলাগাছটা নেবেন তো ? আপনি একটা জায়গায় আঁটকে গিয়েছেন । উত্তরপূর্ব দিকের কলাগাছ আপনার জন্য খুবই শুভ । গত পরশুদিন আপনার জন্মদিন ছিল…তাই তো ??????
উনি হেসে ফেললেন । বললেন , কলাগাছ টোটকায় খুব কাজ দিচ্ছে । তবে আজকেই শেষ , আমি কাল থেকে আর আসব না ।
উনি আমার সামনেই টব সমেত কলাগাছটাকে বুকে জড়িয়ে তুললেন । তার পাঞ্জাবীতে মাটি লেগে গেল ।
টোটোতে উঠে তিনি আজকে আর বললেন না , তাড়াতাড়ি চল্ ।
বললেন , একটু দাঁড়া ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , তুই আমাকে চিনতে পারিস নি , তাই না ?
আমি কোন উত্তর দিলাম না । একই লোক পরপর তিনদিন একই সময়ে এসে একই কাজ করে যাচ্ছে এটাই আমার কাছে অমীমাংসিত রহস্য ।
উনি বললেন , আমিই তোর সেই বন্ধু মাসুম রে । যার জন্মদিনে তুই একাই গিয়েছিলি , আর কেউ আসেনি । তোর দেওয়া উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ণ মহাভারত বইটা এখনও আমার কাছে আছে রে ।
ওনার কথা শুনে আমার মনে হল , আমার সাথে এমন একটা কিছু ঘটনা ঘটছে যার নিয়ন্ত্রন আমার হাতে নেই । কিন্তু চমকের তখনও একটু বাকি ছিল ।
লোকটা এবার তার ডানহাতের পাঞ্জাবীটা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে একটা নীল রঙের জড়ুল দেখাল ।
বলল , আমি সত্যিই সেই মাসুমই রে । তোর বন্ধু মাসুম । আমি একটা জায়গায় আঁটকে গিয়েছি । আজ আমার রেহাই হবে । অ্যাই…টোটো চালাও ।
টোটো চলে গেল । আমি পাথরের মত নির্বোধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । যা ঘটল তা আমার চিন্তাচেতনার অতীত ।
ঘুমটা ভেঙে গেল । আমি ধড়মড় করে উঠলাম । বুঝলাম এতক্ষণ আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম । আমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে , সেই সাথে তীব্র পিপাসাও লাগছে ।
আমি আসলে উপুড় হয়ে শুয়েছিলাম । এতে আমার হৃদপিণ্ডের নীচে আমার হাতটা চাপা পড়েছিল ।
হৃদপিণ্ড মানবশরীরের একটি বিরামহীন অঙ্গ , তার কাজ সর্বদা রক্ত পাম্প করে মস্তিষ্কে পাঠানো । মস্তিষ্কে রক্ত ঠিক মত না পৌঁছালে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় আর তখনই মানুষ ভুলভাল নানা রকম ভয়ের স্বপ্ন দেখে । আমার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে ।
কিন্তু আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে , স্বপ্ন এত্তটা নিখুঁত গোছানো আর এত্ত পরিষ্কার হতে পারে !!!!!!
এ যেন 1080 pixel-এর ভীষণ পরিষ্কার ছায়াছবি । রঙিন স্বপ্ন ।
আমি প্রথমেই গিয়ে দেখলাম কলাগাছটা আছে কিনা । কলাগাছ তার জায়গায় ঠিকই আছে । কিন্তু আমাকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে , বলা যায় না স্বপ্ন সত্যিও হতে পারে ।
কিন্তু এগারোটা পেরিয়ে গেলেও স্বপ্ন সত্যি হল না । আজ আর কেউ এসে ভিজিটিং কার্ড দিল না । কেউ কলাগাছ নিয়ে চলে গেল না এবং আজকে দুপুরের খাওয়াও হল খুব ভালো ।
দুপুরে খাওয়ার পরে একটু ভাত ঘুম বাঙালির বড় পছন্দের । আমিও ঘুমোলাম ।
বিকেল ভাবলাম এবার ‘ সাদামাঠা অলৌকিক ’গল্পটা নিয়ে বসা যাক । বসলাম ।
বসেই আবার চমকে গেলাম । আমার গল্পের খাতার ভেতরে তিনখানা ভিজিটিং কার্ড । প্রত্যেকটা কার্ড থেকে নীল কালির গন্ধ আসছে ।
প্রতিটা কার্ডে লেখা রয়েছে , ” মাসুম মহম্মদ ,
এম.এ . , বিএড , পি.এইডি
হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক
বিঃদ্রঃ ঃ বিশেষ প্রয়োজনে জ্বীন এবং ভূত দ্বারা তাবিজ/কবজও দেওয়া হয় ”
তুলসীগাছের পাশেই আছে টবে সেই বসানো কলাগাছটা ।