রবি আড্ডায় শৌভিক রায়
রাস্তার ওপারেই মসজিদ। ভোরে আজানের শব্দে জাগি। ঘুমিয়ে পড়ি আবার।
মসজিদের মাঠে খোঁচা খোঁচা ঘাস। পায়ে লাগে। তবু ফুটবল খেলি। মধু আর আমি।
মধুদের বাড়ি টিনের। আমাদের বাড়িও। ওদের বাড়ির বড় গর্ত আছে। আমাদেরও আছে। আমরা ওই গর্তকে বলি `পাগার`। মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে পাগার পার হই। ওটা আমাদের খেলা। পাগারে নোংরা ফেলা হয়।
জানালা বেয়ে ওপরে ওঠাও আমাদের খেলা। সেদিন মধু সবার ওপরে ছিল। ওর নিচে আমি। আমার নিচে শুক্লা। তারপর মনাদি। মধু ওর হাতের প্যাকিং বাক্সের কাঠের ঢাকনা ফেলে দিল। সেটা আমার গাল কেটে নিচে পড়ে গেল।
রক্ত আর রক্ত। বড় কাকিমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে।
কাকিমার গায়ে মায়ের গন্ধ। ছোটবেলায় মরে যাচ্ছিলাম। কাকিমা বাঁচিয়েছিল। কাকিমা খুব ভালবাসে। আমিও।
দুপুরে জ্বর এলো। ব্যথা খুব।
মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম বিকেলে। বাড়ির সামনে বড়কাকার স্টেশনারি দোকানের সামনে।
মসজিদের পাশ দিয়ে যে রাস্তা, সে রাস্তা দিয়ে মা আসবে। ওই রাস্তা চলে গেছে ডাকবাংলো পাড়ার দিকে। ওখানে মায়ের স্কুল। মা দিদিমণি।
মায়ের স্কুলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা আরও ভেতরে চলে গেছে। সেই রাস্তায় খানিক এগোলে ডান হাতে পুকুর। ওই পুকুরে চন্দ্রবোড়া সাপ আছে। সেই সাপ রোদ পোয়াতে রাস্তায় শুয়ে থাকে। শর্মিলাদি বলেছিল। শর্মিলাদি আমাকে পড়াত।
এখন আমি এখানে থাকি না। মাঝে মাঝে আসি। বাবা নিয়ে আসে। বাবুয়াদার সঙ্গেও আসি। দাদাকে বাবা একা ছাড়ে না।
আমি এলে রাতে মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়। দুপুরে বড় কাকিমা কাছে নিয়ে শোয়। মানির বাড়িতেও যাই। মানি চিড়ের মোয়া খেতে দেয়, কখনও নারকোলের তক্তি। মানির খাটে পা ঝুলিয়ে বসে খাই আমি। মানি জড়িয়ে ধরে আদর করে। মানিও দিদিমনি। মানিকে সবাই ভয় পায়।
মা`কে দেখা যায় ওই। মাথায় ছাতা। পাশে ঝর্ণা মাসি। মা`কে দেখে সামনে এগোই। যেতে পারি না। পা টলমল করে। পেছন থেকে মেজকাকা জড়িয়ে ধরে। গা এলিয়ে দিই। শুধু আকাশ দেখি। বিরাট আকাশ। নীল।
ফুলদিঘির পারে শিশির ডাক্তার বসেন। ওঁর সব ওষুধ একরকম। পেছনের ডিস্পেন্সারিতে কম্পাউন্ডার কাকা লাল ওষুধ বানান। বরফির মতো কাগজ কেটে ওষুধের শিশির গায়ে লাগিয়ে দেন।
রাতে জ্বর বাড়ে। জ্বর বাড়লে আশুকাকা সামনে আসে। আশুকাকা নেই। মরে গেছে। ওর জন্য আমি চলে গেছি বাবার কাছে। আশুকাকা এসে অনেক কথা বলে। আমাকে নিয়ে যায় থানার পুকুরে। কোয়ালিদহে। ওর সাইকেলে চেপে গোসানিমারি যেতে যেতে পশ্চিমের রোদে খুব গরম লাগে। ঘাম হয়। ভিজে যায় সব। কেউ গা মুছিয়ে দেয়।
চোখ খুলি। মা চুপ করে বসে। গম্ভীর। কাকিমার চোখে জল। দিদা বলে ওঠে, `চোখ মেলছে, ভয় নাই। পোলাপান। দুষ্টামি তো করবই। অহন কিসু খাওয়াও ওরে।`
মা কেঁদে ওঠে। চুপ করে থাকি। পাশ ফিরি। কান্না পায়। খুব কান্না পায়। কাঁদি না। আমার নাকি চোখে জল আসে না। সবাই বলে।
কিন্তু মা কাঁদলে কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। কান্না বোধহয় কষ্ট কমায়। কিন্তু কাঁদতে পারি না।