রবি আড্ডায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে সাউন্ড সিস্টেমে উঁচুগ্রামে হার্ড রক শুনছে দ্রাঘিমা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে শীর্ষ খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিল ঈষৎ ভারী গড়নের দ্রাঘিমা বসে বসেই সুরের তালে মাথা দোলাচ্ছে। হার্ড রকেই যে দ্রাঘিমার আসক্তি তা নয়, ইচ্ছে হলে সে পপ শোনে, কখনও জ্যাজ। পুরোটাই মুডের ওপর নির্ভর করে। শীর্ষ কিন্তু দ্রাঘিমা নয় শান্তশ্রীর কথাই শুধু ভাবছিল।
একটা বেসরকারি সংস্থায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার শীর্ষ। কাজের প্রেশার আছে। বাড়ি ফিরে আসার পর এই অলস সময়টা তার শান্তশ্রীর জন্য বরাদ্দ। এটাই তার চল্লিশ উত্তীর্ণ জীবনের একমাত্র বিনোদন। সদ্য ফোটা বসরাই গোলাপের মতো এক তরুণীর কচি মুখের লাবণ্য তার সারা দিনের ক্লান্তি শুষে নেয়। মেয়েটির শ্রীলক্ষ্মী রূপ দেখে প্রথম দর্শনেই আপাদনখশির প্রেমে পড়ে গিয়েছিল শীর্ষ, মনে মনে নাম রেখেছিল শান্তশ্রী।
দ্রাঘিমা এক অ্যাড এজেন্সির টপ একজিকিউটিভ। বিদেশি ক্লায়েন্টদের খুশি করার জন্য প্রায়ই তাকে হোটেল বা বারে পার্টি দিতে হয়। শাঁসালো মক্কেল হলে ড্রিংকের আসর বসাতে হয় বাড়িতে ডেকে এনে। শীর্ষ আপত্তি করলে দ্রাঘিমা বোঝায়, ‘দিস ইজ আ পার্ট অফ মাই জব। কেন বুঝছ না, আমার ক্যারিয়ার আর ফিউচার এর সঙ্গে জড়ানো’। এক একদিন দ্রাঘিমা তাড়াতাড়ি ফিরে আসে অফিস থেকে। ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে ড্রয়িং রুমে আসে। হুইস্কি পান করতে করতে হাই ভলিউমে ওয়েস্টার্ন মিউজিক শোনে। সুর ও সুরার মৌতাত যত তার মস্তিস্কে ছড়িয়ে যেতে থাকে তত তার মাথা ঝাঁকানো বাড়ে।
শীর্ষ টিটোটলার নয়। কখনও সখনও গ্লাস হাতে সঙ্গ দেয় বউকে। তবে দেড় পেগের লিমিট ক্রস করে না কখনও। নিজে তৃতীয় বা চতুর্থ পেগ নেবার সময় ‘তোমার মতো পিউরিটান লোক বাপের জন্মে দেখিনি’ বলে দ্রাঘিমা তিরস্কার করে শীর্ষকে। শীর্ষ মৃদু হাসে। মুখে কিছু বলে না। হাইপো থাইরয়ডিজম ধরা পড়ার পর দ্রাঘিমা শর্ট টেম্পারড হয়েছে। ওজন বেড়েছে অনেক। স্কিন রুক্ষ হয়েছে। হেয়ারলাইন পিছিয়ে গেছে। খিটখিটে হয়ে গেছে মেজাজ। মুড সুইং করে খুব। তাই শীর্ষ অহেতুক ঝগড়া এড়িয়ে যেতে চায়। দশ বছরের দাম্পত্য তাদের। এখনও ইস্যু হয়নি। ইনফারটিলিটি ক্লিনিকে নিয়মিত দৌড়তে হয় সে কারণে।
শীর্ষর এই স্ট্রেসের জীবনে একমাত্র মরূদ্যান শান্তশ্রী। অনিন্দ্য কোনও জলপদ্মের মতো সেই মেয়েটির কোমল সারল্য জড়ানো মুখ শীর্ষকে ছায়া দেয় আজও। শীর্ষ শ্বাস গোপন করে। বাইরের লোকের বোঝার কথা নয়, কিন্তু তার আর দ্রাঘিমার মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাব আছে। দুজনের বনিবনা না হবার বীজ লুকিয়ে আছে তাদের চরিত্রের মধ্যে।
শীর্ষর ঠাকুরদা ছিন্নমূল হয়ে এদেশে চলে এসেছিলেন কুমিল্লা থেকে। সে রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে। তাদের বাড়িতে মদ ঢোকে না। ড্রিংক করা সেখানে ট্যাবু। একান্নবর্তী যৌথ পরিবার তাদের। পারিবারিক ট্র্যাডিশনের সূত্রেই শীর্ষ শান্ত। ধীরস্থির। কথা বলে নিচু গলায়। চা খায় নিঃশব্দ ও আলতো চুমুকে।
দ্রাঘিমা নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মেয়ে। পুনের ওশো আশ্রমের কাছে বাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তার বাবার আস্থা নেই। দ্রাঘিমার দাদা চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর একমাত্র ছেলেকে আলাদা করে দিয়েছেন। ‘আলাদা থাকো, ভাল থাকো। অন্যের দায় বা সাহায্য কোনওটাই নেবার প্রয়োজন নেই’ – এটাই তাঁর জীবনদর্শন, যা চারিয়ে গেছে দ্রাঘিমার রক্তেও। জীবনবোধ, কালচার, রুচি কোনও কিছুতেই শীর্ষ আর দ্রাঘিমার মধ্যে মিল নেই। দ্রাঘিমা কনভেন্টে পড়েছে। গিটার শিখেছে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলার কাছে। ইংরেজি গানের প্রতি আসক্তি সে কারণে। হইচই, হুল্লোড়, পার্টি এসব তার জীবনের অঙ্গ। সে ক্যারিয়ারিস্ট। ঘুষ খাওয়া বা দেওয়া নিয়ে তার কোনও ইনহিবিশন নেই।
তবুও দুজনের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল একদিন। প্রেমের বিয়ে নয়, সম্বন্ধের বিয়ে। শীর্ষর পুনেবাসী বড়মামা এনেছিল সম্বন্ধটা। পাশের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে অ্যালায়েন্স। মেয়ে অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি করে। ফোটো দেখে এক কথায় হ্যাঁ করে দিয়েছিল শীর্ষ। ট্রেনে চেপে পুনে যাবার পথে শীর্ষর সহযাত্রী ছিল মেয়েটি। আজও চোখ বন্ধ করলেই শীর্ষ দেখতে পায় সেই দৃশ্যটা। সেই ঝলমলে ছবিটাই রিওয়াইন্ড করে সে রোজ দেখে। এই দম আটকে আসা দাম্পত্যে এটুকুই তার একমাত্র ফ্যান্টাসি।
শীর্ষ এসি টু-টিয়ারে চেপে পুজোর ছুটিতে যাচ্ছে বড়মামার বাড়িতে। ট্রেনের আপার বার্থে তার সিট। উল্টোদিকের বার্থে সুডৌল মুখের এক তরুণী। দূরপাল্লার ট্রেন চলছে। দুজন অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে দুজনকে। তাকিয়েই আছে প্রেমমুগ্ধ চোখে। টানা টানা চোখের একঢাল কালো চুলের কৃশতনু মেয়েটির নাম শীর্ষ সেদিনই মনে মনে রেখেছিল – শান্তশ্রী !