রবি আড্ডায় তৃষ্ণা বসাক
(-নিজের শাঁখা পরা হাত দেখতে কেমন লাগে তোমার অর্জুন? সারাজীবন যুদ্ধ করে, অস্ত্র সংগ্রহের জন্যে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ঢুঁড়ে ফেলে, এখন এই নৃত্যগীতের জীবন তোমার তো বিশ্রামের মতো, তাও আবার রাজ অন্তঃপুরে, চারপাশে ঘিরে আছে সুন্দরী রাজকুমারীরা, উত্তরা তোমার গায়ে একটু বেশিই ঢলে পড়ে না? তুমিও কি ওকে? থাক সেসব কথা।
-কোনদিন কি ভেবেছ তুমি আমরা কীভাবে বেঁচে আছি। একটা ছোট বাড়িতে গাদাগাদি করে গুরুমার কাছে আমরা নজন। তারপর লোকজন আসে যায় রোজ। এই লকডাউনে কাজ নেই আমাদের। )
‘এই দেখ দেখ, ওরা উঠেছে’ ফিসফিস করে বলল রিনা। যাকে বলা সে একটা কন্ট্রোল থিয়োরির বইয়ে ডুবে আছে। রিনা কনুই দিয়ে ঠেলা মারল আবার-
‘দেখ না, সেই মেয়েটা। মুন্নি’
নূপুর বিরক্ত হল, কিন্তু মুখ তুলে তাকাল। মুন্নি –এই নামটার আকর্ষণ সে এড়াতে পারল না। আর প্রতিবারের মতো তাকিয়ে ওর একই কথা মনে হল- কেউ বলবে মুন্নি মেয়ে নয়! ও যে শুধু আশ্চর্য সুন্দর তাই নয়, ওর মুখে এক অদ্ভুত সারল্য, যা ওর বাকি সঙ্গিনীদের মধ্যে নেই। সালমা বা জুঁই এদের চোখেমুখে কি কর্কশতা, বারবার দাড়ি গোঁফ কামাবার ছাপ মুখে, কথাবার্তাও অত্যন্ত চোয়াড়ে, কারণে অকারণে এরা কানফাটানো শব্দে হাততালি দ্যায়, এজন্যে এদের নামই হয়ে গেছে তালিমাসি, আর কারো সঙ্গে ঝগড়া হলেই, শাড়ি সায়া তুলে নিজেদের গোপনস্থান দেখায়।
মুন্নি একেবারেই সেরকম নয়।ওর চেহারা যেমন কমনীয়, তেমনি ওর পোশাক আর কথাবার্তাও খুব মার্জিত। নূপুর তাকিয়ে দেখল মুন্নি এখন পরে আছে একটা হলুদ জমিতে নীল ফুল ছাপ সালোয়ার কামিজ, কানে অক্সিডাইজড দুল আর বাঁ হাতে লাল একটা সুতো ছাড়া আর কোন অলংকার নেই। ঘাড়ে একটা ট্যাটু আছে অবশ্য। একটা প্রজাপতিকে ঘিরে একটা সাপ। রদ্দি চামড়ার সাইড ব্যাগ নয়, ওর কাঁধে ঝুলছে পুঁতি বসানো একটা বাহারি ঝোলা। ওকে একটা কলেজ ছাত্রী ছাড়া আর কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু কথা বললে সেই ধরা ধরা পুরুষালি গলা, আর চ্যাটালো হাতের পাঞ্জা, এ দুটোই হয়তো ধরিয়ে দেবে ওর পরিচয়।
নূপুর আবার বইয়ে মন দিল।
এইসময় ট্রেনে প্রচণ্ড ভিড় হয়, তবু মুন্নি ঠেলেঠুলে ঠিক ভেতরে চলে আসে, আর দৈবাৎ সিট খালি পেলে নূপুরের পাশে বসে পড়ে।
চোখাচোখি হলে হেসে বলে ‘ও দিদি ভালো আছ? যাদবপুর নামবে তো এগিয়ে যাও। হেভি ভিড়।’
নূপুরের শরীর কুঁচকে যায় ও পাশে বসলে। ওর মনে পড়ে যায় একটা পুরনো স্মৃতি। বছর কয়েক আগে, ও যখন ইলেভেনে পড়ে, পাশের বাড়ির এক দিদির সঙ্গে জীবনে প্রথম পার্লারে গিয়েছিল সে। তাদের শহরের প্রথম পার্লার সেটা। লেডিজ ওন।এদের আগে টেলারিং ছিল। মেয়েদের যাবতীয় পোশাক বানাত । নূপুর কতবার দোকানে দাঁড়িয়ে ওদের ক্যাটালগ ঘাঁটাঘাঁটি করে ড্রেস বানাতে দিয়েছে।কতবার বলেছে এই সব আদ্যিকালের ক্যাটালগগুলো ফেলে দিয়ে লেটেস্ট কিছু আনাতে। কতবার ডেলিভারি ডেটে গিয়ে না পেয়ে ঝগড়া করেছে লতিকাদির সঙ্গে। সেই দোকানের পেছনেই যে এতটা জায়গা ছিল তা কে জানত? লম্বাটে জায়গা। পরপর রিভলভিং চেয়ার। দেওয়াল জোড়া আয়না। অনেক রকম যন্ত্র। ঝকঝকে নতুন। সেসব জীবনে কখনো চোখেই দেখেনি নূপুর। মিলিদি টেনে না আনলে ওর দেখাই হত না। মিলিদির বিয়ে সামনের মাসে। তাই সে কনে সাজানোর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে। রিক্সায় আসতে আসতে বলেছে, ‘আমাদের এখানে কনে সাজানো মানে তো খালি গুচ্ছের পাউডার মাখিয়ে চন্দন পরানো। বিয়ের কনের একটা রূপ রুটিনের দরকার হয়, সেসব জানে নাকি অপুদি?’
অপুদির বাড়ি ব্যানার্জিপাড়ায়।তাদের ছোট শহরে কনে সাজানোয় সে একচেটিয়া ছিল এতদিন । মিলিদির কথা শুনে নূপুরের দুঃখ হল অপুদির জন্যে। অপুদির বাবা মারা গেছে অনেক ছোটবেলায়। বিয়ে হয়নি। মা আর দুই ছোট ভাই বোনের সংসার তো এই করেই চালাচ্ছে। একবার খুব ছোটবেলায় ওই পাড়ায় কার যেন বাড়িতে বেড়াতে গেছিল সে। একগাদা বাচ্চা মিলে খেলতে খেলতে ওদের বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়েছিল। অনেকখানি উঠোন। তারপর দাঁত বার করা টালির চালের বাড়ি। অপুদির মা বারান্দায় বসে বসে শিলে কিছু একটা বাটছিল। আর অপুদি পাশে বসে একটা কড়কড়ে নতুন তাঁতের শাড়ি দিয়ে নৌকো বানাচ্ছিল। কনে সাজানো ছাড়াও তত্ত্বও সাজায় অপুদি।
অপুদির কথা বলতেই সেই দাঁত বার করা বাড়িটা মনে পড়ে যায়। আর সেই নৌকোটা।লাল জমির জরি পাড় একেবারে মার্কামারা নতুন বউয়ের তাঁতের শাড়ি দিয়ে কেউ কোনদিন নৌকো বানাবে না অপুদির জন্যে, সেই সারাজীবন অন্যদের জন্যে নৌকো গড়ে ভাসিয়ে দেবে স্বপ্নের নদীযাত্রায়।
সেই অপুদিকে ডাকবে না মিলিদি? লেডিজ ওন পার্লারে গিয়ে অবশ্য অপুদির কথা মনে রইল না ওর। কীরকম এক সুগন্ধ ভেতরে। ওর এযাবৎ জানা সব সুগন্ধ থেকে একেবারে অন্যরকম। নানা দামি ক্রিমের শিশি থেকেই আসছে নিশ্চয় গন্ধটা। । মিলিদি যখন মল্লিকাদিকে নানান সার্ভিসের রেট জিগেস করছিল, ও তখন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ভেতরটা। আর তখনি ও দেখতে পেল একদম কোণের চেয়ারে একজন হিজড়ে বসে আছে, তার দুহাতে হলুদ বালি বালি রঙের থকথকে একটা জেলির মতো লাগানো, আর সেটার ওপর দিয়ে গজ কাপড়ের মতো একটা কাপড় টানছে একটা মেয়ে। পরে জেনেছিল ওটাকে বলে ওয়াক্সিং। গায়ের অবাঞ্ছিত লোম তোলে ওইভাবে। সেদিন ওটা দেখে ওর গা গুলিয়ে উঠেছিল, বাইরে বেরিয়ে বলেছিল, ‘লেডিজ ওন নাম, সেখানে হিজড়েরা কীভাবে ঢোকে? আমি কোনদিন এখানে আসব না।’
আসেওনি সেখানে নূপুর। যতদিন না অন্য পার্লার খুলল, কোন পার্লারেই যায়নি। সেখানেও হিজড়েরা আসেনা তো? এমন একটা ভয় ওর কাজ করত। বন্ধুরা আশ্বস্ত করে বলেছিল, এগুলোতে আসার মতো ক্ষমতা ওদের হবে না, তুই নিশ্চিন্ত থাক। নতুন পার্লারগুলো খুব এক্সপেন্সিভ। তাছাড়া লেডিজ ওন টা ছিল স্টেশনের কাছে। হিজড়েরা ট্রেন ধরার আগে চট করে পার্লার ঘুরে যেত।
তবুও অনেকদিন পার্লারমুখো হয়নি নূপুর হিজড়েদের ভয়ে। ওর নিজের শহরে যদিও এর মধ্যে অনেক পার্লার খুলেছিল, ড্রিমগার্ল, নিউ লুক সাঁলো, সাজগোজ, এমনকি ইউনিসেক্স পার্লার খুলেছিল দু- দুটো।একেবারে সাড়া পড়ে গেছিল ওদের ছোট শহরে। দুষ্টু জোকস চালু হয়েছিল অনেক। সারা বডি মাসাজ কি একসঙ্গেই করানো হবে ছেলে আর মেয়েদের? তখনি ওর কানে এসেছিল কিছু কিছু পার্লার, নাকি নামেই পার্লার, ভেতরে মধুচক্র চলে, স্যান্ডউইচ মাসাজ বলে একটা মাসাজ আছে, এসব শুনে ওর যেকোন পার্লার সম্পর্কেই ভীতি এসে গেছিল। তারপর স্মৃতি জুড়ে বসে থাকা সেই পুরুষালি লোমশ হাত, আর তার ওপর বালি রঙের থকথকে জেল, একটা সাদা গজ কাপড় টাইপের তার ওপর দিয়ে টানা হচ্ছে আর চড়চড় করে লোম উঠে আসছে- সেটা ওকে কিছুতেই সহজ হতে দিচ্ছিল না।
দৈবাৎ ও একটা ভালো পার্লারের খোঁজ পেল। কৃষ্ণ সিনেমার গলিতে হংকং বিউটি পার্লার। এখানেও ও যেন কার সঙ্গী হয়ে গেছিল, পারমিতার বোধহয়। পারমিতা গোল্ড ফেসিয়াল করাবে, ও বোর হবে জেনেও গেছিল। গিয়ে বেশ অবাকই হয়েছিল। যারা অপেক্ষা করছে, তাদের জন্য সোফা, একটা সাইড টেবিলে অনেক দেশি বিদেশি পত্র পত্রিকা, দেখেই চমকে গেল নূপুর। একটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করল সে। মার্কেজের অসাধারণ একটা ইন্টারভিউ। পড়তে পড়তে তার কানে একটা চেঁচামেচি কানে এল। কৌতূহলী হয়ে দেখল পার্লারের মালকিন, পরে জেনেছিল তাঁর নাম কিরণ ছেত্রী, একজন নেপালি মহিলা, দুজন হিজড়েকে প্রত্যাখান করছেন, আর তারা উদুম খিস্তি করতে করতে চলে যাচ্ছে।
ওদের বার করে দিয়ে শান্ত মুখে কিরণ বললেন ‘আমার পার্লারে এইসব কিন্নরদের ঢুকতেই দেব না। ওরা এলে আমার অন্য কাস্টমাররা আসবে না। আর অনেস্টলি বলছি, ওদের দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করে। আমার মেয়েরাও ওদের গায়ে হাত দেবে না।তবু সাহস কত! বলছে টাকা ফেলব, ফেসিয়াল করে দাও। আমি নাকি ওদের ঢুকতে দিতে বাধ্য। পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে’
নূপুর শুনছিল সব। কিরণ তার দিকে চেয়ে বললেন ‘ইউ নিড আ ইমিডিয়েট হেয়ার কাট। আপনাকে লং স্টেপ মানাবে। দেখি চুলের ওয়েভ কেমন আছে’
নূপুর মুগ্ধ হয়ে গেল কিরণের ইংরেজির নিখুঁত উচ্চারণ শুনে। বলল ‘সত্যি আপনার পার্লারে ওদের আপনি ঢুকতে দেন না? আসব তাহলে আমি’
কিরণদি বলল ‘চুল কাটবেন? আজ?’
নূপুর ভেবে দেখল কালই শ্যাম্পু করেছে। কাটাই যেতে পারে। কিন্তু আজ কী বার? শনিবার কি? শনিবার তার জন্মবার। জন্মবারে চুল বা নখ কাটতে দ্যায় না মা। নাহ, আজ তো শুক্রবার।
সে রাজি হয়ে গেল কাটতে। কাটা হয়ে গেলে কিরণদি বলল ‘আপনার নাকের দুপাশে প্রচুর ব্ল্যাক হেডস। ভালো করে মাসাজ করে ফেসিয়াল করে দিই?’
ব্ল্যাক হেডস কথাটা সে প্রথম শুনল। আয়নার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে কিরণ ছেত্রী। হ্যাঁ একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছে, স্কিনটাও বেশ ডাল। কিন্তু ব্ল্যাক হেডস কোনটা? হঠাৎ আয়নায় ওর মুখ মুছে গিয়ে ভেসে উঠল সেই হিজড়েটার মুখ, যে একটু আগে এই পার্লারে ঢোকার চেষ্টা করছিল। সে কখন এল আবার, এসে নূপুরের চেয়রটাতেই বসল? নূপুরের গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল।
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘’নাথিং’ স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল নূপুর। লজ্জায় তার কান লাল হয়ে গেছে।এত সুন্দর ঠান্ডা-ঠান্ডা পরিবেশ, হালকা মিউজিক চলছে, ক্রিমের মিস্টি গন্ধ, তবু ওর কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। ওর কেবলই মনে হছে এই চেয়ারটাতে ও নয়, সেই মেয়েটা, মেয়ে কোথায়, হিজড়েটা বসে আছে।
শখ কত! এত কুৎসিত চেহারায় ফেসিয়াল, পেডিকিওর ম্যানিকিওর কিছু বাদ নেই। একটা মেয়ের মুখে শুনেছিল লেডিজ ওনে এসে ওরা সব করায়। আর সবথেকে দামি ফেসিয়াল করায়।
নূপুর বিস্মিত হয়ে বলেছিল
-এত টাকা কোথায় পায় ওরা?
-আরে ওদের হাতে পায়ে রোজগার। বাচ্চা ছেলে হলে দশ, মেয়ে হলে পাঁচ নিচ্ছে। তারপর ট্রেনে, বাসে, এমনকি সিগনালে আটকানো ট্যাক্সির লোকের কাছ থেকেও। এছাড়া রাতে তো আরও…
বলে মুচকি হেসেছিল মেয়েটি
সেই ইঙ্গিত বুঝে নূপুর বলেছিল ‘কীভাবে? অনেস্টলি, আমি কিছু জানি না। ওদের তো কিছুই নেই শুনেছি। কী করে তাহলে?’
মেয়েটা ওকে অনেক কিছু বুঝিয়েছিল, সব কথা মাথায় ঢোকেনি নূপুরের, আর যেটুকু বুঝেছিল তাতে ওর গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল। আর কিছু জানতে ইচ্ছে হয়নি।
মেয়েটা আবার বলেছিল, ‘জানিস তো, ওদের এখন রাগ সবার একটা করে বাচ্চা বলে। রোজগার কমে গেল না?’
২
একবছরের কাছাকাছি বন্ধ ছিল কলেজ। প্রথমে রিসার্চ স্কলার, তারপর পি জি, তারপর ইউ জি স্টুডেন্টসদের নিয়ে ধাপে ধাপে খুলবে। অনলাইন ক্লাসের চক্করে তাকে পড়তে হয়নি, যেহেতু তার বেশি কাজটাই ল্যাবরেটরিতে, তাই এই সময়টা নেট সার্চ করা, বিভিন্ন রিসার্চ পেপার পড়া আর গাইডের সঙ্গে টাচে থাকা – এছাড়া কিছু করার ছিল না। এমনিতে সময়টা ভালই কেটেছে। জীবনে এত লম্বা ছুটি কাটায়নি কোনদিন।
প্রথম কদিন ট্রেন এড়িয়ে অটো পালটে পালটে যাদবপুরে আসছিল। কিন্তু এত জ্যাম হয় রাজপুরের বিপত্তারিণী মোড় থেকে। তাই আবার ট্রেনেই ফিরে এসেছে।
ট্রেনে আগের মতোই ভিড় হচ্ছে, তবে সবাই মাস্কটা পরছে এই যা।গড়িয়ায় বেশ কয়েকজন নেমে যেতে মুন্নি ওর পাশে এসে বসল।মুন্নি পাশে বসলেই সেই দৃশ্যটা মাথায় ঘোরে আর বমি পায় ওর। ও একটু সরে বসল। এখন সরে বসলে তো মনে করার কিছু নেই। অতিমারীর কিছু সুবিধেও আছে।
বইটা কাঁধের ঝোলায় ঢুকিয়ে নূপুর ভাবছিল হংকং কি খুলেছে? দীর্ঘ এগারো মাস আই ব্রো, ফেসিয়াল করানো হয়নি। সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে আপার লিপ নিয়ে। নিয়মিত থ্রেডিং করাত তো।এই সপ্তায় দিতির এনগেজমেন্ট, এই গোঁফ নিয়ে সে যাবে কী করে?
ওর মাথায় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন এল। কিরণদি খুলেছিলেন পার্লার এই ক’মাসে? তাঁর নিয়মিত কাস্টমাররা তো কেউ যায়নি, যদি মুন্নিদের মত কেউ যেত এইসময়, তিনি কি ফেরাতেন, ফেরাতে পারতেন?
মুন্নিদের এই দলটা বরাবর নিউ গড়িয়া কিংবা বাঘাযতীনে নামে। এখানে ওরা বাড়ি বাড়ি ঘোরে, ওদের নাকি ইনফরমার থাকে, কোন বাড়িতে সদ্যোজাত শিশু আছে সেই খবর দিলে ইনফরমার পাঁচশ থেকে হাজার টাকা অব্দি পায়।
এটা ওদের দিনের কাজ, আর রাতের কাজের জন্যেই নাকি পার্লারে যাওয়া। সত্যি, যেকোন পার্লারে যাওয়ার আগে চিন্তা হয় নূপুরের, এখানে ওরা আসে না তো? নাহ, আজ বেশি ভিড় নেই, তবু বাঘাযতীন স্টেশন আসার আগেই উঠে গেটের দিকে এগোতে গেল নূপুর। মুন্নি কিন্তু বসেই আছে, বাঘাযতীনেও নামবে না ওরা? নূপুর একবার তাকাল ওর দিকে। কী পরিষ্কার ওর মুখ, ভুরুদুটি ধনুকের মত টানটান, ঠোঁটের ওপর কোন লোম নেই তো নূপুরের মতো, বাড়িতে নিজেরাই থ্রেডিং করে নাকি? আজ ট্রেনে উঠে মুন্নি ওর সঙ্গে কোন কথা বলেনি। এখন চোখাচোখি হতে হাসল একটু, একচিলতে হাসি।
নূপুর এগোতে এগোতে বলল ‘তোমরা বাঘাযতীন নামলে না?’
‘না দিদি, শিয়ালদা যাব’
মুন্নি উত্তর দেবার সঙ্গে সঙ্গে সালমা, কানফাটানো তালি বাজিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল
‘তোমরাই কি খালি ঘড়ি পরে, চশমা পরে, ব্যাগ দুলিয়ে চাকরি করতে যাবে নাকি? আমরাও ব্যাংকে কাজ পেয়েছি গো’
নূপুরের হতভম্ব মুখ দেখে পাশ থেকে রিনা ফিসফিস করে বলল ‘আরে ওইসব পাওনা লোনের টাকা আদায় করার জন্যে ব্যাংক লোক রাখে না? এদের পাঠালে কাজ হবে তাই হয়তো। পাটনা না কোথায় যেন আছে, নিউজে দেখেছি, এখানেও চালু হল তবে? যখন সায়া উঁচু করে মুখ ছোটাবে, বাপ বাপ বলে টাকা মিটিয়ে দেবে’
নূপুর নামবার আগে একবার পেছন ফিরে তিনজনকে দেখল। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল।কর্কশ গালের সালমা আর জুঁইকে হঠাৎ মুন্নির মতই সুন্দর লাগছে মনে হল নূপুরের।