গৌতম মুখার্জি
পাখির চোখে একঝলক দেখলে মনে হয় যেন কোনও শিশু খেলাচ্ছলে সাজিয়েছে এই ভয়ঙ্কর ওলটপালট! যেন বা কোনও ভয়ঙ্কর অ্যাড্রিনালিন অ্যাকশন গেম! একটা বীভৎস দুর্ঘটনা কীভাবে জীবনবোধকে তছনছ করে দেয়, বুঝিয়ে দেয়, মৃত্যু কত সহজ আর জীবন কেমন স্বার্থপর! মানুষের লাশ পেরিয়ে পেরিয়ে, আর্তি এড়িয়ে, কান্না ঠেলে লোভীর মতো বাঁচতে চায় সে। যাদের বেরিয়ে আসতে হয়েছে নিজের জীবন হাতে করে সেই মৃত্যু উপত্যকা থেকে, তারা জানে কী অপরাধবোধ এই নিরাপদ বেঁচে যাওয়ায়! কী অশ্লীল এই সুস্থ থাকার লোভ!
বেঁচে গেলেই তো হলনা, বেঁচে তো কোথাও যেতে হবে! কিন্তু, ‘কোথা রে সে নীড়, কোথা আশ্রয়শাখা!’ কেউ জানে না। ওই বিস্তীর্ণ অন্ধকারে, চারিদিকের হাহাকারের মধ্যে যখন শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে সাইরেনের শব্দ, রাস্তার একদিকে অ্যাম্বুলেন্সে নিথর চড়ছে একটু আগেই ট্রেনে-চড়া প্রাণচঞ্চল শরীরগুলো, আর রাস্তার আরেকদিকে তখন বরাত জোরে বেঁচে যাওয়া ভীত, দিকভ্রান্ত, উদ্বাস্তু মানুষের মিছিল চলেছে বাহানাগা বাজারের অচেনা রাস্তায় এক শেষহীন দিকশূন্যপুরের দিকে। প্রাথমিক সুস্থতার স্বস্তি ছাপিয়ে তখন ঘনিয়ে উঠতে শুরু করেছে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক!
কতটা পথ পেরোলে তবে রাস্তা পাওয়া যায়!
যারা দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন বা আহত হলেন তাদের মর্মান্তিকতার কোনো উপমা হয়না। কিন্তু, আমরা, যমেরও অরুচি যারা, অলৌকিক ভাবে বেঁচে রইলাম, তারাই তো অসংখ্য, পড়লাম দুঃসহ দুরাবস্থায়। বেহুঁশ কতকটা হাঁটার পর মনে হল যেন শেষমেষ হাইওয়েতে উঠলাম। শয়ে শয়ে মানুষ তখন মরিয়া পালাতে চাইছেন এ-জায়গা ছেড়ে, হামলে পড়ছেন যেকোনো গাড়ির ওপর। আর বিপদের সুযোগে গাড়িও গলা কাটছে, তাও জায়গা দিতে পারছে না। আমাদের উল্টোদিকের বার্থের সদ্য বিবাহিত যে জুটিটি ট্রেন ছাড়া ইস্তক খুনসুটি করছিল, মহঃ রাণা আর সাইমা সুলতানা, দুর্ঘটনার পর তারাই হতভম্ব আতঙ্কে কেমন গুটিসুটি আঁকড়ে ধরলো আমাদের আর আমরাও ছাড়তে পারলাম না। অসময়ের আত্মীয় হয়ে গেলাম আমরা। আর সেই মুহূর্ত থেকেই কী অব্যর্থ পরামর্শে, কী নিখুঁত কান্ডজ্ঞানে, আমাদের অভিভাবক হয়ে উঠল বয়সে আমার তস্য ছোট শ্যালক। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বেরিয়েছি তখন এগোব, যা থাকে কপালে, শুনলাম ঘন্টা সাড়ে তিনেকের রাস্তা ভুবনেশ্বর, হঠাৎই কীভাবে যেন দেবদূতের মত একটা গাড়ি এল, তিনি অবশ্য দানবীয় ভাড়া চাইলেন, তাতেই ওই জনারণ্যেও জায়গা জুটে গেল চারজনের। তারপর ভদ্রক-কটক-ভুবনেশ্বর।
এই মরপৃথিবীতে আমরা যেন অমর এলিয়েন! আত্মীয়ের ঠিক করা হোটেলে পৌঁছলাম রাত প্রায় তখন একটা। হোটেলের কর্মীরা ভিনগ্রহের প্রাণী দেখার মত আমাদের দেখলেন, সহানুভূতি জানালেন খুব আবার এটাও জানালেন যে, কিচেন ক্লোজড্, আজ রাতে আর খাওয়া মিলবে না। বেঁচে আছি যখন তখন তো খিদে পাচ্ছে। বন্ধু Ayanantaর তৎপরতায় ভুবনেশ্বরে কর্মরত ওর এক ছাত্র শুভম ওই অতো রাতে হোটেলে হাজির। কোথা থেকে যে খাবার আনিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করল আর পরদিন পর্যন্ত নিজের ডিউটি ছেড়ে জুড়ে রইল আমাদের সাথে। Krishanuর প্রায় স্লিপার সেলের কায়দার নীরব নেটওয়ার্কে পরদিন ওর ব্যাঙ্কের অফিসার অশোক কুমার সাহু গাড়ি নিয়ে উপস্থিত আমাদের হোটেলে। তিনি আমাদের নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন। ওদের ভালবাসা জানানোর কোনো ভাষা জানা নেই।
মৃত্যু স্থবির, জীবন যে গন্তব্য চায়! কিন্তু, ভুবনেশ্বরে আটকে পড়লাম! টানা দু’দিন। ফেরার বা যাবার সব ট্রেন বাতিল। বাসেও ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। আর এই সুযোগে ফ্লাইটের ভাড়াও চারপাঁচ গুণ বেড়ে নাগালের বাইরে চলে গেল! যখন ভাবছি, বাসে ভেঙে ভেঙে যাব, ভুবনেশ্বর থেকে ভাইজাগ তারপর ভাইজাগ থেকে চেন্নাই, টিকিটও কাটা গেল, তখন যাওয়ার সেই চূড়ান্ত ধকল থেকে বাঁচালেন ভুবনেশ্বর রেলওয়ের চিফ অপারেশনাল ম্যানেজার ও এক সহকারী অফিসার। তিনি অনেক চেষ্টা করে চারজনের জন্য অন্ততঃ দুটো ওয়েটিং লিস্ট টিকিট কনফার্ম করে দেবেন কথা দিলেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে জল চলে এসছিল, ভেজা চোখেই লক্ষ্য করলাম ডঃ এ.পি.জে আবদুল কালামের একটি উক্তি সযত্নে বাঁধানো আছে তার দেওয়ালে, ‘If you salute your duty you no need to salute anybody, But if you pollute your duty, you have to salute everybody’. নিছক উক্তির সমার্থক হয়ে উঠতে পারেন ক’জন! মনে মনে স্যালুট জানালাম তাকে। পরে অবশ্য সেই ব্যবস্থার দরকার হয়নি, বেঁচে-ফেরা যাত্রীদের ঘরে ফেরার প্রবল ভিড়ের চাপে একটি স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয় রেল, শেষমেষ তাতেই পৌঁছালাম চেন্নাই।
বন্ধুরা, দেশ-বিদেশের আত্মীয়স্বজন, জানা-অচেনা কতো মানুষজন, প্রিয়জনেরা ফোন করে, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে জানতে চেয়েছেন সুস্থ আছি কী না, তাদেরকে আমাদের এই দ্বিতীয় জন্মের ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা। ইউনিভার্সিটির বন্ধু, এবিপি আনন্দের Dipak Ghosh , আনন্দ বাজারের অগ্নি রায়, সাংবাদিক ভাই Gourকে ধন্যবাদ। তাদের মাধ্যমে মিডিয়ায় দ্রুত পৌঁছে দিতে পারা গেছে বিপর্যয়ের খবর। উঃ দিঃ জেলা প্রশাসন খোঁজ নিয়েছেন অনেকবার। ধন্যবাদ জানাই। ক্ষতিপূরণের চেক্ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছাক ক্ষতিপূরণ। যদিও এই ত্রাণ চুরির রাজ্যে সে ভরসা কম। আর, ‘দ্য বালাসোর সিগন্যালিং’ নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণাধর্মী সিনেমা কি নির্মিত হবে না? ‘কাশ্মীর ফাইলস’ বা ‘কেরালা স্টোরি’র পরিচালকদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ তাঁরাই তো ভারতবর্ষের স্বীকৃত গবেষক-পরিচালক!
এত কথা লিখলাম। জানি, দরকার ছিলনা। কিন্তু, আমার দরকার ছিল। বিরক্ত হলে পড়বেন না, এড়িয়ে যাবেন। আজ দুর্ঘটনা দশ দিনে পড়ল, দিন গুণব। দশ সপ্তাহ, মাস, বছর হয়ত পেরিয়ে যাবে, এত এত মানুষকে বেঘোরে মেরে দেওয়ার নির্মম অপদার্থতার কি বিচার হবে!? জানি না। অসহায় মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলার এই আত্মঘাতী বিকাশ কি থামবে! ওই যন্ত্রণা, হাহাকার আর তারমধ্যেই পাশবিক লুঠপাট কোনদিন কি ভুলতে পারবো! আহত সহযাত্রীদের সাহায্য না-করতে পারার যন্ত্রণা কি ভোলা যায়! যেন না ভুলি। স্মৃতিতে দগদগে জেগে থাকে যেন ভারতের ভয়াবহ, নজিরবিহীন ট্রেন ট্রাজেডি।
কাল বাড়ি ফিরেছি। বন্ধু Sujit ফেরার ব্যবস্থা করেছে বাগডোগরা থেকে, নাম লেখা না-লেখা কত প্রিয়জন যে কত ছোট বড় সাহায্য করেছেন! তাদের ভালবাসার কাছে ঋণী রইলাম আজীবন। আবার সেই চেনা শহর, মানুষজনের কাছে ফিরতে পেরে মনে হচ্ছে যেন একটু উপশম হল মানসিক ক্ষতের। তাই, হয়তো লিখতে পারলাম এতটা। নয়তো সেদিন, সেই প্রায় ৪৫° কাত হয়ে যাওয়া কামরা থেকে যখন বেরনোর যুদ্ধ করছি তখন গুরুতর জখম এক সহযাত্রী চিৎকার করছিলেন, ‘পুলিশ, মিডিয়া কো বুলাইয়ে সাব জলদি, জাদা দের হোনেসে এহি পে মর জায়েঙ্গে সাব!’ পুলিশের নাম্বার কোথায় পাব, ফেসকাঁপা হাতে শুধুই কয়েকটা লাইন ফেসবুকে লিখতে পেরেছিলাম। যদি মিডিয়া জানতে পারে, তাড়াতাড়ি ত্রাণ পৌঁছায় অকুস্থলে। তারপর থেকে বোধ আর হাত অসাড়।
সবাই ভালো থাকবেন। সাবধানে থাকবেন।
প্রার্থনা করি, কারোর জীবনে যেন কোনওদিন এমন সর্বনাশের সন্ধ্যা না আসে।